ঢাকা, শুক্রবার, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৬ জুন ২০২৫, ০৯ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

তলানিতে পুঁজিবাজার, ৯ মাসে আসেনি একটিও আইপিও

এস এম এ কালাম, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:১৮, জুন ৪, ২০২৫
তলানিতে পুঁজিবাজার, ৯ মাসে আসেনি একটিও আইপিও

ঢাকা: গত ৫ আগস্টের পর দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সরকারের সঙ্গে পরিবর্তন আসে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি)। খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন ১৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর কারসাজি রোধে তৎপর হলেও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে।

নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর নানা অনিয়মে হাজার কোটি টাকা জরিমানা করলেও বাজারে বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। প্রতিদিনই লেনদেন তলানিতে যাচ্ছে। পুঁজিবাজার মূলধন সংগ্রহের জন্য হলেও নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর গত নয় মাসে একটিও আইপিও বাজারে আসেনি, যা বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্টদের হতাশ করেছে। বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হলে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তি এখন সময়ে দাবি বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
 
ডিএসই সূত্রে জানা যায়, নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার দিন অর্থাৎ ১৮ আগস্ট ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৭৭৮ পয়েন্টে অবস্থান করছিল। সর্বশেষ বুধবার (০৪ জুন) লেনদেন শেষে এই সূচক দাঁড়িয়েছে ৪৭০৯ পয়েন্টে অর্থাৎ খন্দকার রাশেদ মাকসুদ দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ১০৬৯ পয়েন্ট, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা সংকট বাড়াচ্ছে।

শুধু তাই নয়, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর গত নয় মাসে একটা ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হওয়া বা কোম্পানিকে আনার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান না হওয়াও বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তার কারণ।  

বিনিয়োগকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত পরিষদের সভাপতি আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম বলেন, নয় মাসে একটা ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি পুঁজিবাজারে না আসা বা আনার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান না হওয়া হতাশাজনক। কারণ বিগত ১৫ বছরে দুয়েকটি স্টক ছাড়া সব দুর্বল কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনা হয়েছিল। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিনিয়োগকারীর প্রত্যাশা ছিল, সার্বিক দিক বিবেচনা করে কমিশন দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।
 
তিনি আরো বলেন, দেশসেরা কোম্পানি ও মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি যারা এই দেশে বিনিয়োগ করে শত শত কোটি টাকা দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে পুঁজিবাজার আনার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এতে করে ভালো শেয়ার ও তারল্যের যোগান বাড়বে।  

এক বছরের মধ্যে আইপিও না আসা দুঃখজনক। তবে বিগত সময়ে বিশেষ মহলের স্বার্থ হাসিলের জন্য আইপিও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পেয়েছি, ওই কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার কিছুদিন পর থেকে অফার প্রাইসের (প্রস্তাবিত মূল্য) নিচে চলে গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি কোম্পানি ওটিসিতে চলে গেছে, যা বাাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে মনে করেন ক্যাপিটাল মার্কেট জানালিস্ট ফোরামের সভাপতি এস এম গোলাম সামদানী ভূঁইয়া।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান কমিশনের দায়িত্ব নেওয়ার পর গত নয় মাসে একটিও আইপিও আসেনি। শুধু তাই নয়, আগের কমিশন বিদায় নেওয়ার আগেও প্রায় ছয় মাস ধরে কোনো আইপিও ছিল না। এটা বাজারের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা।
 
এদিকে ডিএসইর এক পরিচালক বলেন, গণঅভ‍্যুত্থান পরবর্তী নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) জরিমানা করা ছাড়া আর কোনো উন্নতি দেখাতে পারেনি। সত‍্যিকার অর্থে বিএসইসিতে কোনো কাজ হচ্ছে না। বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। বড় পুঁজির বিনিয়োগ না হলে কখনই পুঁজিবাজার রান করবে না। বিএসইসিতে গত নয় মাসে কোনো আইপিও পেন্ডিং নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা নেই। এই বাজারে পণ‍্য সরবরাহ খুবই বাজে বলে মনে করেন তারা।
 
তিনি আরো বলেন, ক্যাপিটাল মার্কেটে দৈন্যদশা চলছে। ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী কমে ১২ লাখে নেমেছে। সক্রিয় বিও অ্যাকাউন্ট ৫ লাখও নেই। অনেকে বলেন, বাজারে ভলিউম বাড়ে না ভালো কোম্পানি না থাকলে ভলিউম বাড়বে না। গত ১০ বছরে গ্রোথ কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসেনি। যে আইপিওগুলো এসেছে সবই দুর্বল কোম্পানির। আজ বাজারে টার্নওভার নেই, ভলিউম নেই, সব জায়গায় রিফর্ম দরকার। তবে সবার আগে বাজারে টার্নওভার লাগবে। ৩০০-৪০০ কোটি টাকা টার্নওভারে বাজার ঘুরপাক খাচ্ছে। এটা দিয়ে বাজার চলবে না।
 
বাজারে আইপিও আসা অবশ্যই দরকার বলে মনে করেন পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন।

তিনি বলেন, আইপিও লাইনটাকে আপনি যখন আগে থেকে সংশোধন করবেন, আইপিও যখন আসবে, তখন আইপিও নিয়ে কথা বলবেন। যে আইপিও যথাযথ নিয়মে আসছে না তাকে নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। আইপিও নিয়মের মধ্যে আনতে গেলে সেই নিয়মগুলো কমপ্লায়েন্সের প্যানেল করা, অডিটরদের প্যানেল তৈরি করা দরকার। বাংলাদেশে যে কোনো সিদ্ধান্ত হয় ‘অন দ্য বেসিস অব ফাইনান্সিয়াল স্টেটমেন্ট’ (আর্থিক বিবরণীর ভিত্তিতে)। তো ফাইনান্সিয়াল স্টেটমেন্টের মান উন্নয়ন না করে আপনি হুট করে যদি একটা আইপিও টার্গেট করে নিয়ে আসেন তাহলে তো হলো না, বাজারে আইপিও আসা অবশ্যই দরকার, যেহেতু পুঁজির সন্ধান দেবে পুঁজির জন্য এই বাজার। কিন্তু যেটার ওপরে বেজ করে আপনি এটা আনবেন, সেই ফাইনান্সিয়াল স্টেটমেন্ট, সেই প্রসপেক্টাসের কমিটমেন্ট (প্রস্তাবিত কর্মপন্থার প্রতিশ্রুতি) সেগুলোতে যে সংস্কার নিয়ে আসা হয়েছে, এটা বাস্তবায়িত হলে বাজে কোম্পানি বাজারে আসতে পারবে না।

তবে আইপিও আইন সংশোধন করা হচ্ছে। এই সংস্কার কার্যকর হলে ভালো আইপিও বাজারে আসবে বলে মনে করেন বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম।

তিনি বলেন, আইপিও বিষয়টা হচ্ছে এখানে ইস্যু, আর কোম্পানি যারা তাদের টাকার প্রয়োজন হলে মার্কেটে আসে। যেমন ইস্যু ম্যানেজার যারা তাদের সঙ্গে চুক্তি করে বিএসইসির কাছে চলে আসে। এই মুহূর্তে পাবলিকের রুলস অনুযায়ী আইপিও বিএসসিতে অপেক্ষমান নেই। এখন প্রশ্ন হলো, আইপিও না এলে হয়তো বিনিয়োগকারীদের কাছে নতুন প্রডাক্ট বা নতুন শেয়ারের ঘাটতি হয়, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আইপিওতে কোম্পানিগুলো আসে কি জন্য? একটা ভালো প্রাইস পাওয়ার আশায়। কারণ তার অনেক দিনের একটা কোম্পানি এখানে দিতে গেলে দাম পেতে হবে। মার্কেটটা নিচের দিকে থাকলে ইন্টারন্যাশনাল প্র্যাকটিস অনুযায়ী এই সময় মানুষ আইপিওতে আসতে চায় না, কারণ সে ভালো দাম পাবে না। তারপরও পাবলিক ইস্যু নিয়মে কিছু সমস্যা রয়েছে, যেটা ভালো আইপিও আসার ক্ষেত্রে বাধা বলে মনে করা হচ্ছে। এ কারণেই কিন্তু বিএসইসি যে টাস্কফোর্স তৈরি করে দিয়েছে, সেই টাস্কফোর্স এটাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিকভাবে একটা রিকমেন্ডেশন (প্রস্তাবনা) দিয়েছে, সেই প্রস্তাবনার বিষয়ে আমরা মতামত দিয়েছি, সেটা টাস্কফোর্সের কাছেও দিয়ে দেব। এটা আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যতটুকু সম্ভব আইপিও রুলসটাও সংশোধন করা হবে। এই সংস্কারটা করলে কমিশন আশা করে ভালো আইপিও আসবে। শুধু এই সময় বলে নয়, এটা অনেক দিন ধরে, বিগত ১৪-১৫ বছর ধরে দুই একটা ছাড়া ভালো কোনো আইপিও বাজারে আসেনি। সুতরাং কমিশন এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। ভালো আইপিও বাজারে আনার জন্যই আইপিও রুলসের সংস্কার হচ্ছে।  

এসএমএকে/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।