অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগামীকাল শুক্রবার (১৩ জুন) লন্ডনে বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ও তুমুল উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে এই বৈঠক এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’।
সচেতন নাগরিকরা বলছেন, সন্দেহ, সংশয় আর ষড়যন্ত্রের হাত থেকে দেশ বাঁচাতে হলে অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে কোনো এক ‘ডেডলকের’ মধ্যে পড়ে দেশ ও দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে লন্ডন বৈঠক হতে পারে ঢাকার রাজনীতির ‘কম্পাস’, যা পরবর্তী দিনগুলোর পথচলায় দিকনির্দেশ করবে।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, নির্বাচন ইস্যুতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভাঙার অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশিদের। একই ইস্যুতে ২০০৭ সালে বিতর্কিত ‘ওয়ান-ইলেভেন’ সরকার তৈরি হয়েছিল, যার কুশীলবরা রাজনীতিকদের ‘মাইনাস’ করার চক্রান্তে জড়িয়েও সফল হননি। উপরন্তু গণআন্দোলনের মুখে তাদের দেশ ছাড়তে হয়, এরপর দেড় যুগেও তাদের দেশে ফেরার সৌভাগ্য হয়নি।
স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্তেজনায় এখন কৌতূহলী দৃষ্টি লন্ডনে। এই বৈঠকে আলোচনার বিষয়বস্তু কী হবে? নির্বাচন কি এপ্রিলেই হবে? নাকি দিনক্ষণ পরিবর্তন হবে? জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রে বিএনপির অবস্থানই বা কী হবে? তারেক রহমান কি দেশে ফিরবেন? কীভাবেইবা আলোচনা ও এই বৈঠকের সূত্রপাত? কে ছিলেন এই উদ্যোগের নেপথ্যে? এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনীতি-সচেতন মহলে।
কয়েক মাস ধরেই বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের দাবি তুলছিল। কিন্তু সরকারের প্রতিনিধিরা এই সময়সীমা ‘ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে’ বলে আসছিলেন। এ নিয়ে সরকার ও বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে বাহাস দেখা যায়। এমনকি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে শপথ না পড়ানো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিসহ নানা ইস্যুতে রাজপথে আন্দোলন করতে দেখা যায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের।
এই পরিস্থিতিতে সদ্য উদযাপিত ঈদুল আজহার আগে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস এপ্রিলে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেন। এ নিয়ে বিএনপির হাইকমান্ড অসন্তোষ প্রকাশ করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এমন পরিস্থিতিতে ঈদের ঠিক দুদিন আগে ৫ জুন বুধবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান। সেখান থেকেই বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে শীতল সম্পর্কের বরফ গলা শুরু হয়। খালেদা জিয়ার বাড়ির দলিল হস্তান্তরের সেই বৈঠকে আদিলুর রহমান বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে বোঝাতে সক্ষম হন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ফ্যাসিবাদবিরোধী সব দলের। এই সরকার বিএনপিরও সরকার। এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন কিংবা কঠোর অবস্থান প্রকারান্তরে পতিত ফ্যাসিবাদকেই লাভবান করবে।
এ সময় আদিলুর রহমান বিএনপি চেয়ারপারসনকে লন্ডন সফরকালীন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের আগ্রহের বিষয়টি তুলে ধরেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বৈঠকের আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারেক রহমান এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিচ্ছিলেন না। ঈদের পর বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গেলে তিনি ড. ইউনূসের সঙ্গে বিরোধের কারণ জানতে চান? তার বিরুদ্ধে আন্দোলন কেন করতে হবে তারও কারণ জানতে চান? এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার আহ্বানকে ইতিবাচক বার্তা হিসেবে নিয়ে আলোচনায় বসার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
জানা যায়, তারেক রহমান স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে পরদিন রাতেই এ বিষয়ে আলোচনা করেন এবং স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সম্মতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের আলোচনায় বসার আহ্বানে সাড়া দেন।
অবশ্য বুধবার সন্ধ্যায় কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলায় এক অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান বলেন, ‘ইউনূস সাহেব যখন বাংলাদেশে সমস্ত পথ হারাইয়া ফেলছেন, উনি পথ পাওয়ার জন্য আমাদের নেতা তারেক রহমান সাহেবের কাছে ১২ ঘণ্টা প্লেন চালাইয়া লন্ডন পর্যন্ত গেছেন। বলছেন, আমাকে একটু কথা বলার সুযোগ দেন। ’
লন্ডন বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নিয়েই এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। ড. ইউনূস যদি তারেক রহমানকে বোঝাতে সক্ষম হন, তাহলে এপ্রিলেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। অথবা কিছুদিন আগেও হতে পারে। বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে উত্থাপিত জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্রেও বিএনপির সম্মতি আদায় করতে চান ড. ইউনূস।
প্রসঙ্গত, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন শেষ ধাপের আলোচনার জন্য ১৭ জুন থেকে আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে। সেই বৈঠকে বিএনপিকেও নমনীয় দেখতে চায় সরকার। এছাড়া তারেক রহমানের পক্ষ থেকে তার দেশে ফেরার বিষয়টিও তুলে ধরা হতে পারে। তারেক রহমান দেশে ফিরলে তার নিরাপত্তার বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে দেখা হবে এমন নিশ্চয়তাও চাওয়া হতে পারে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে তারেক রহমান যে কোনো সময় বাংলাদেশে ফিরতে পারেন। ব্যক্তিগতভাবে তারেক রহমান দেশে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।
লন্ডনে অবস্থানরত ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোহাম্মদ ইমরান এই বৈঠক সম্পর্কে বলেন, এক-এগারোর তিক্ত অভিজ্ঞতা সে সময়ের কুশীলবদের রয়েছে। তাদের অধিকাংশই এখন দেশের বাইরে। অন্তর্বর্তী সরকারের কুশীলবদের এখন একমাত্র অবলম্বন বিএনপি। সরকার চাইবে নিজেদের নিরাপদ প্রস্থান ও ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। তাই সম্ভবত ড. ইউনূস আগামীতে জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রে বিএনপির নমনীয় অবস্থান দেখতে চাচ্ছেন।
অন্যদিকে বিএনপি ক্ষমতায় এলে সরকারেরও নিরাপদ প্রস্থানটা প্রত্যাশা করবে। এর বিনিময়ে বিএনপিও নির্বাচনের তারিখ এগিয়ে নিতে চাইতে পারে কিংবা তারেক রহমান দেশে ফিরলে তার নিরাপত্তার অনুরোধ জানাতে পারে। আসলে শুক্রবারের বৈঠকের পরই হয়তো সব জানা যাবে না। রাজনীতির বাতাস অনুভব করে এসব উপলব্ধি করতে হবে।
একই সুরে রাজনীতিতে সংঘাতের চেয়ে আলোচনার গুরুত্ব অনেক বেশি ও অনেক ফলপ্রসূ বলে মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারি। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক ডেডলকে (অচলাবস্থা) পাকিস্তান ভেঙেছিল। উন্নয়নশীল বহু দেশে এমনকি আফ্রিকাতেও এমন দেশ ভাঙার ও শাসন ব্যবস্থা ভঙ্গুর হওয়ার বহু দৃষ্টান্ত আছে। তাই দেশের স্বার্থে সরকার ও বিএনপি উভয়পক্ষকেই আলোচনায় বসা উচিত। ছাড় দেওয়ার মানসিকতা ধারণ করা উচিত। তারেক রহমানও শুভ চিন্তা করে আলোচনায় বসছেন।
ড. নুরুল আমিন বেপারি আরও বলেন, সরকারের এখন নির্বাচন নিয়েই বিএনপির সঙ্গে আলাচনা করা উচিত। সরকার যদি আলোচনা না করে আর বিএনপিও যদি অ্যাডামেন্ট (অনড়) থাকে, তাহলে ডেডলক সৃষ্টি হবে। তাই সবারই নমনীয় হওয়া উচিত।
‘প্রফেসর ইউনূসের এপ্রিলে নির্বাচনী টাইম ঘোষণায় জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী দলগুলো খুশি হয়েছে। তারা স্বাগতও জানিয়েছে। এখন বিএনপি ওকে করলেই হয়ে যাবে। যেসব দল বিএনপির কাছ থেকে আসন পাওয়ার চিন্তায় বিএনপির সঙ্গে আছে, বিএনপি ওকে করলেই তারাও ঠিক হয়ে যাবে। কিছুটা স্যাক্রিফাইস করে সবাই বসলে দেশের জন্য ভালো হবে। নির্বাচন নিয়ে জেদাজেদি করলে সবার জন্যই খারাপ হবে। ’
এই বিশ্লেষক বলেন, জুলাই-আগস্ট মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। আগস্ট মাসের মধ্যে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের টাইম ও ফ্রেম ঘোষণা না করলে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি কিংবা এপ্রিলেও নির্বাচন সম্ভব হবে না। তাই সবার নিজেদের মধ্যে কথা বলে সমাধানে আসা উচিত।
এ বিষয়ে সাংবাদিক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারুফ কামাল খান বাংলানিউজকে বলেন, আমি মনে করি, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ না, কার কথায় বা কীভাবে এই বৈঠকটা হচ্ছে। মূল বিষয় হচ্ছে, এই বৈঠকের মাধ্যমে একটা সমঝোতা হওয়া। ফলে কে এখানে আগে এগোলো বা কে পেছালো, এই বিষয়গুলো খুব একটা গুরুত্ববহন করে না। আমি যতটুকু জানি, এই রকম একটা বৈঠক ইউনূস সাহেব খুব আগ্রহের সঙ্গে চেয়েছেন। চাইলে অসুবিধা নেই তো। মূল কথা হচ্ছে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসা। যে কোনো সাক্ষাতে যাওয়ার আগে কতগুলো প্রসেস হয়, এর মধ্যে ইতিবাচক-নেতিবাচক দুইদিকই থাকে। বেগম জিয়া সক্রিয় না হলেও এখনো দলের সর্বোচ্চ পদে আছেন, উনি মতামত দিতেই পারেন। আমিও শুনেছি, উনি বলেছেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে।
এইচএ/