ঢাকা, বুধবার, ১২ চৈত্র ১৪৩১, ২৬ মার্চ ২০২৫, ২৫ রমজান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তের ‘স্ক্যাম সেন্টারে’ বাংলাদেশিদের ভয়াবহ বন্দী জীবন

তৌহিদুর রহমান, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২৫
থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তের ‘স্ক্যাম সেন্টারে’ বাংলাদেশিদের ভয়াবহ বন্দী জীবন

ঢাকা: ‘আমাদের সবাইকে টার্গেট দেওয়া হতো। আর সেই টার্গেট পূরণ না করতে না পারলে চলতো বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন।

লাঠি দিয়ে মারধর, বৈদ্যুতিক শক, ২০ লিটার পানির বোতল কাঁধে দিয়ে উঠবোস করানোসহ নানারকম নির্যাতন করা হতো। ’

বাংলানিউজ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এমনটাই বলছিলেন থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তের ‘স্ক্যাম সেন্টার’ থেকে ফিরে আসা যুবক নোয়াখালীর ইসমাইল হোসেন।

সীমান্তের ওই স্ক্যাম সেন্টার থেকে উদ্ধারের পর গত ১৯ মার্চ দেশে ফেরেন ১৮ বাংলাদেশি। তদেরই একজন নোয়াখালীর ইসমাইল হোসেন।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি দুবাইয়ে একটি হোটেলে কাজ করতাম। সেখানে আমার মাসে আয় ছিলো প্রায় ৮০০ ডলার। তখন মাসে ১২০০ ডলার আয়ের কথা বলে আমাকে থাইল্যান্ডে যাওয়ার অফার দেওয়া হয়। দুবাইয়ে থাকা বাংলাদেশি নাগরিক জুনাইদ পারভেজ ও নোমানের মাধ্যমে আমরা সেখানে যাই। প্রথমে বলা হয়েছিলো, আমাদের চাকরি হবে ব্যাংককে। ব্যাংককে যাওয়ার পর বলা হয়, ওখানে নয়, আরেকটি শহরে তাদের অফিস। সে অনুযায়ী মাইক্রোবাসে করে থাইল্যান্ডের সীমান্ত শহর মাইসতে নিয়ে যাওয়া হয়। মাইসত থেকে সীমান্ত পার হয়ে মিয়ানমারের একটি স্থানে আমাদের নেওয়া হয়। জায়গাটি পাহাড়ঘেরা। আশপাশে জনবসতি নেই। সেখানে যখন আমাদের গাড়ি থেকে নামানো হয়, দেখি অস্ত্র হাতে অনেক লোকজন। আমাদের একটি ক্যাম্পে নিয়ে বন্দী করা হয়। তখন বুঝতে পারি প্রতারণার শিকার হয়েছি। ’

সেখানে আপনাদের দিয়ে কী করানো হতো, জানতে চাইলে ইসমাইল হোসেন বলেন, আমাদের দিয়ে মানুষের ডেটা কালেক্ট করানো হতো। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ থেকে মানুষের নাম, মোবাইল নম্বর, ই-মেইল ইত্যাদি কালেক্ট করা ছিলো আমাদের কাজ। তারপর সেই ডেটা তারা অন্য বিভাগে দিত। তারা তালিকা ধরে ওইসব মানুষের সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিত।

তিনি বলেন, অনেকেই টার্গেট পূরণ করতে পারতো না। যারা টার্গেট পূরণ করতে পারতো না, তাদেরকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হতো। সেখান থেকে বাড়িতে যোগাযোগের উপায়ও ছিলো না। কেননা কম্পিটার প্রতিনিয়ত মনিটরিং করা হতো। আমি ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দু'একটি সংস্থায় উদ্ধারের জন্য ওয়েবসাইটে যোগাযোগ করি। পরে তারা বুঝতে পেরে আমাকে দু'দিন নির্মমভাবে পেটায়। পরে বিভিন্ন সংস্থার চাপের মুখে ডেমোক্রেটিক কারেন বুদ্ধিস্ট আর্মি-ডিকেবিএ ও থাই পুলিশের সহায়তায় ওখান থেকে বিভিন্ন দেশের ৬৮ জন লোক ছাড়া পায়। আমরা ১৮ জন বাংলাদেশিও ছাড়া পাই। পরে থাইল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় দেশে ফিরি।

ইসমাইল হোসেন জানান, আমরা যে সেন্টারে ছিলাম, সেখানে ২৭০০ লোক কাজ করতেন। এই সেন্টারে ১৮ জন বাংলাদেশি ছিলেন। সবাই মুক্তি পেয়েছেন। আমাদের পাশেই আর একটি সেন্টারে ৯ হাজার লোক কাজ করেন। তবে সেখানে কোনো বাংলাদেশি নেই।

থাইল্যান্ডের সীমান্ত থেকে উদ্ধার হয়ে ফিরে আসা আর এক বাংলাদেশি চট্টগ্রামের রায়হান সোবহান। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন গত নভেম্বর মাসে। তিনিও দুবাই থেকে ১২০০ ডলার বেতনের প্রলোভনে যান থাইল্যান্ডে।

রায়হান সোবহান বাংলানিউজকে বলেন, মিয়ানমারের স্ক্যাম সেন্টারে নিয়ে যাওয়ার পর বাড়িতে মোবাইল ফোন দিয়ে বলতে বলা হয়, ‘আমি ভালো আছি। ’ সে অনুযায়ী বাড়িতে ফোন দেই। কথা বলার পর ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। তারপর আর যোগাযোগ করা যায়নি।

তিনিও জানান, যারা ওদের টার্গেট পূরণ করতে পারতো না, তাদেরকে নানা ধরনের নির্যাতন করা হতো। রোদের মধ্যে কাঁধে বোতল দিয়ে উঠবোস করা, বৈদ্যুতিক শক, লাঠি দিয়ে পেটানোসহ নানাভাবে নির্যাতন করা হতো।

থাইল্যান্ড সীমান্তের স্ক্যাম সেন্টার থেকে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান (মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) বাংলানিউজকে বলেন, থাইল্যান্ড সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে বন্দী বাংলাদেশি ভুক্তভোগীদের পরিবারের পক্ষ থেকে তাদেরকে উদ্ধারের জন্যে ব্র্যাকের সঙ্গে যোগযোগ করে। এরপর আমরা বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সিআইডি ও থাইল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সবার নিরলস প্রচেষ্টায় দুঃসহ বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছেন ১৮ বাংলাদেশি।

তিনি আরো বলেন, সাইবার স্ক্যাম মানব পাচারের ভয়াবহ একটা ধরন। কম্পিউটার অপারেটর, টাইপিস্ট, কলসেন্টার অপারেটরসহ বিভিন্ন পদে আকর্ষণীয় বেতনের প্রলোভন দিয়ে নিয়োগের কথা বলে বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে (ভুয়া ওয়েবসাইট, ইমেইল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম ইত্যাদি) প্রচার চলে। এরপর সুকৌশলে স্ক্যাম সেন্টারের ভেতরে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে স্ক্যামের কাজ করানো হয়। থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় কাজের কথা বলে প্রতারণার ঘটনা ঘটছে দেখে সরকার এসব দেশে যাওয়ার বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে। নতুন ধরনের এই প্রতারণার বিষয়ে বিদেশগামীসহ সবার মধ্যে সচেতনতা দরকার বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

উল্লেখ্য, থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তের মায়সত শহরের ওপারে মিয়ানমারের ভূখণ্ডে গড়ে উঠেছে ‘স্ক্যাম সেন্টার’। এসব সেন্টারে বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার লোক বন্দীজীবন কাটাচ্ছেন। থাইল্যান্ডের সরকার এসব স্ক্যাম সেন্টারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থা নিয়েছে। মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী ডেমোক্রেটিক কারেন বুদ্ধিস্ট আর্মি বেশিরভাগ স্ক্যাম সেন্টার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এর আগে এসব স্ক্যাম সেন্টার থেকে তিন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০০৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২৫
টিআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।