ঢাকা: সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও কোরবানির চামড়ার বাজারে ধস ঠেকানো যায়নি। আড়তগুলোয় চামড়া বিক্রি করতে এসে এবারও ন্যায্য দাম পাননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
সরকারের ঘোষণার পরও কেন এমন হলো, এ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। মৌসুমি ব্যবসায়ী, ফড়িয়া ও আড়তদাররা একে অন্যের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। কেউ কেউ সরকারের উদ্যোগেরও সমালোচনা করে বলছেন, সরকার শুধু লবণযুক্ত চামড়ার দাম ঘোষণা করেছে। সে কারণে লবণ ছাড়া কাঁচা চামড়ার দাম একেক জায়গায় একেকরকম হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ঘোষণা দিলেই হবে না, সরকার সময়মতো উদ্যোগের বাস্তবায়ন না করলে চামড়ার বাজার আগের রূপে ফিরবে না।
কাঁচা চামড়ার মূল্য ঘোষণা না করা, বিদেশি বিনিয়োগ আসার সুযোগ না থাকা, সময়মতো রপ্তানির ঘোষণা না দেওয়া, স্থানীয় পর্যায়ে যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকা এবং প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চামড়া রপ্তানির ঘোষণা অন্তত এক মাস আগে দিতে হবে, বাজার উন্মুক্ত করা, সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা বাড়ানো এবং স্থানীয় পর্যায়ে সংরক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার ও কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে।
সরকারের নজরদারির পরও যথাযথ সংরক্ষণ, পরিবহন এবং তীব্র গরমে এবারও ১৫-২০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়েছে। ফলে এক কোটি পিস চামড়া সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ৮০ থেকে ৮৫ লাখ পিস সংগ্রহ হবে বলে জানিয়েছেন বিটিএ।
মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ফড়িয়াদের কাছে জিম্মি হয়ে কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। অন্যদিকে আড়তদারেরা বলেছেন, কাঁচা চামড়ার নির্ধারিত কোনো দাম নেই। অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী না জেনে মানহীন চামড়া কিনেছেন ফলে তারা কাঙ্ক্ষিত দাম পাননি।
ঈদুল আজহার আগে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছিলো, এবার চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে। এ লক্ষ্যে চামড়ার দামও গত বছরের তুলনায় প্রতি বর্গফুটে ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে সারা দেশের মসজিদ- মাদ্রাসাগুলোতে বিনামূল্যে ৩০ হাজার টন লবণ বিতরণ করা হয়েছে। কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বর্তমান সরকার। বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখেই অভ্যন্তরীণ বাজারের কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বেঁধে দেওয়া দামে কেনাবেচা হলে কোনো ধরনের লোকসানের আশঙ্কা থাকবে না। আর প্রতিবছর মৌসুমি ব্যবসায়ীদের লোকসানের মুখে ফেলে দেয় চামড়ার বাজারের সিন্ডিকেট। এজন্য সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে কাঁচা চামড়া তিন মাসের জন্য সরাসরি রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া নির্ধারিত দামের বাইরে যারা চামড়া কেনাবেচা করবে কিংবা যারা জাতীয় এই সম্পদ বিনষ্টে কাজ করবে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। এ লক্ষ্যে দেশের সকল জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের আগে-ভাগে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কাঁচা চামড়া তাড়াহুড়ো বিক্রি না করে কিছুদিন যাতে সংরক্ষণ করা যায় সেজন্য লবণের সরবরাহ বাড়ানো হয়। বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে প্রায় আরও ১ লাখ টন লবণ সারা দেশে দেওয়া হয়।
এবার প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ঢাকায় ৬০-৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫-৬০ টাকা। ঢাকার বাইরের প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। খাসির লবণযুক্ত চামড়া প্রতি বর্গফুট ২২-২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এছাড়া ঢাকায় লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার সর্বনিম্ন দাম ১৩৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন ১১৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ঢাকায় মাঝারি আকারের গরুর ২৫ বর্গফুটের একটি লবণযুক্ত চামড়ার দাম হওয়ার কথা ১৫০০ থেকে ১৬২৫ টাকা।
এ বিষয়ে লালবাগের পোস্তা আড়ত ঘুরে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামেই বিক্রি হচ্ছে কোরবানির পশুর চামড়া। কিছু মৌসুমী ব্যবসায়ী যাদের চামড়া সংরক্ষণের ব্যাপারে কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তারা চামড়া নিয়ে আধাপচা করে ফেলছে। আধাপঁচা চামড়া সাতশ আটশ টাকা বিক্রি হলে তো এটা অনেক বেশি। আর যেটা ভালো চামড়া তা বারো থেকে তেরোশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে দেশের চামড়া শিল্পে বিগত ১৫ বছরে ব্যাপক নৈরাজ্য হয়েছে এবং এর ফলে শিল্পটির চরম অধঃপতন হয়েছে। এ খাতে যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, তা নির্মূলে সরকার কাজ করছে।
এ বিষয়ে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেছেন, গত ১০ বছরের মধ্যে কাঁচা চামড়ার সর্বোচ্চ দাম পেয়েছেন এবারের ব্যবসায়ীরা। তবে চামড়ায় দেরিতে লবণ দেওয়ার কারণে এবার কোরবানির পশুর চামড়ায় কাঙ্ক্ষিত দাম অনেকেই পাননি। কোনোভাবেই যাতে চামড়া না পচে বা দাম পড়ে না যায়, সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত লবণ সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও অনভিজ্ঞতার কারণে কিছু চামড়া নষ্ট হয়েছে, যদিও এর পরিমাণ কম। যাদের চামড়া নষ্ট হয়েছে এবং মান কমে গেছে, তারা দাম কম পেয়েছেন।
তিনি বলেন, চামড়ায় লবণ দেওয়ার একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। অনেকেই দেরিতে লবণ দিয়েছেন, যার প্রভাব চামড়ার মানে পড়েছে। ফলে দামও কমেছে অনেক ক্ষেত্রে। তবে সরকারের তৎপরতার কারণে এ বছর কম চামড়াই নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া গবাদি পশুর ল্যাম্পি স্কিন রোগের কারণে চলতি বছর ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে। সাভার চামড়া শিল্পনগরী এ পর্যন্ত ৩ লাখ ৭৮ হাজার পিস চামড়া এসেছে আর ঢাকায় আছে সাড়ে ৭ লাখ পিস চামড়া।
গত কয়েকদিন রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকাসহ চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে, সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বিক্রি করতে পারেননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। অধিকাংশ স্থানে সংগ্রহকারীরা সরকার নির্ধারিত মূল্যের দিকে লক্ষ্য না রেখে মনগড়া দামে চামড়া কিনেছেন। কোথাও কোথাও প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ২০-২৫ টাকা, আবার কোথাও ১০-১৫ টাকায় কেনা হয়েছে। ঈদের দিন লবণ ছাড়া ছোট, বড় ও মাঝারি গরুর কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে ৫০০ থেকে ৮৫০ টাকায়। তবে ঢাকার বাইরে দাম ছিল আরও কম, ২০০ থেকে ৬৫০ টাকায় চামড়া বিক্রি হয়েছে। ঢাকায় ছাগলের চামড়া প্রতি পিস ৫-১০ টাকায় বিক্রি হলেও ঢাকার বাইরে অনেক জায়গায় বিক্রি তো দূরের কথা, চামড়া সংগ্রহ না হওয়ায় মানুষ তা রাস্তার পাশে ফেলে দিয়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলানিউজকে বলেন, কাঁচা চামড়া রপ্তানির ঘোষণা ও লবণ বিতরণ ছাড়া সরকারের বাকি পদক্ষেপগুলো গতানুগতিক, অসম্পূর্ণ ও বিক্ষিপ্ত।
তিনি বলেন, লবণযুক্ত চামড়ার মূল্য ঘোষণা করা হয়েছে, কাঁচা চামড়ার নয়। কিন্তু কোরবানির সময় ও পরের দুই তিন দিন মূলত কাঁচা চামড়াই মাঠ পর্যায় থেকে আড়ত পর্যায়ে লেনদেন হয়। এজন্য সরকারের উচিত হবে আগামীতে কাঁচা চামড়ার মূল্য ঘোষণা করা। কেননা লবণযুক্ত চামড়ার দোহাই দিয়ে কাঁচা চামড়ার দাম কম দেওয়া হয়।
সরকার লবণযুক্ত চামড়া রপ্তানির ঘোষণা দিলেও বিভিন্ন পক্ষ থেকে আপত্তি জানিয়ে আন্দোলনের হুমকি দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।
চামড়ার বাজার সুস্থির করতে ও সঠিক মূল্য নিশ্চিত করতে রপ্তানির বিকল্প নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, আগামীতে সরকারের ঘোষণা এক মাস আগেই আসতে হবে। সারা দেশে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, কাঁচা চামড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে শুধু দেশীয় লাইসেন্সধারী নয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও সুযোগ দিতে হবে। যদি বিনিয়োগকারী আসে বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়, তাহলে ব্যাংকগুলো অর্থলগ্নি করতে উৎসাহিত হবে। এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে। ফলে চামড়ার মূল্য ইতিবাচকধারায় ফিরবে। এখনকার চেয়ে চামড়ার দাম বেশি পাওয়া যাবে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ূন কবীর ভূঁইয়া বলেন, প্রতি বছর একই অভিযোগ। অথচ কার্যকর কোনো সমাধান আসছে না। চামড়ার বাজার কারসাজিতে সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চামড়া শিল্পে কাঁচামালের সরবরাহ ও মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হন। অনেক ব্যবসায়ী দাম না পেয়ে কম মূল্যে বা বাকি দিয়ে চামড়া বিক্রি করেন। সর্বোপরি কোরবানির চামড়ার যে হকদার গরিব-দুঃখী মানুষ, তারা বেশি বঞ্চিত হন।
সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে সংরক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার ও বিকল্প মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে। সরকারি মনিটরিং ও প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতা বাড়াতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন, চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সমন্বয় জরুরি। চামড়া সংরক্ষণের জন্য অস্থায়ী সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। চামড়া সংগ্রহে ডিজিটাল পেমেন্ট বা সরাসরি কৃষক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করা যেতে পারে।
হতাশ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা:
সরকার নির্ধারণ করে দিলেও কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে হতাশ ঢাকা, গাজীপুর, ফেনী, দিনাজপুর, নীলফামারী, খুলনা, ভোলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া থেকে রতন প্রামানিক ৪০টির মতো লবণযুক্ত চামড়া নিয়ে পোস্তায় এসেছেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি শুধু ঈদের মৌসুমে চামড়ার ব্যবসা করি। গতকাল ছোট বড় মিলিয়ে ৪০টির মতো চামড়া কিনেছি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দরে। এরপর রাতে লবণ দিয়েছি। আজকে সেই চামড়া পোস্তায় নিয়ে আসছি। কিন্তু দাম কয় না। ছোট বড় গড়ে ৫০০ টাকা বলে। সর্বশেষ ৬০০ বলেছে। সরকার আবার বলে নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে। চামড়াপ্রতি আমার যে খরচ হয়েছে, তাতে এক হাজার টাকার নিচে বিক্রি করলে লোকসান হবে।
গাজীপুরের চামড়া ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বিভিন্ন স্থান থেকে চামড়া সংগ্রহ করে বড় পাইকারদের কাছে বিক্রি করি। তারাও দাম দিয়ে চামড়া নিতে চায় না। তারা আমাদের দাম কম দেয়। এতে আমাদেরও কম দামে চামড়া কিনতে হয়। এছাড়া চামড়া কেনার পরেও পরিবহনসহ বিভিন্ন খরচ হয়ে থাকে। সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিলেও সেই দামে বেচাকেনা হয় না।
ফেনীতে চামড়া নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন মানুষ। শহরের মূল সড়ক থেকে পাড়া মহল্লার অলি-গলি। সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পশুর চামড়া। বড় বড় স্তুপ হয়ে থাকলেও দেখা মিলছে না ক্রেতার। বলতে গেলে পানির দরেই বিক্রি হয়েছে পশুর চামড়া। গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা ও ছাগলের চামড়া ৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বেশ কিছু এলাকায় বড় গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ৩০০ টাকায় নেওয়া হয়। ছোট গরুর চামড়া ১০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। চামড়ার বাজারে ধস নামায় বঞ্চিত হয়েছেন দুস্থরা। এতে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন।
দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকায় বসে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ চামড়ার বাজার। সেখানে গরুর চামড়ার দাম আকার অনুযায়ী ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা। কিন্তু ছাগলের চামড়া বিক্রিই করতে পারেনি কেউ। দাম না পেয়ে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে চলে গেছেন অনেকেই।
রামনগরে চামড়া বেচতে আসা সোহেল ইসলাম বলেন, ৮০ হাজার টাকা দামের গরুর চামড়া ৩৫০ টাকায় বিক্রি করলাম।
ভোলার চামড়ার আড়ৎদার কামাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, প্রতি বছরই লাভের আশায় চামড়া কিনি কিন্তু একবারও লাভের মুখ দেখি না। ১০ হাজার পিস চামড়া কিনেছি। দাম কেমন পাবো তা নিয়ে চিন্তায় আছি।
খুলনা জেলা কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম ঢালী বাংলানিউজকে বলেন, সত্যিই বলছি, পানির দামে চামড়া বিক্রি হচ্ছে। খুলনার ৮০ ভাগ ব্যবসায়ী এবার চামড়া কেনেননি। কেনার উপায়ও নেই—চামড়া সংরক্ষণের কোনো মার্কেট নেই, রাস্তায় রাখলে পুলিশ বাধা দেয়, আর লবণের দাম এত বেশি যে সংরক্ষণে লাভ হয় না। এ কারণেই ছাগলের চামড়া কেউ কিনছে না। কোরবানির মৌসুমে সরকার দাম বাড়ায়, পরে ট্যানারি মালিকরা দাম কমিয়ে দেয়। এতে চামড়ার বাজারে লস গুনতে হয়। খুলনায় ছোট গরুর চামড়া ১৫০-২০০ টাকা এবং বড় গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
নীলফামারীর ও সৈয়দপুরের ব্যবসায়ীদের ঢাকার ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের কাছে প্রায় ১ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। পাওনা টাকা না পাওয়ায় পুঁজির সংকটে পড়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ফলে এবারের কোরবানির মৌসুমে চামড়া কেনার যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারেননি তারা। বর্তমানে সৈয়দপুরের স্থানীয় বাজারে গরুর চামড়া আকারভেদে ৪০০-৫০০ টাকা ও ছাগলের চামড়ার দামই কেউ বলে না।
ঝিনাইদহের মৌসুমি কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী ফিজার মোল্লা বলেন, আড়তদারেরা মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় চামড়া কিনছেন। নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ীর হাতে চামড়ার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ থাকায় আমরা সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়েছি।
এদিকে এবার ট্যানারির মালিকদের ৮০-৯০ লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য রয়েছে বলে জানা গেছে। এর বিপরীতে সরকারের দেওয়া লবণ দিয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ২৫ লাখের বেশি চামড়া সংরক্ষণের হিসাব পাওয়া গেছে।
সরকারের তথ্য অনুসারে, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার মাদ্রাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং কোরবানির ৭ লাখ ৭৪ হাজার গরু, মহিষ ও ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করেছে। খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৯৪ পিস গরু, মহিষ ও ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বরিশাল বিভাগে ১ লাখ ৬৭ হাজার, রংপুর বিভাগে ২ লাখ ৮১ হাজার, রাজশাহী বিভাগে ২ লাখ ৮৭ হাজার এবং সিলেট বিভাগে ২ লাখ ৯ হাজার চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। সাভারের ট্যানারিপল্লিতে ৩ লাখ ৮৬ হাজার চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সূত্রে জানা যায়, ঈদের দিন থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত চার দিনে ঢাকার পোস্তায় মাত্র ৮০ হাজার পিস চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। আড়তদারেরা রাজধানীর ভেতর থেকে কাঁচা চামড়া কিনে নিজেরা লবণ দিয়ে এগুলো সংরক্ষণ করেছেন। সরকার-নির্ধারিত সময় শেষে ১৭ তারিখ থেকে লবণযুক্ত চামড়া কেনা শুরু করা হবে।
সরকার-নির্ধারিত সময় শেষে আড়তদারদের পাশাপাশি ট্যানারিগুলো নিজেরাও চামড়া কিনবে।
আড়তদার ও ট্যানারি মালিক:
ঢাকার পোস্তা এলাকায় কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) মহাসচিব টিপু সুলতান বাংলানিউজকে বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে লবণযুক্ত চামড়া ফুট হিসেবে ফড়িয়াদের কাছ থেকে কেনা হবে সেটা ১৭ জুনের পর। এখন যেসব চামড়া আসছে সেটা ঈদের তিন চারদিন যে কোরবানি হয় সেই চামড়া। সরকার লবণ দেওয়া চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে, লবণ ছাড়া না। সে জন্য এ চামড়া কম দামে ব্যবসায়ীরা কিনছেন।
সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম যৌক্তিক হয়নি বলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ন্যায্য দাম পাননি বলে তিনি অভিযোগ করে বলেন, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করে সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে, তা বর্তমান বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ছাড়া বাজারে অর্থের জোগানও কম ছিল। এ বছরও আড়তদারদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যায়নি। এখনো ট্যানারির কাছে আড়তদারদের বকেয়া ১১০ কোটি টাকা। এছাড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় প্রতিবছর অন্তত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কোরবানির চামড়া নষ্ট হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, এবার চামড়ার মূল্য বরং স্থিতিশীলই ছিল। লবণ ছাড়া ভাল মানের গরুর কাঁচা চামড়া ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে। এবছর গত বছর থেকে প্রতিপিস চামড়ার দাম অন্তত ৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছে। তবে আর যেসব গরুর চামড়া আকারে তুলনামূলক ছোট ও মান কিছুটা খারাপ, সেগুলোও উপযুক্ত দামে বিক্রি হয়েছে। আর লবণযুক্ত চামড়ার বেচাকেনা এখনও শুরুই হয়নি। দুই-একদিনের মধ্যে শুরু হলে সেটার দামও স্থিতিশীল থাকবে বলেই আশা করছি।
তিনি বলেন, চামড়ার দাম নিয়ে যে সমস্যাটা হয় সেটা মূলত সরকারের ব্যবস্থাপনা ঘটতির কারণে। সরকারকে আগে চামড়ার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। চীনের একচেটিয়া আগ্রাসন থেকে বেরিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার বাজার ধরতে হবে। আমরা রপ্তানি করতে পারলেতো চামড়া কিনবো। একক বাজার হওয়ায় চীন দাম কম দিয়ে থাকে। আমরা যদি লাভ করতে না পারি তাহলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা দাম পাবে কোথা থেকে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিক্রয়ের জন্য সুসংগঠিত একটি বাজার নেই। ঈদুল আজহার সময় হঠাৎ প্রচুর চামড়া বাজারে আসে, কিন্তু তা যথাযথভাবে সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করার মতো অবকাঠামো না থাকায় চাহিদা কমছে। এ ছাড়া সাভারের ট্যানারিপল্লী পরিপূর্ণভাবে কার্যকর না হওয়ায় প্রক্রিয়াকরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক ট্যানারি এখনো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে রূপান্তর করতে পারেনি। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা আগ্রহ হারাচ্ছে। ভারত, চীন, ভিয়েতনাম এসব দেশ কম খরচে চামড়া সরবরাহ করছে। ফলে প্রতিযোগিতা বাড়ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি। এর মধ্যে কোরবানিযোগ্য ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু-মহিষ, ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০টি ছাগল-ভেড়া ও ৫ হাজার ৫১২টি অন্যান্য প্রজাতির প্রাণী।
সরকারি সংস্থা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, ২০২৫ সালে দেশে ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৪টি পশু কোরবানি হয়েছে। যার মধ্যে গরু/ মহিষ ৪৭ লাখ ৫ হাজার ১০৬টি; ছাগল/ভেড়া ৪৪ লাখ ৩০ হাজার ৬৬৮টি; অন্যান্য ৯৬০টি। ফলে কোরবানিরযোগ্য প্রাণী অবিক্রি আছে ৩৩ লাখ ১০ হাজার ৬০৩টি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এই চামড়ার ৬০ ভাগের বেশি সরবরাহ হয় কোরবানির মৌসুমে। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া।
জিসিজি/এজে