খুলনা: খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ। এ উপজেলার কৈলাশগঞ্জের চড়া নদী খননে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়নের প্রায় দুই শতাধিক গ্রামবাসী খুলনা জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। অভিযোগ উঠেছে, নদীর অধিকাংশ স্থানে তলদেশে খনন না করে শুধু পাড়ের গাছ কেটে বিল তুলে নেওয়া হচ্ছে। মূলত ঠিকাদার ও এলজিইডির কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই প্রকল্পের টাকা লুটপাট হচ্ছে।
শনিবার (১৯ এপ্রিল) সরেজমিনে চড়া নদী খননের কাজ পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, খালের এক ধারের পিচের রাস্তার অর্ধেক, অপর পাড়ের ইট সোলিং রাস্তার পুরোটাই বন্ধ করে ফেলা হয়েছে মাটি তুলে। যেখানে খননের কাজ করার কথা তা ঠিক মতো হচ্ছে না। ভেকু মেশিনে খালের মাটি কেটে কোথাও পাড়ে আবার কোথাও খালের ভেতরেই ফেলে রাখা হয়েছে। পাড় ভেঙে আবার নদীতে পড়ে যাচ্ছে।
স্থানীয়রা বলেন, এক সময় প্রমত্তা নদী ছিল চড়া। সুন্দরবন থেকে শুরু হয়ে ১৩ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বাজুয়ায় গিয়ে মিলেছিল এই নদী। পরে নদীতে বাঁধ হওয়ায় তা মরে খালে পরিণত হয়। আর এখন ঠিকাদার ও এলজিইডি ইঞ্জিনিয়ার মিলে খননের নামে একে ড্রেন বানানোর ষড়যন্ত্র করছে। কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়নের কৈলাশগঞ্জ গ্রামের পশ্চিমপাড়া ও রামনগর ১ নম্বর ওয়ার্ডের মাঝ দিয়ে চড়া নদী প্রবাহিত। বিগত দিনে আমরা দেখেছি এলজিইডি নামে ঘোলের খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির নামে তৎকালীন আওয়ামী লীগের দুর্নীতিগ্রস্ত অসাধু সদস্য, সদস্য দিয়ে গোপনে কমিটি বানিয়ে খাল খননের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। কাউকে তখন কোনো হিসাব দেওয়া লাগেনি। মাটি কাটার নামে তক্তা, মই দিয়ে হেচা টেনে খাল খনন দেখিয়েছে। খাল খননের নামে নদীর দুই তীরের সব গাছপালা কেটে গোটা এলাকা মরুভূমিতে পরিণত করেছিল। নদীর মাটি নদীতেই পড়ে ছিল। খাল খননের নামে সরকারি কোটি কোটি টাকা লোপাট করে নিয়েছিল। তখন প্রতিবাদ করার মতো কেউ ছিল না। তারপরও যারা ওই সময় প্রতিবাদ করেছিল তাদের এলাকা ছাড়া করা ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
বর্তমানেও সেই প্রকল্পের নামে চড়া নদীর সব পানি শুকিয়ে দুই তীরের কয়েক হাজার একর তরমুজের ভরা মৌসুমে কৃষকের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছে এ সরকারি টাকা লুটতরাজকারী চক্র। ঘোলের খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির নিয়ম অনুযায়ী ওই সমিতির ১০টি গ্রুপের অর্থাৎ চড়া নদীর দুই তীরবর্তী গরিব, অসহায় দরিদ্র মানুষদের দিয়ে খাল খনন করে তাদের কায়িক শ্রমের মূল্য হিসেবে সুবিধা দেওয়ার কথা থাকলেও দুই তীরের তথা সমিতির কোনো সদস্য ছাড়াই মুষ্টিমেয় কয়েকজন কুচক্রী মহল অতিগোপনে সরকারি টাকা পুনরায় লোপাট করার উদ্দেশে তারা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মাটি কাটার ভেকু মেশিন দিয়ে খাল খননের নামে প্রহসন শুরু করেছে। সেই আগের মতো তারা নদীর দুই তীরের অগণিত গাছ কেটে সরকারি রাস্তা কেটে তাণ্ডব চালাচ্ছে। ভেকু মেশিন দ্বারা পলি মাটি কেটে নদীতেই রেখে দেওয়া হচ্ছে। আমরা গ্রামের স্থানীয় মানুষ তাদের এ কু-কর্মের প্রতিবাদ করলে আমাদের কোনো কথায় কর্ণপাত না করে তারা তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত এ কাজ বন্ধ না করতে পারলে আমরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবো। আমরা চাই নদীর দুই তীরের সর্বসাধারণের মতামতের ভিত্তিতে সমিতির সব সদস্যের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সঠিক ও স্বচ্ছতার সঙ্গে খাল খনন হোক।
যেখানকার মাটি সেখানেই
চড়া নদী খনন না করেই অর্থ লোপাট করা হচ্ছে। যেখানকার মাটি রয়েছে সেখানেই। খনন হচ্ছে না নদী। বালু ও পলি কেটে রাস্তার ওপর রাখা হচ্ছে, যা আবার ভেঙে নদীতেই চলে যাচ্ছে। রাস্তা থেকে মাটি এলাকার লোকজন কেউ কেউ বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের কব্জায় নদী খনন প্রকল্প
২০১৫ সালে গঠিত হরিণটানা ঘোলেরখাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেডের নামে আওয়ামী লীগের হরিলুট করা পকেট কমিটি। এই কমিটির সভাপতি তপন কুমার মন্ডল, তিনি কৈলাশগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে রয়েছেন ও সাধারণ সম্পাদক শংকর পাইক, তিনি ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন। উভয়ের ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন সবাইকে এই কমিটিতে রাখা হয়েছে। এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী বর্তমানে পলাতক চেয়ারম্যানের অনুসারী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয়ে থাকে এলাকাবাসী। তারপর ইউনিয়নের জনসাধারণ ঐক্যবদ্ধভাবে অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন জমা দেন। কিন্তু সরেজমিনে এলাকাবাসী দাকোপ উপজেলা ইঞ্জিনিয়ারিং এর তৎপরতা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের প্রতিষ্ঠায় মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করার মাধ্যমে ছলচাতুরি করে যাচ্ছেন।
জনসাধারণ উল্লেখ করে বলেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা গাঢাকা কিংবা পালিয়ে গেলেও, তার দোসররা প্রতিটি সেক্টরে আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। তার বাস্তব উদাহরণ হলো এই নদী খনন, যেখানে টাকা দিয়ে খননের নামে নদী ভরাট করা হচ্ছে। যার সব কিছুই দৃশ্যমান।
গাছ কেটে সাবাড়
চড়া নদী বাঁচানোর নামে ইতিমধ্যে তিন শতাধিক গাছ কেটে সাবাড় করেছে ঠিকাদার। এসব গাছ বহু বছর ধরে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ছোট-বড় দুর্যোগে প্রাচীর হিসেবে লোকালয়কে রক্ষা করে আসছে। সেসব গাছ কেটে উপকূলের মানুষকে বড় ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পরিবেশবাদী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের।
খাল সংলগ্ন ১ নং ওয়ার্ডের মেম্বার ফয়সাল আলম, ৩ নং ওয়ার্ডের অমিত মন্ডল, ৬ নং ওয়ার্ডের প্রবীর মন্ডল, ৭ নং ওয়ার্ডের তপন সরকার, ৮ নং ওয়ার্ডের সুখেন্দু রপ্তান, ৯ নং ওয়ার্ডের মেম্বার স্বপন মন্ডল অভিযোগ করেন, ঈদের আগে হঠাৎ একদিন ভেকু মেশিন এনে কাজ শুরু করেন ঠিকাদার। হরিণটানা ঘোলের খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেড কাজটি পেয়েছে। কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় উপজেলা প্রকৌশলী তাদেরকে কাজ দিলেন, কত টাকার কাজ, কত দিনে সম্পন্ন হবে, কীভাবে কাজ হবে সে সম্পর্কে আমরা কেউই অবগত না। ভেকু মেশিনে খালের মাটি কেটে কোথাও পাড়ে আবার কোথাও খালের ভেতরেই ফেলে রাখা হয়েছে। পাহাড় সমান মাটির স্তূপের নিচে ঢাকা পড়েছে কৈলাশগঞ্জ পশ্চিম পাড়া পিচের রাস্তার প্রায় অর্ধেক, আর ১ নং ওয়ার্ড দশ ঘরের ইট সোলিং রাস্তা পুরোটাই। খালের তলদেশ চার ফুট করে খনন করার কথা থাকলেও এক থেকে দেড় ফুটের বেশি খোঁড়া হচ্ছে না কোথাও। সবচেয়ে বড় অভিযোগ, খালের পাড়ের অন্তত তিন শতাধিক নানা প্রজাতির গাছ ইতিমধ্যে কেটে বা ভেকু মেশিন দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছে। কিছু গাছ মাটিচাপা পড়ে মৃতপ্রায়।
বাজুয়া এস এন ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক প্রলয় মজুমদার অভিযোগ করেন, আগে খালের দুই পাড় সবুজে ছাওয়া ছিল। এখন মরুভূমি হয়ে গেছে। তিনশ’র বেশি গাছ মারা পড়েছে। যার মধ্যে গেওয়া, শিরিস, বাবলা, সজনে, নিম, বরই, কলা, পেঁপে আছে। গাছের ক্ষতি করতে নিষেধ করা হলেও তারা কারো কথা কানে তুলছে না।
রামনগর গ্রামের কৃষক রামমোহন মন্ডল অভিযোগ করেন, তরমুজের জন্য বিখ্যাত এই অঞ্চলের সব কৃষক চাষের জন্য খালের পানি ব্যবহার করতাম। হঠাৎ একদিন আমাদের বলা হলো, যার যার পানি লাগবে নিয়ে নাও। আমরা খাল শুকায়ে মাটি কাটবো। এরপর ডিপের পানি কিনে চাষ করতে গিয়ে খরচ বেড়ে গেল।
হরিণটানা ঘোলের খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক শংকর পাইক দাবি করেন, তরমুজ চাষিদের স্বার্থে পানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে খাল খনন প্রকল্প নিয়েছে এলজিইডি। এর আগে আরও তিনটি খাল খননের অভিজ্ঞতা থাকায় আমরা কাজ পেয়েছি। ৮২ লাখ টাকা বাজেটের এই কাজের মেয়াদ তিন মাস। আমাদের হাতে এখনও ২৬ দিন সময় আছে। খালের পাঁচ কিলোমিটার অংশ খনন করতে হবে। আবহাওয়া ভালো থাকলে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারবো। ভেকু মেশিনে ৭০ ভাগ কাজ হবে, ৩০ ভাগ কাজ হবে সমিতির সদস্যদের মাধ্যমে। কাজ করতে গিয়ে কিছু গাছ কাটা পড়েছে বলে স্বীকার করেন তিনি। আর খালের মাটি ফেলার কারণে পিচের রাস্তা ও ইট সোলিং রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলেও তারা দ্রুত সব মাটি সরিয়ে ফেলবেন।
এ বিষয়ে দাকোপ উপজেলা প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এসএমএস দেওয়া হলেও সাড়া দেননি।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুল ইসলাম সরদার বাংলানিউজকে বলেন, চড়া নদী খননের কাজ চলমান রয়েছে। কাজ শেষ হলে আমরা দেখবো নকশার সাথে ঠিক আছে কি না। আমরা মাঝে মধ্যে যাবো আর যদি কোনো নির্দেশনা থাকে তবে দিয়ে আসবো।
বাংলাদেশ সময়: ০১৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০২৫
এমআরএম/এজে