ঢাকা, বুধবার, ১১ চৈত্র ১৪৩১, ২৬ মার্চ ২০২৫, ২৫ রমজান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

বাংলাদেশের জন্য যেভাবে অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন তারেক রহমান

তানভীর আহমেদ, সিনিয়র রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪১ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০২৫
বাংলাদেশের জন্য যেভাবে অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন তারেক রহমান তারেক রহমান। ফাইল ছবি

ঢাকা: স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতনের কয়েকদিনের মাথায় গত আগস্টে কার্টুনিস্ট মেহেদী হক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ব্যঙ্গ করে একটি কার্টুন এঁকেছিলেন। তারেক রহমান নিজেই সেই কার্টুন ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে প্রশংসা করেন এবং তেমন কার্টুন আঁকতে উৎসাহ দেন।

১৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির বিশাল জনসমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি বক্তব্য দেন তারেক রহমান। স্বৈরাচার সরকারের অসংখ্য মামলায় জর্জরিত, মিডিয়া ট্রায়াল আর নানামুখী অপপ্রচারে বিপর্যস্ত, মৃত্যুর পর ভাই আরাফাত রহমান কোকোকে দেখতেও আসতে না পারা এবং মা বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে কথিত দুর্নীতির মামলায় কারাগারে বন্দী করার পরও দেশে আসতে না পারা—এমন নানা নিপীড়ন সইতে হলেও তার সেদিনের বক্তব্যে ছিল না কোনো প্রতিহিংসা, উসকানি, কুরুচিপূর্ণ ভাষা, দায়িত্বহীনতা বা প্রতিশোধপরায়ণতার প্রকাশ। বরং ছিল সহনশীলতা, দায়িত্বশীলতা, পরিপক্বতা; যা মার্জিত ও রুচিশীল ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে।

অথচ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে একটি কার্টুন আঁকার জন্যই কারাগারে যেতে হয়েছিল কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে। সেই কার্টুন নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে শেয়ার করায় কারা প্রকোষ্ঠে যেতে হয় লেখক মুশতাক আহমেদকে। দিনের পর দিন নির্যাতনের কারণে এবং জামিন না পেয়ে একদিন কারাগারেই প্রাণ যায় মুশতাকের, যেটাকে তার আইনজীবীরা তখন ‘সিস্টেম্যাটিক হত্যাকাণ্ড’ বলেছিলেন।

আর ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের নেতাদের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দেওয়া প্রতিহিংসা, জিঘাংসা, কুরুচিপূর্ণ ও প্রতিশোধপরায়ণ বক্তব্য এখনো রাজনৈতিক মহলের স্মৃতিতে গেঁথে আছে। যার মধ্যে হাসিনার ‘টুস করে নদীতে ফেলা’, ‘চুবানি দেওয়া’র মতো হুমকি এবং তুই-তোকারি করে তার ও আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাদের অশোভন ভাষায় হম্ভিতম্ভি এখনো অনলাইন-ইউটিউবে ভেসে বেড়াচ্ছে।

মেহেদী হকের সেই কার্টুন বা সেপ্টেম্বরের সেই সমাবেশই নয়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে তারেক রহমানের সব বক্তব্য-বিবৃতি এবং পদক্ষেপই রাজনীতি সচেতনদের আগ্রহের কেন্দ্রে। তারেক রহমানের অনুসারীরা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহনশীলতা ও দায়িত্বশীলতার নজির গড়ে চলেছেন তিনি।

তারেক রহমান

হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়া প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সংস্কার ও নির্বাচন শেষে বিদায় নেবেন বলে অনুমেয়। ফ্যাসিবাদের পতনের পর ভারতসহ অনেক শক্তি বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত হলেও ড. ইউনূসের কৌশল সেসবকে উড়িয়ে দিচ্ছে। তার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য ঢাল হিসেবে বিবেচনা করছেন অনেকে।  

জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পর তিনি বিদায় নিলে দেশকে নেতৃত্ব দিতে পারেন বা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন– এক কথায় দেশের পরবর্তী যোগ্য প্রধানমন্ত্রী কে হতে পারেন– এ নিয়ে চলছে জোর আলোচনা। এই প্রেক্ষাপটে বদলে যাওয়া তারেক রহমানই আলোচনার কেন্দ্রে থাকছেন। বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষে প্রকাশ্যে প্রচার চালাচ্ছেন। অন্যদিকে নিরপেক্ষ রাজনীতি বিশ্লেষকদের অনেকেই তারেক রহমানের নেতৃত্বের সঠিক মূল্যায়ন করতে সময় নিচ্ছেন।  

যদিও এক্ষেত্রে হাসিনার পতনের এক দফার ঘোষক ও অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ ইসলামও আলোচনার তালিকায় আছেন। নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার পদ ছেড়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়কের দায়িত্ব নিয়েছেন। তার রাজনৈতিক বক্তব্য ও সিদ্ধান্তেও অনেকে ধীরতা-স্থিরতা এবং সহনশীলতা-দায়িত্বশীলতার প্রকাশ দেখছেন।

নিরপেক্ষ বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপিতে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অগ্রভাগে এনে দিয়েছে। তিনি সুস্থ হয়ে উঠলে তারেক রহমানের এই অবস্থান নাও থাকতে পারে।

তারা বলছেন, ওয়ান-ইলেভেন ও তারপর যে অপপ্রচারের শিকার হয়েছিলেন, সেখান থেকে ব্যক্তি তারেক রহমান ইতোমধ্যেই নিজের ইমেজ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। তবে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার পথকে মসৃণ করতে কতটা সক্ষম হবেন সেটা দেখা বিষয়।  

নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতার আশঙ্কা করছেন বিএনপিসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে সরকারকে দ্রুত নির্বাচনে বাধ্য করবেন সেটাও তারেক রহমানের রাজনৈতিক পরিপক্কতার প্রমাণ বহন করবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

একইসঙ্গে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে দলকে ক্ষমতায় নিয়ে যেতে কতটুকু সফল হন, তার ওপরও তার নেতৃত্বের দক্ষতা নির্ভর করছে। বিদ্যমান রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে এই মুহূর্তে তারেক রহমান বাংলাদেশে অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন বলেই মনে করেন দলের সমর্থকরা। অনেকে মনে করেন, তারেক রহমান দেশে ফিরলেই অমানিশা কেটে ভোর হবে।  

বিএনপির সমর্থকরা তারেক রহমানকে শুধু দলের জন্যই নয়, দেশের জন্যও অপরিহার্য হিসেবে বিবেচনা করছেন। এদের একটি অংশের ভাষ্য, শেখ হাসিনার পলায়ন ও তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের রাজনৈতিক দোলাচল এবং অসুস্থতাজনিত কারণে খালেদা জিয়ার নিষ্ক্রিয়তা বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনীতিতে তারেক রহমানকে অপরিহার্য করে তুলেছে।

সমালোচনা গ্রহণের শক্তি

রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, দেশের রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজের সমালোচনা সহ্য এবং এর প্রশংসা করার শক্তি অর্জন করেছেন তারেক রহমান। মেহেদী হক তাকে ব্যঙ্গ করে কার্টুন আঁকার পর তারেক রহমান নিজেই সেই কার্টুন ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে লেখেন, ‘এমন কার্টুন আরও আঁকা হোক। ২০০১-০৬ পর্যন্ত আমাকে আর আমার মাকে নিয়ে প্রচুর ব্যঙ্গ কার্টুন আঁকা হতো। বিশেষ করে প্রথম আলোতে শিশির ভট্টাচার্য সেই কার্টুনগুলো আকতেন। হাসিনার রেজিম এই কার্টুন আঁকা বন্ধ করে দেয়। ইভেন কার্টুনিস্ট কিশোরকে জেলে নিয়ে মেরে গুম করে হাসিনার পুলিশ। আগামীর বাংলাদেশে আবার পলিটিক্যাল কার্টুন ফিরে আসুক। আর কোন কার্টুনিস্টকে যেন কার্টুন আঁকানোর জন্য জেলে না যেতে হয়। ’

তার ওই পোস্ট তখন ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও লেখক তাহমিদুল ইসলাম তখন তারেক রহমানের পোস্ট শেয়ার দিয়ে লেখেন, ‘এই ধরণের সহনশীলতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখতে পাওয়াটাও স্বপের মত। তারেক রহমানকে ব্যঙ্গ করে মেহদী হকের কার্টুন শেয়ার করেছেন তারেক রহমান। বলেছেন, রাজনৈতিক কার্টুন আঁকার স্বাধীনতা বাংলাদেশে ফিরে আসায় তিনি খুশি। মনে করিয়ে দেন- ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তিনি এবং তাঁর মাকে নিয়ে অনেকেই কার্টুন আঁকতো, তাদের বিরুদ্ধে কখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তারেক রহমানের অনেক সমালোচনা সামনে করবো। কিন্তু এটার প্রশংসা না করে পারাই যায় না। ’

গুণকীর্তনে লাগাম

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সম্মেলনে দলের ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, ‘তারেক রহমানের নাম মুখে নিতে হলে নাবালক বাচ্চাদের অজু করতে হবে। নাবালক বাচ্চারা তারেক রহমানকে নিয়ে যা বলছেন, এগুলো এদেশের মানুষ মেনে নেবে না। ’

এ নিয়ে নানামুখী সমালোচনা হয়। খোদ তারেক রহমানই এমন স্তুতিবাক্যের লাগাম টানতে বলেন দলের নেতাদের। ২৭ ফেব্রুয়ারি এক বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘নেতা-নেত্রীদের সম্পর্কে বক্তব্য দেওয়ার সময়, দয়া করে প্রশংসাসূচক শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্কতা, বুদ্ধিমত্তা এবং পরিমিতবোধের পরিচয় দেবেন। ’

অথচ ফ্যাসিবাদের আমলে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ তো বটেই, রাষ্ট্রীয় আয়োজনেও স্তুতির বহর দেখা যেত হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যের জন্য। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা অর্থ অপচয় করে জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনসহ নানা কর্মসূচি পর্যন্ত দেখা গেছে।

বক্তব্যে সহনশীলতা-দায়িত্বশীলতা-পরিপক্বতা

৫ আগস্ট স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হলে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত দেশে কার্যত কোনো সরকার ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে দেশে রাজনৈতিক সংঘাতের পথ তৈরি হয়। পরিস্থিতি আঁচ করতে পারে ৫ আগস্টেই তারেক রহমান এক ভিডিও বার্তায় বিএনপি নেতাকর্মীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানান। সেদিন তিনি বলেন, অনুগ্রহ করে কেউ প্রতিশোধ কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ হবেন না। কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না। অর্জিত বিজয় যাতে লক্ষচ্যুত না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক এবং সজাগ দৃষ্টি রাখার রাখুন।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় মিডিয়ায় সংঘব্ধ প্রোপাগান্ডা শুরু হলে সেদেশের উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা উত্তেজিত হয়ে ২ ডিসেম্বর আগরতলা দূতাবাসে হামলা চালায়। এ নিয়ে দুদেশের মধ্যে তখন উত্তেজনা তৈরি হয়। সেই প্রেক্ষাপটেও তারেক রহমান এক বার্তায় বিএনপি নেতা-কর্মসীসহ দেশবাসীকে শান্ত ও সংযত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতি, আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে।

তারেক রহমান

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত বরাবরই দ্বিপাক্ষিক সমস্যাগুলোর সমাধানে বাংলাদেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছে ফ্যাসিবাদের আমলে। পানি সমস্যার সমাধান ও সীমান্ত হত্যা বন্ধে দেশটি কখনো সাড়া দেয়নি। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি, তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে রংপুর বিভাগের পাঁচটি জেলার ১১টি স্থানে ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচির আয়োজন করে বিএনপি। সেখানে আয়োজিত জনসভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তারেক রহমান বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অন্যায্য আচরণের বিষয়ে সোচ্চার হন।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশের জনগণকে মনে রাখেনি, শুধু স্বৈরাচারকে (হাসিনা) মনে রেখেছে। বাংলাদেশের জনগণ মনে করে প্রতিবেশী দেশের (ভারত) সঙ্গে আমাদের যে অন্যায্য চুক্তি আছে, সেগুলো বাতিল করতে হবে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবেশী দেশ থেকে আর কোনো অন্যায্যতা দেখতে চায় না, ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ আর দেখতে চায় না।

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে রাজপথে থাকা রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে সম্প্রতি নানা বিষয়ে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে পড়ে। এতে একদল আরেকদলের সমালোচনার নামে আক্রমণ করতে থাকেন। এ বিষয়েও দায়িত্বশীল বার্তা দেন তারেক রহমান। তিনি গত ১১ মার্চ এক ইফতার মাহফিলে বলেন, ‘আমরা বাস্তবধর্মী সমালোচনা অবশ্যই করব-একজন আরেকজনের। কিন্তু সমালোচনা করতে গিয়ে এমন পরিস্থিতিতে যেন আমরা না দাঁড়াই, যেখানে আমরা জনগণের এই (গুরুত্বপূর্ণ) ইস্যুগুলোকে, দেশের ইস্যুগুলোকে আমরা অ্যাড্রেস করতে ভুলে যাব। আমাদের কাছে অন্য কিছু মুখ্য হয়ে যাবে, এগুলো গৌণ হয়ে যাবে। এটি যদি হয়, এ দেশের সম্ভাবনা তাহলে শেষ হয়ে যাবে, নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ’

কূটনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্ব

বিএনপির নেতা-কর্মীদের মতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও স্বীকৃতি পাচ্ছে তারেক রহমানের নেতৃত্ব। এরই অংশ হিসেবে গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল প্রেয়ার ব্রেকফাস্ট’ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পান তারেক রহমানসহ বিএনপির তিন নেতা। যদিও তারেক রহমানের পক্ষে তার কন্যা ব্যারিস্টার জাইমা রহমান এতে অংশ নেন। ওই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানায় আয়োজকরা।

রাজনৈতিক নেতাদের ভাষ্য

বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলছেন, প্রায় দুই দশকের হামলা, মামলা, নির্যাতনের মুখেও বিএনপি ভেঙে যায়নি। দলটির তৃণমূলের নেতারাও হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেননি। তার একটি কারণ হতে পারে তারেক রহমানের নেতৃত্ব। পুরো স্বৈরশাসনামলে বিএনপি আন্দোলন চালিয়ে গেছে। সবশেষে যে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ, বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হলো, এই আন্দোলনে এমনি এমনি সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ। তারেকের নেতৃত্বে এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিল দলের সব অঙ্গসংগঠন। এই আন্দোলনেই সারাদেশে বিএনপির ৫২৪ জন নেতাকর্মী মারা গেছেন।

বিএনপির ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, তারেক রহমান সব বাধা উপেক্ষা করে বাংলাদেশের প্রয়োজনে বর্তমান সময়ে অনিবার্য হিসেবে নিজেকে পরিণত করেছেন। এজন্য তিনি দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে একেবারেই গ্রাম পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কোন বাধাই তাকে রুখে দিতে পারেনি।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, বিএনপি বর্তমানে দেশের ক্ষমতা গ্রহণের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দল। আর এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সুতরাং তার গুরুত্ব অপরিসীম।

বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, তিনি (তারেক রহমান) এখনো বিদেশে থেকেও দেশের জন্য যে ভূমিকা রাখছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র বিএনপি নয়, বাংলাদেশের জন্য তিনি অপরিহার্য।

দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ও বিভিন্ন সমাবেশে ভার্চ্যুয়ালি খুবই সক্রিয় তারেক রহমান

বাংলানিউজকে তিনি আরও বলেন, ‘দেশ গঠনের জন্য তারেক রহমান অনেক আগেই ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এমনকি গত সাত মাসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে আসছেন। এই ৩১ দফার অন্যতম একটি প্রস্তাব হলো দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রণয়ন- যাতে বিদ্যমান সংসদীয় কাঠামোর পাশাপাশি এই আইনসভায় দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী এবং প্রশাসনিক দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার কমাতে এবং জাতীয় ঐক্য বাড়াতে এটি আরও সহায়ক হবে। ’

ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় শেখ হাসিনা ও তার নেতাকর্মীদের অভিযোগ ছিল, খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, কথিত ‘হাওয়া ভবন’ খুলে সমান্তরাল সরকার গঠন করেছিলেন তারেক রহমান। ‘হাওয়া ভবন’ থেকে সরকার পরিচালনা করে দুই হাতে লুটপাট ও দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন তিনি।

এসব অভিযোগের ভিত্তিতে বিগত সরকারের আমলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সারা দেশে ৮৪টি মামলা দায়ের করা হয়। তার মধ্যে সিংহভাগ মামলা ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বাংলানিউজকে বলেন, এসব মামলা যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে করা হয়েছিল তা এখন প্রমাণিত হচ্ছে। বাকি মামলাগুলোও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি অব্যাহতি বা খালাস পেয়ে যাবেন বলে আশা করছি।

বিশ্লেষকরা যা বলছেন

নেতৃত্বের জায়গায় তারেক রহমানের পরিপক্বতা স্বীকার করছেন নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা। তবে পুরোপুরি মূল্যায়নে যেতে আরও সময় চান তারা।

বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বাংলানিউজকে বলেন, তারেক রহমান একটা দলের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। পরিবর্তনের কারণে তার নেতৃত্বের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবে তার সঠিক মূল্যায়নের সময় এখনো আসেনি। তিনি দেশে ফিরলে পরিস্থিতি বোঝা যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. এস এম রেজা বলেন, বর্তমানে যারা বিএনপি করে, তারা কাকে চাইছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তারেক রহমান গত ১৫ বছর দেশের বাইরে থেকেছেন। গত ৫-৬ মাসে তিনি বিভিন্ন সভায় যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে আমরা একটি শব্দও অগোছালো পাইনি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের জায়গা থেকে সেই বক্তব্যগুলো খুবই ম্যাচিউরড ও বুদ্ধিদীপ্ত।

হাসিনার সরকারের পতনের প্রসঙ্গ টেনে বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন প্রজন্মের ভাষা না বুঝলে যে কোনো দল এই দেশের রাজনীতিতে টিকতে পারবে না, তার বড় উদাহরণ উপমহাদেশের পুরনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। তারেক রহমান অবশ্য নিজেও বলেছেন-ক্ষমতায় যেই যাক, বিগত সরকারের মতো এরকম কিছু করলে, তাদেরও ৫ আগস্টের পরিণতি ভোগ করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০২৪১ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০২৫
টিএ/এইচএ/এসএমএস/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।