ঢাকা, বুধবার, ২৭ ফাল্গুন ১৪৩১, ১২ মার্চ ২০২৫, ১১ রমজান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

ধর্ষণের বিচার: আইনে আসছে যেসব সংশোধনী

ইলিয়াস সরকার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০২৫
ধর্ষণের বিচার: আইনে আসছে যেসব সংশোধনী

ঢাকা: পাঁচ বছর আগে ধর্ষণের শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন। ২০২০ সালে করোনাকালে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে একজন গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং ওই সময়ে আরও কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে বিক্ষোভের মুখে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করা হয়।

সে দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ সংশোধন করে তৎকালীন সরকার ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু, ইত্যাদির শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করে।

ওই ঘটনার পাঁচ বছর পর এসে মাগুরায় আট বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠায় এবার দ্রুত বিচারের দাবি উঠছে। ধর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্নস্থানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। এ অবস্থায় আইনজীবীরা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। অপরদিকে সরকার দ্রুত বিচার ও তদন্তে আইন সংশোধনের ঘোষণা দিয়েছে।

সরকারের এ আইন সংশোধনের ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন আইনজীবীরা।

মাগুরার নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ৬ মার্চ শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয় বলে পরিবারের অভিযোগ। শিশুটিকে প্রথমে মাগুরা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সেখান থেকে নেওয়া হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে শুক্রবার রাতে ভেন্টিলেশনে নেওয়া হয়। এরপর শনিবার সন্ধ্যায় তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হয়।

এদিকে ধর্ষণের ঘটনার তিনদিন পর শনিবার শিশুর মা বাদী হয়ে সদর থানায় চারজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। এ মামলায় শিশুটির ভগ্নিপতি সজিব হোসেন (১৮) ও বোনের শ্বশুর হিটু মিয়া (৪২), সজিব শেখের এক ভাই (১৭) ও তাদের মা জাবেদা বেগমকে (৪০) আসামি করা হয়েছে। তাদের চারজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ ঘটনায় সারা দেশে বিক্ষোভের পর ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে আইন মন্ত্রণালয়। রোববার (৯ মার্চ) দুপুরে ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম।

আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ধর্ষণ বা নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কিছু আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছিল। আজকে সভা করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে অংশীজনদের সঙ্গে কিছু পরামর্শ করতে হবে। এরপর চূড়ান্ত করা হবে। কয়েকদিনের মধ্যেই এ আইনগত পরিবর্তন আনার জন্য চেষ্টা করা হবে।

আইনের ২০ (২) ধারায় বলা হয়েছে, “ট্রাইব্যুনালে মামলার শুনানি শুরু হইলে উহা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা চলিবে। (৩) বিচারের জন্য মামলা প্রাপ্তির তারিখ হইতে একশত আশি দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল বিচারকার্য সমাপ্ত করিবে। (৪) উপধারা (৩) এর অধীন সময়সীমার মধ্যে মামলার বিচারকার্য সমাপ্ত না হইলে ট্রাইব্যুনাল মামলার আসামিকে জামিনে মুক্তি দিতে পারিবে এবং আসামিকে জামিনে মুক্তি দেওয়া না হইলে ট্রাইব্যুনাল উহার কারণ লিপিবদ্ধ করিবে। ”

এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘ধর্ষণের মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে বিচার করতে হবে। যদি এই ৯০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ না–ও হয়, সেই অজুহাতে কাউকে জামিন দেওয়া যাবে না। এখন আছে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার না হলে জামিন দেওয়া যেত। এ ছাড়া ধর্ষণের মামলায় বিচারের ক্ষেত্রে যদি কোনো রকমের গাফিলতি থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুনির্দিষ্ট বিধান আইনে সংযোজন করা হবে। ’

তদন্ত প্রক্রিয়ায় যে জটিলতা

আইনের তদন্ত প্রক্রিয়ায় একটি জটিল প্রক্রিয়া রয়েছে। তদন্ত সম্পর্কিত আইনের ১৮ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, “অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনের সময়ে হাতেনাতে পুলিশ কর্তৃক ধৃত হইলে বা অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধৃত হইয়া পুলিশের নিকট সোপর্দ হইলে, তাহার ধৃত হইবার তারিখ হইতে পরবর্তী পনেরো কার্যদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করিতে হইবে; অথবা (খ) অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনের সময়ে হাতেনাতে ধৃত না হইলে তাহার অপরাধ সংঘটন সংক্রান্ত প্রাথমিক তথ্য প্রাপ্তি বা, ক্ষেত্রমত, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা তাহার নিকট হইতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অথবা ট্রাইব্যুনালের নিকট হইতে তদন্তের আদেশ প্রাপ্তির তারিখ হইতে পরবর্তী ষাট কার্যদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করিতে হইবে। ”

“(২) কোনো যুক্তিসংগত কারণে উপধারা (১) এ উল্লিখিত সময়ের মধ্যে তদন্তকার্য সমাপ্ত করা সম্ভব না হইলে, তদন্তকারী কর্মকর্তা কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া অতিরিক্ত ত্রিশ কার্যদিবসের মধ্যে অপরাধের তদন্ত কার্য সম্পন্ন করিবেন এবং তৎসম্পর্কে কারণ উল্লেখপূর্বক তাহার নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা বা ক্ষেত্রমত, তদন্তের আদেশ প্রদানকারী ট্রাইব্যুনালকে লিখিতভাবে অবহিত করিবেন। ”

“(৩) উপধারা (২) এ উল্লিখিত সময়সীমার মধ্যেও তদন্তকার্য সম্পন্ন করা না হইলে, সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তা উক্ত সময়সীমা অতিক্রান্ত হইবার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে উক্তরূপ তদন্তকার্য সম্পন্ন না হওয়া সম্পর্কে তাহার নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা কিংবা তদন্তের আদেশ প্রদানকারী ট্রাইব্যুনালকে লিখিতভাবে অবহিত করিবেন। ”

“(৪) উপধারা (৩) এর অধীন তদন্তকার্য সম্পন্ন না হওয়া সম্পর্কে অবহিত হইবার পর নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা কিংবা, ক্ষেত্রমত, তদন্তের আদেশ প্রদানকারী ট্রাইব্যুনাল উক্ত অপরাধের তদন্তভার অন্য কোনো কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর করিতে পারিবেন এবং উক্তরূপে কোনো অপরাধের তদন্তভার হস্তান্তর করা হইলে তদন্তের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-(ক) অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনের সময়ে হাতেনাতে পুলিশ কর্তৃক ধৃত হইলে বা অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধৃত হইয়া পুলিশের নিকট সোপর্দ হইলে, তদন্তের আদেশ প্রাপ্তির তারিখ হইতে পরবর্তী সাত কার্য দিবসের মধ্যে সম্পন্ন করিবেন; অথবা (খ) অন্যান্য ক্ষেত্রে তদন্তের আদেশ প্রাপ্তির তারিখ হইতে পরবর্তী ত্রিশ কার্য দিবসের মধ্যে সম্পন্ন করিতে হইবে। ”

“(৫) উপধারা (৪) এ উল্লিখিত সময়সীমার মধ্যেও তদন্তকার্য সম্পন্ন করা না হইলে, সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তা উক্ত সময়সীমা অতিক্রান্ত হইবার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে উক্তরূপ তদন্তকার্য সম্পন্ন না হওয়া সম্পর্কে তাহার নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা কিংবা, ক্ষেত্রমত, তদন্তের আদেশ প্রদানকারী ট্রাইব্যুনালকে লিখিতভাবে অবহিত করিবেন। ”

“(৬) উপধারা (২) বা উপধারা (৪) এ উল্লিখিত সময়সীমার মধ্যে কোন তদন্তকার্য সম্পন্ন না করার ক্ষেত্রে, তদ্‌সম্পর্কে ব্যাখ্যা সম্বলিত প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা কিংবা, ক্ষেত্রমত, তদন্তের আদেশ প্রদানকারী ট্রাইব্যুনাল যদি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন না হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তাই দায়ী, তাহা হইলে উহা দায়ী ব্যক্তির অদক্ষতা ও অসদাচরণ বলিয়া বিবেচিত হইবে এবং এই অদক্ষতা ও অসদাচরণ তাহার বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ করা হইবে এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী তাহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে। ”

“(৯) ট্রাইব্যুনাল কোনো আবেদনের প্রেক্ষিতে বা অন্য কোনো তথ্যের ভিত্তিতে কোনো তদন্তকারী কর্মকর্তার পরিবর্তে অন্য কোনো তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিতে পারিবে। ”

জটিলতা নিরসনে যে চিন্তা

এ জটিল প্রক্রিয়া নিরসনেও সংশোধনীর চিন্তা ভাবনা করছে সরকার। এ বিষয়ে ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো ঘটনার মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা ৩০ দিনের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ করতে না পারলে তাকে পরিবর্তন করে আরেকজনকে দেওয়া হতো। তিনিও না পারলে আরেকজনকে দেওয়া হতো। এভাবে অনেকবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হতো। এতে মামলার বিচার করতে দেরি হতো। এখন যে সংশোধনী আনা হবে, তাতে বলা হবে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে যাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তাকেই তদন্ত কাজ শেষ করতে হবে এবং তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই। তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তদন্তের সময়ও অর্ধেক কমিয়ে ১৫ দিন করে দেওয়া হচ্ছে।

আইনটির ৩২ক ধারায় বলা হয়েছে, “এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির ধারা ৩২-এর অধীন মেডিক্যাল পরীক্ষা ছাড়াও, উক্ত ব্যক্তির সম্মতি থাকুক বা না থাকুক, ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) আইন, ২০১৪  এর বিধান অনুযায়ী ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) পরীক্ষা করিতে হইবে। ”

এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘ধর্ষণের মামলায় ডিএনএ সনদ লাগত, কিন্তু সারা দেশে এ ব্যবস্থা নেই। তাই অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে সংশোধনী আনা হবে। সেই সংশোধনী হবে উপযুক্ত ক্ষেত্রে বিচারক যদি মনে করেন শুধু চিকিৎসা সনদের ভিত্তিতে এ মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ পরিচালনা সম্ভব, তাহলে তিনি সে রকম ব্যবস্থা নিতে পারবেন। ’

এ ব্রিফিংয়ের আগে মাগুরার শিশুটির ন্যায় বিচার পাওয়া নিয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন দুই আইনজীবী। সেই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে শিশুটির নাম-পরিচয় সংক্রান্ত সব কিছু ইন্টারনেট থেকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছেন। শিশু এবং তার বোনের কল্যাণ নিশ্চিতে দুইজন সমাজসেবা অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া, আইন অনুসারে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করতে বলেছেন।

রিটকারী আইনজীবী এবিএম হামিদুল মিসবাহ বাংলানিউজকে বলেন, আমরা কিন্তু আদালতে ৬০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার নির্দেশনা চেয়েছিলাম। আদালতও একটা সময় দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আইনে ১৮০ দিন রয়েছে। এ কারণে কোর্ট তো আর আইনের বাইরে যেতে পারে না। এখন সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটাকে সাধুবাদ জানাই। আইন সংশোধন করে তদন্তে ১৫ দিন এবং ৯০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করা হলে ভিকটিমরা দ্রুত বিচার পাবেন আশা করি।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪০ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০২৫
ইএস/এইচএ/এজে/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।