ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ চৈত্র ১৪৩১, ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

আরাকান আর্মিকে এড়িয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অসম্ভব

তৌহিদুর রহমান, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০২৫
আরাকান আর্মিকে এড়িয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অসম্ভব

ঢাকা: বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এক লাখ ৮০ হাজার জনের তালিকা চূড়ান্ত করেছে মিয়ানমার। এদের ‘প্রত্যাবাসনযোগ্য’ বলছে তারা।

আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গার পরিচয় যাচাই করছে দেশটি। সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে এমন তথ্য জানানো হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে এরইমধ্যে বিভিন্ন মহলে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। প্রশ্ন উঠেছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব কি না। কেননা রাখাইন অঞ্চল এখন মিয়ানমার সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বাংলাদেশঘেঁষা এ রাজ্যটি এখন সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। তাই দেশটির সরকার রাজি হলেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন আদৌ সম্ভব কি না সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আরাকান আর্মি রাজি না থাকলে বা তাদের পাশ কটিয়ে এখনই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়।

থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ২ থেকে ৪ এপ্রিল বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ থান শিউয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে দেওয়া ৮ লাখ রোহিঙ্গার তালিকার মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ‘প্রত্যাবাসনযোগ্য’। এছাড়া আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গার নাম পরিচয় যাচাইয়ের অপেক্ষায় রয়েছে।

এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনযোগ্য বিবেচিত হওয়া বা তাদের ফেরত নিতে চাওয়ার এই পদক্ষেপকে বাংলাদেশ সরকার খুব ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। এটাকে দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের পথে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবেও বিবেচনা করা হচ্ছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। তারা আরাকানের ১৭টি শহরের মধ‍্যে ১৪টি দখলে নিয়েছে। আর বাকি শহরগুলো দখলের জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। রাখাইনের যেসব এলাকায় রোহিঙ্গাদের বসতি, সেগুলো এখন আরাকান আর্মির দখলে। আর আরাকান আর্মি রাখাইন এলাকা দখলের পর গত ৮ মাসে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরাকান আর্মির সম্পর্ক ভালো নয়, সে কারণে মিয়ানমার সরকার চাইলেও আরাকান আর্মিকে এড়িয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্ভব নয় বলেই বিশ্লেষকদের অভিমত।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানে নামলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ৮ লাখ মানুষ। আগে থেকে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাসহ সব মিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয়ে রয়েছে জনগোষ্ঠীটির প্রায় ১২ লাখ লোক। মিয়ানমারের ওই অভিযানকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ আখ্যা দেওয়া হয়।

পরে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়। দুদেশের উচ্চপর্যায়ে সফর বিনিময় ও বৈঠক হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তাদের হাতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের তালিকা দেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে প্রথম দফায় ৮ হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ২০২০ সাল পর্যন্ত আরও পাঁচ ধাপে ৮ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এসব তালিকা ধীর গতিতে যাচাই বাছাই করে চলেছে মিয়ানমার।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশ কোনো সম্পর্ক রাখতে বা আলোচনা করতে আগ্রহী নয়। বাংলাদেশ যে কোনো সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে চায়। স্বাভাবিকভাবেই আরাকান আর্মির সঙ্গেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা করতে চায় না সরকার।

কিন্তু রাখাইন এলাকা যেহেতু আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, সে কারণে রোহিঙ্গা ইস্যু ধীরে ধীরে জটিল আকার ধারণ করছে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম শনিবার (৫ এপ্রিল) তার নিজের ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট দেন। সেখানে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনযোগ্য বলে মিয়ানমার ঘোষণা দিলেও রোহিঙ্গারা আগামী বছরের মধ্যে রাখাইনে ফিরে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন।

শফিকুল আলম বলেন, আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে আগামী বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠাতে পারব। কেননা মিয়ানমারের রাখাইন বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘আরাকান আর্মি’ দখলে নেওয়ায় জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে চাপ সৃষ্টি করে যেতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

অবশ্য মিয়ানমারের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর উদ্যোগকেও অনেক বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। শনিবারই প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ফেসবুকে এক পোস্টে বলেন, প্রথমে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং এক বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ বাঙালি’ হিসেবে অভিহিত করেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথমে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। মিয়ানমার যখন প্রকাশ্যে স্বীকার করে যে ১ লাখ ৮০ হাজার ‘রোহিঙ্গা’ প্রত্যাবর্তনের যোগ্য, তখনই কেবল বৈঠকটি হয়। প্রধান উপদেষ্টার উচ্চ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের দিয়ে রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ বলিয়েছেন, এটি বড় অর্জন।

ডয়েচে ভেলে শনিবারের এক প্রতিবেদন অনুসারে, যে ভেরিফিকেশনের কথা বলা হচ্ছে, তা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে না। তাদের রেসিডেন্সি নিশ্চিত করে। রোহিঙ্গারা নাগরিক হিসেবে ফিরতে চায় তাদের মূল আবাসভূমিতে। কিন্তু মিয়ানমার তাদের রাখতে চায় অন্য জায়গায়। সেজন্য এর আগে একাধিকবার প্রত্যাবাসনের চেষ্টা হলেও তা সফল হয়নি।

ওই প্রতিবেদনে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘তারা চাইলেই আমরা ফেরত পাঠানোর জন্য প্রস্তুত আছি। আর রোহিঙ্গারাও তাদের মাতৃভূমিতে ফিরতে চান। কিন্তু যে কারণে (নিরাপত্তাহীনতা) তাদের চলে আসতে হয়েছে সেই কারণ যদি বর্তমান থাকে তাহলে সেটা কীভাবে সম্ভব। তারা তো চায় নাগরিক হিসেবে আত্মমর্যাদা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিয়ে সেখানে ফিরতে। ’

রোহিঙ্গাদের মনোভাব
গত মার্চে বাংলাদেশ সফরে আসেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেসময় কক্সবাজারে গিয়ে এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করেন। তখন রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফেরার দাবি জানিয়ে বেশ কিছু প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। ওই অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যেতে চান, তাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

গত ২৭ মার্চ যুক্তরাজ্যের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে এক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। যেখানে বলা হয়, একসময় মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গারা এখন পাল্টা লড়াইয়ের জন্য অস্ত্র হাতে নিচ্ছে।

ওই প্রতিবেদনে ২৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ আয়াজ (ছদ্মনাম) নামে এক তরুণের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে তার মতো হাজারো তরুণ এখন ঐক্যবদ্ধ এবং তারা মাতৃভূমি পুনরুদ্ধার করতে চান।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আয়াজের মতো শত শত শরণার্থী এখন সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ঘরবাড়ি ছেড়ে এরা সপ্তাহ-মাস ধরে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। প্রস্তুত হচ্ছেন মিয়ানমারে গিয়ে সেখানকার সামরিক বাহিনী বা প্রতিপক্ষ অন্য কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য।

রাখাইনে আরাকান আর্মির চিন্তাভাবনা কেবল বৌদ্ধ সম্প্রদায় নিয়েই উল্লেখ করে একজন প্রশিক্ষণার্থী বলেন, তারা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আগ্রহী নয়। তারা কেবল বৌদ্ধদের নিয়ে চিন্তা করে। আমাদের মাতৃভূমি ফিরে পাওয়ার মূল লড়াই সামরিক বাহিনীর সঙ্গে, এরপর আরাকান আর্মি বাধা হলে তাদের সঙ্গেও লড়বো।

কৌশলী হতে হবে বাংলাদেশকে
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, আরাকান আর্মির কাছে এলাকা হারিয়ে সামরিক জান্তা নানা কৌশল নিয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি সেখানে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে, যেখানে উদ্ধারকারী দল পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত মিয়ানমার জান্তার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে হঠাৎ এমন ‘আন্তরিকতা’ সরলভাবে দেখার সুযোগ নেই। আরাকান আর্মিকে রুখতে দেশটি বাংলাদেশকে ‘পাশে’ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে এমন অবস্থান নিয়েছে কি না সেটা ভাবতে হবে। তাছাড়া রাখাইনের সিত্তে বা আকিয়াব বন্দরে চীনসহ বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থ জড়িত। বঙ্গোপসাগরঘেঁষা রাজ্যটি ভারতেরও নজরের বাইরে নেই। ফলে এখানে প্রত্যাবাসনসহ যেকোনো সমঝোতায় যেতে বাংলাদেশকে সব পক্ষের বিষয়টি মাথায় রেখে কৌশলী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, এই ধরনের ঘোষণা এর আগেও মিয়ানমারের সরকার দিয়েছে। কিন্তু ফেরত নেওয়াটা একেবারেই অসম্ভব। কেননা রোহিঙ্গারা যে অঞ্চলে যাবে, সেখানে তাদের উপস্থিতি একেবারেই সীমিত। ওখানে আরাকান আর্মি যতদিন রয়েছে, ততদিন এক লাখ ৮০ হাজার নিতে চাওয়া বা তিন লাখ নিতে চাওয়া, এটা পুরোপুরি অর্থহীন। তারা কল্পনাপ্রসূত এসব কথা বলে। ইয়াঙ্গুনের ওপর তাদের যে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, সেটা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যই তারা এই ধারণা দিয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০০০৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৭, ২০২৫
টিআর/এইচএ/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।