ঢাকা, শনিবার, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৭ জুন ২০২৫, ১০ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

এক মাসের মধ্যে সম্ভব যেসব সংস্কার

তানভীর আহমেদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:০১, জুন ৩, ২০২৫
এক মাসের মধ্যে সম্ভব যেসব সংস্কার

ঢাকা: এক মাসের মধ্যেই অনেকগুলো সংস্কার বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপির এ নেতা বলেন, সংবিধান ছাড়া অন্য যেসব সংস্কার আছে, সেগুলো নির্বাহী আদেশে বা অর্ডিন্যান্সের (অধ্যাদেশ) মাধ্যমে এক মাসের মধ্যেই বাস্তবায়ন সম্ভব।

এরপর থেকেই মূলত রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা শুরু হয়েছে। সবারই কৌতুহল, কোন কোন সংস্কারের বিষয়ে বিএনপি একমত হয়েছে আর এক মাসের মধ্যেই বাস্তবায়ন সম্ভব কোন সংস্কারগুলো।  

অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত্য থাকলে এক মাসের মধ্যেই বেশ কিছু সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব। তাদের মতে, সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে এমন বিষয় ছাড়া প্রশাসনিক, বিচার বিভাগীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক, স্থানীয় সরকার ও রাজনৈতিক সংস্কারগুলো অল্প সময়েই বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

জুলাই বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করলে দেশজুড়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এই সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকার একাধিক পৃথক সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সম্ভাব্য সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করে এবং তা দলের কাছে তুলে ধরে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলই এই প্রস্তাবগুলোর ওপর মতামত দিয়েছে।  

বিএনপি বলছে, সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিভিন্ন দলের দেওয়া প্রস্তাবগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় যেভাবে আন্তরিকতা দেখা গেছে, তাতে বিএনপির বিশ্বাস— আগামী এক মাসের মধ্যেই একটি মৌলিক ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব। সব বিষয়ে শতভাগ একমত হওয়া বাস্তবসম্মত নয়, কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য থাকবেই। তবে যেসব বিষয়ে একমত হওয়া যাবে, সেগুলো পরবর্তী সংসদে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। এখন শুধু ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সনদে স্বাক্ষর হলেই যথেষ্ট— এই প্রতিশ্রুতি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও যুক্ত থাকবে এবং একে একটি আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকার হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

চলমান সংস্কার আলোচনার প্রধান বিষয়সমূহের মধ্যে রয়েছে— সংবিধান ও রাজনৈতিক সংস্কার; প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় সংস্কার; অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতের সংস্কার; স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কার ও নির্বাচন ও রাজনৈতিক দল সংক্রান্ত সংস্কার।  

এসব সংস্কারের মধ্যেও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব। যেমন, সংবিধান ও রাজনৈতিক সংস্কারে রয়েছে— ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন: সংসদ সদস্যদের দলীয় নির্দেশনা অমান্য করলে তাদের আসন শূন্য হওয়ার বিধান পরিবর্তনের প্রস্তাব; সংসদীয় স্থায়ী কমিটির গঠন ও কার্যকারিতা: কমিটিগুলোর কার্যক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি; নারী আসনের সরাসরি নির্বাচন: সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনগুলোতে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন; তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃ প্রতিষ্ঠা: নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের প্রস্তাব। সাংবিধানিক এসব সংস্কারের জন্য বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পার্লামেন্টের ওপর ন্যস্ত করতে চাচ্ছে।  

প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় সংস্কারের মধ্যে রয়েছে— পুলিশ ও প্রশাসনের সংস্কার: দুর্নীতি দমন, নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ এবং জবাবদিহিতা বৃদ্ধি; বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: বিচার বিভাগের কার্যক্রমে নির্বাহী হস্তক্ষেপ কমানো এবং বিচারকদের নিয়োগে স্বচ্ছতা; দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি: দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতের সংস্কারে রয়েছে— শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধি: জিডিপির ৬-৭ শতাংশ পর্যন্ত শিক্ষা খাতে বরাদ্দের দাবি; শ্রমিকদের অধিকার ও কর্মসংস্থান: বকেয়া মজুরি পরিশোধ, শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি; জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি: বিদেশি নির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় উৎপাদন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার।   

স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কারে রয়েছে— প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস: বাংলাদেশকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করার প্রস্তাব; জেলা পরিষদ বিলুপ্তি: জেলা পরিষদ বাতিল করে বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া জোরদার করা।   

এছাড়া নির্বাচন ও রাজনৈতিক দল সংক্রান্ত সংস্কারে রয়েছে- সংস্কার প্রক্রিয়ার সফল বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য; প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; নির্বাচনের নির্ধারিত সময়ে আয়োজন ও সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।  

ঐক্যমত্য কমিশনের সূত্রে জানা গেছে, দলগুলোর দেওয়া প্রস্তাবগুলোর আলোচনায় কিছু বিষয়ে ইতোমধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, কিছু বিষয়ে এখনও মতভেদ রয়ে গেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে দলগুলো কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে।

এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করছে, সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তাদের মতে, দেশের বর্তমান অস্থিরতা নিরসনের একমাত্র উপায় হলো একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া।  

নির্বাচনমুখী যেসব সংস্কার প্রয়োজন, রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলে তার বেশিরভাগই এক মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, সংবিধান পরিবর্তনের বাইরে যেসব সংস্কার আছে, সেগুলো নির্বাহী আদেশ বা অধ্যাদেশের (অর্ডিন্যান্স) মাধ্যমে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য। জরুরি সংস্কারগুলো আগে থেকেই চিহ্নিত করা থাকায়, ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে এক মাসের মধ্যেই তা কার্যকর করা সম্ভব।

তাই নির্বাচন ডিসেম্বরের পরে নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই সম্ভব। এ বিষয়ে সরকারকে আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি এবং আবারও বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আমরা যেটা প্রস্তাবনা করেছি, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সেটিকে সমর্থন করেছে। প্রায় সব দলেরই ডিসেম্বরের আগে নির্বাচনের প্রস্তাবনা আছে।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বাংলানিউজকে বলেন, ঐক্যমত্য কমিশন জানিয়েছে ঈদের পরপরই যেসব বিষয়ে সব দলের ঐকমত্য হয়েছে, তার তালিকা প্রকাশ করা হবে। ফলে আপাতত সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে না এমন সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন শুরু করা সম্ভব। আইন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, আইন মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে কয়েকটি সংস্কার বাস্তবায়ন করেছে। অন্য মন্ত্রণালয়েরও এখন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহ-সভাপতি রাশেদ প্রধান বাংলানিউজকে বলেন, ছয়টি সংস্কার কমিশন তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সব রাজনৈতিক দল পুলিশ সংস্কার কমিশনের বাইরে বাকি পাঁচটি কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে মতামত দিয়েছে। ঐকমত্য কমিশন এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা শেষ করেছে। এখন সময় বাস্তবায়নের। সদিচ্ছা থাকলে এক মাসেই সব সংস্কার সম্ভব। তবে শুধু কমিশনের সুপারিশ নয়, জনগণের কিছু মৌলিক চাহিদাও আছে— যেমন গণহত্যার বিচার এবং প্রশাসনের ভেতরে থাকা আওয়ামী প্রেতাত্মাদের অপসারণ। অন্তর্বর্তী সরকারের এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। তারা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে এবং দ্বিতীয় দফার সংলাপ শুরু করেছে। আমরা বিশ্বাস করি, খুব শিগগিরই তারা যৌক্তিক ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছাবে এবং জুলাই সনদ প্রণয়ন করবে। এরপর ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং দেশ একটি গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরবে।  

টিএ/এমজে/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।