ঢাকা, মঙ্গলবার, ৮ বৈশাখ ১৪৩২, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক নাম ব্যবহারে কমবে ওষুধের দাম

রেজাউল করিম রাজা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০২৫
প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক নাম ব্যবহারে কমবে ওষুধের দাম

ঢাকা: প্রেসক্রিপশনে (রোগীর ব্যবস্থাপত্র) জেনেরিক নাম (ওষুধের মূল উপাদানের নাম) ব্যবহার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পন্থা। কিন্তু বাংলাদেশে ওষুধের ব্র্যান্ড নামেই রোগীর ব্যবস্থাপত্র লেখা হয়।

বাংলাদেশের সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে ব্যবস্থাপত্রে জেনেরিক নাম লেখার পক্ষে এবং বিপক্ষ রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত। তবে রোগীর প্রেসক্রিপশনে ওষুধের জেনেরিক নাম ব্যবহার করা হলে ওষুধের দাম তুলনামূলকভাবে কমতে পারে বলে মনে করছেন এ খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

২০১৭ সালে চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্রে জেনেরিক ও বড় অক্ষরে ওষুধের নাম লিখতে সরকারকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। যদিও সেই নির্দেশ এখনও কার্যকর হয়নি।

১৯৮২ সালে ওষুধনীতির আলোকে দেশ এখন ওষুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মাত্র এক থেকে দুই শতাংশ ওষুধ আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশের ওষুধ এখন ১৫০টি দেশে রপ্তানি হয়। দেশে তিন শতাধিক নিবন্ধিত অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ উৎপাদন কোম্পানি রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওষুধের জেনেরিক নাম লেখার কোনো বিকল্প নেই। দেশের নিবন্ধিত চিকিৎসকেরা প্রেসক্রিপশনে কোন কোম্পানির ব্রান্ড নাম লিখতে না পারলে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চিকিৎসক কেন্দ্রীক এগ্রেসিভ মার্কেটিং থেকে সরে আসবে। জেনেরিক নামের সঙ্গে ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে ওষুধ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওষুধ প্রচারের জন্য চিকিৎসক বা অন্য কারও ওপর নির্ভর করতে হবে না এতে ওষুধেরও দাম কমবে।

প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক নাম ব্যবহার করলে রোগী ওষুধের সক্রিয় উপাদান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পায়। এটি ওষুধের অপব্যবহার এবং ভুল ব্যবহার রোধ করবে। ব্র্যান্ড নাম ব্যবহার করলে একই সক্রিয় উপাদানের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে, যা জেনেরিক নাম ব্যবহারের মাধ্যমে এড়ানো যায়।

প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক নাম ব্যবহার করলে চিকিৎসকদের নিরপেক্ষতা বজায় থাকে। কোন একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের প্রতি পক্ষপাতিত্ব কম হয় এবং রোগীদের জন্য তুলনামূলক কম মূল্যে সঠিক ওষুধ নির্বাচনে সাহায্য করে। তবে এসব ক্ষেত্রে দেশের বাজারে সরাবরাহ করা ওষুধের সঠিক গুণগত মান যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।  

জেনেরিক নাম ব্যবহারের প্রতিবন্ধকতা

জাতীয় ওষুধ নীতিতে ওষুধের উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সরবরাহের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ওষুধ নীতিতে, শুধুমাত্র যোগ্যতাসম্পন্ন ফার্মাসিস্টের তত্ত্বাবধানে ওষুধের পাইকারি ও খুচরা বিক্রয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। দেশের অধিকাংশ ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্ট নেই।

একই জেনেরিকের ওষুধ বিভিন্ন কোম্পানি একই মান বজায় রেখে উৎপাদন করছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার কোনো ব্যবস্থা দেশে নেই। একই জেনেরিকের ওষুধ বিভিন্ন কোম্পানির যেন একই মানের হয়, সেটা নিশ্চিত করতে বায়োএকুইভ্যালেন্স (ওষুধ আবিষ্কারের সময় মূল উপাদান যতটুকু ছিল) পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। বিদেশে ওষুধ রপ্তানির সময় কোম্পানিগুলো বায়োএকুইভ্যালেন্স পরীক্ষা করেই পাঠাতে বাধ্য হয়। অথচ দেশের ভেতরে সেই পরীক্ষা ছাড়াই ওষুধ বিক্রি করা হয়।

ব্যবস্থাপত্রে জেনেরিক নাম ব্যবহার করতে হলে যে রকম অবকাঠামো প্রয়োজন, তা আমাদের দেশে নেই। জেনেরিক নাম ব্যবহার করলে ওষুধের দোকানদারের অতি মুনাফার লোভে নাম সর্বস্ব কোম্পানির মানহীন ওষুধ ভোক্তার কাছে চলে যেতে পারে। ফলে রোগী টাকা খরচ করেও ভালো মানের ওষুধ পাবে, সেই নিশ্চয়তা নেই।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক নাম ব্যবহারের প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসাবিজ্ঞানী, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সের (বিইউএইচএস) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, প্রেসক্রিপশনে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখা আইডিয়াল, তবে এটা করার জন্য যে, অবকাঠামো, জনবল, প্রস্তুতি এবং পদ্ধতি প্রয়োজন সেটা আমাদের নেই। এ বিষয়ে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে তারপর জেনেরিক নাম লেখা উচিৎ। নাহলে হিতে-বিপরীত হতে পারে।

ওষুধের জেনেরিক নাম ব্যবহারের সুবিধা অসুবিধা প্রসঙ্গে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, জেনেরিক নাম লেখা হলে রোগী তার ইচ্ছামত কোম্পানির তৈরি করা ওষুধ কিনতে পারবে। ওষুধ কেনার সময় ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। কোনো চিকিৎসক কিংবা ফার্মেসির লোক কোনো কোম্পানির সাথে ওষুধ বিক্রি বাড়ানোর জন্যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না।

অসুবিধা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে তিন শতাধিক কোম্পানি ওষুধ উৎপাদন করে। কোম্পানিগুলোর কাঁচামালের উৎস এক নয়, কেউ ভালো মান সম্পন্ন কাঁচামাল ব্যবহার করে, আবার কেউ নিম্নমানের কাঁচামাল দিয়ে ওষুধ তৈরি করে। আবার উৎপাদন প্রক্রিয়াতেও মান রক্ষার্থে ভিন্নতা রয়েছে। প্যাকেটজাত করার ক্ষেত্রেও ভিন্নতা আছে। ফলে একই জেনেরিকের ওষুধ যে কোম্পানি ভালো মানের কাঁচামাল এবং উৎপাদন প্রক্রিয়াতেও মান রক্ষা করে, তার সাথে যে কোম্পানি নিম্নমানের কাঁচামাল দিয়ে নিম্ন গুণগত মানের ভিতর দিয়ে তৈরি ওষুধের কার্যক্ষমতার ভিন্নতা দেখা যায়। রোগী জানতে পারে না কোন কোম্পানির ওষুধ মানসম্মত। এর ফলে রোগীর প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

যদি প্রত্যেকটি ফার্মেসিতে রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকে এবং যে চিকিৎসক ওষুধ প্রেসক্রাইব করছেন তার সাথে ফার্মেসির অনলাইন যোগাযোগ থাকে তাহলে জেনেরিক নাম লেখাই উত্তম, যদি ফার্মাসিস্ট না থাকে দোকানদার ওষুধ বিক্রি করে তাহলে জেনেরিক নাম ব্যবহার করা বিপদজনক। অর্থাৎ বাংলাদেশের এখনও বস্তুগত অবস্থান তৈরি হয়নি জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লেখার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, উন্নত দেশে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির সংখ্যা খুবই সীমিত এবং সেসব দেশে নির্দিষ্ট ওষুধ উৎপাদনের জন্য লাইসেন্স দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সমস্যা হচ্ছে যে কোনো কোম্পানি যে কোনো ওষুধ বানাতে পারে। বাংলাদেশে তিন শতাধিক ওষুধের কোম্পানি রয়েছে, এছাড়া ওষুধের প্রকারভেদ ৬০ হাজারের বেশি। আমাদের দেশের ফার্মা ইন্ডাস্ট্রি অনেক এগ্রেসিভ। অনেক বেশি কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর মান নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। সিফ্রোফ্লক্সসাসিন ঔষধ ভালো কোম্পানি ১৫/১৬ টাকায় বিক্রি করে। আবার একই ওষুধ কোনো কোনো কোম্পানি বিক্রি করছে সাত টাকা। যে কোম্পানি ৭ টাকায় দিচ্ছে সে কিভাবে দিচ্ছে, এ থেকে বোঝা যায় সেই ওষুধে কোনো না কোনো সমস্যা আছে। এখন আমি জেনেরিক নামে সিফ্রোফ্লক্সসাসিন প্রেসক্রিপশন করি, আর রোগী যদি ফার্মেসির পাল্লায় পড়ে ঐ ওষুধ খায় তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এই কারণে জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন করা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পন্থা হলেও আমাদের মত দেশগুলোতে প্রয়োগ করা যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাব্বির হায়দার বাংলানিউজকে বলেন, প্রেসক্রিপশন এবং ওষুধ বিক্রয়ে জেনেরিক নাম ব্যবহার করলে বেশ সুবিধা পাওয়া যায়। আধুনিক বিশ্বে প্রেসক্রিপশন জেনেরিক নামেই করা হয়। দামের ক্ষেত্রেও কিছু সুবিধা পাওয়া যায়, একটা ব্র্যান্ড প্রমোট করতে হলে সেটাকে রেজিস্ট্রেশন করাতে হয়, সেই ব্র্যান্ডকে মার্কেটে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। অতিরিক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা ও খরচ করতে হয়। এই বিষয়গুলো অনেক বৈধ এবং অবৈধ উপায়েও হয়। এতে অনেক অর্থেরও অপচয় হয়, যা সেই ওষুধের দামের সাথেই যুক্ত হয়। জেনেরিক নাম ব্যবহারে সুবিধা অসুবিধা দুটোই আছে, তবে তুলনামূলক বিবেচনা করলে সুবিধাই বেশি। এ কারণেই পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে প্রেসক্রিপশন জেনেরিক নামে করা হয়।

স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রোগীর ব্যবস্থাপত্রে জেনেরিক নাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলোর দ্রুত সামাধান করে জেনেরিক নামেই প্রেসক্রিপশন লেখা উত্তম। এতে একদিকে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে, অপরদিকে ওষুধের দামও কমে আসবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০২৫
আরকেআর/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।