ঢাকা, রবিবার, ২ ভাদ্র ১৪৩২, ১৭ আগস্ট ২০২৫, ২২ সফর ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

সড়কে চলন্ত মৃত্যুফাঁদ ফিটনেসবিহীন যানবাহন

রেজাউল করিম রাজা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:০১, আগস্ট ১৬, ২০২৫
সড়কে চলন্ত মৃত্যুফাঁদ ফিটনেসবিহীন যানবাহন ফাইল ফটো

দেশে মানুষ দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে যাতায়াতের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকেন বাস, মিনিবাস, হিউম্যান হলার এবং অটোরিকশা। তবে এসব যানবাহনের বেশিরভাগেরই ফিটনেস সনদ নেই, যা সড়কে যাত্রীদের জন্য এক একটি চলন্ত মৃত্যুফাঁদ তৈরি করছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ২০ শতাংশের জন্য দায়ী আনফিট মোটরযান। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কারণে প্রতিদিনই ঘটছে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি।

ফিটনেস সনদ: আইন ও পরীক্ষা
দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী ফিটনেসবিহীন যানবাহন রাস্তায় চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সড়কে গাড়ি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন অনুমতিপত্রের মধ্যে অন্যতম হলো- ফিটনেস সনদ, যা ইস্যু করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। ফিটনেস পরীক্ষা হয় গাড়ির এক্সেল লোড, টায়ারের বিড, ব্রেক, ধোঁয়া নির্গমন, হেডলাইট, অ্যালাইনমেন্ট, রং, আসন, ইঞ্জিন ও বডির বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করে। সবকিছু ঠিক থাকলে গাড়ি পায় ফিটনেস সনদ। বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, দেশে মোটরযানের সংখ্যা প্রায় ৬৪ লাখ, এর মধ্যে মোটরসাইকেল ৪৭ লাখ। মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে ফিটনেস সনদ বাধ্যতামূলক নয়। ফিটনেস সনদ থাকা বাধ্যতামূলক যানবাহনের সংখ্যা ১৭ লাখের বেশি, কিন্তু এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ যানবাহনের হালনাগাদ ফিটনেস সনদ নেই।

গণপরিবহন ও চুক্তিভিত্তিক যানবাহনের পরিস্থিতি
সম্প্রতি দেশে পরিবহনবিষয়ক প্রকাশিত এক তথ্য থেকে জানা যায়, গণপরিবহন হিসেবে ব্যবহার করা বাসের সংখ্যা ৫৬ হাজার ৭৩৩টি, মিনিবাস ২৮ হাজার ৫৬১টি, হিউম্যান হলার ১৭ হাজার ৩৭৪টি। এর মধ্যে ভাড়ার বিনিময়ে নির্দিষ্ট রুটে যাত্রী পরিবহনে ব্যবহৃত ২৩ হাজার ৬৬৫টি বাস, ১১ হাজার ৯০৫টি মিনিবাস ও ১৪ হাজার ৫১০টি হিউম্যান হলারের হালনাগাদ ফিটনেস সনদ নেই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, নিবন্ধিত চুক্তিভিত্তিক পরিবহন হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া অটোরিকশা, অটোটেম্পো ও ট্যাক্সি ক্যাবের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে অটোরিকশা প্রায় ৩ লাখ ২৭ হাজার, অটোটেম্পো ১৬ হাজার ও ট্যাক্সিক্যাব রয়েছে ৩৬ হাজার। বিআরটিএর তথ্যানুযায়ী, চুক্তিভিত্তিক পরিবহনের দুই লাখ ২৩ হাজারের বেশি মোটরযানের হালনাগাদ ফিটনেস নেই। সারাদেশে প্রায় দুই লাখ ১১ হাজার অটোরিকশার হালনাগাদ ফিটনেস সনদ নেই।
   
মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন ও সড়কে ঝুঁকি
সরকার বাস ও ট্রাকের ইকোনমিক লাইফ ২০ ও ২৫ বছর নির্ধারণ করে দিয়েছে। বিআরটিএর হিসাবে, ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলায় ২০ বছরের পুরনো বাস ও মিনিবাস রয়েছে ১০ হাজার ৫৫৬টি। এর বাইরে সারাদেশে আরও ১৮ হাজার ২০৫টি বাস ও মিনিবাস রয়েছে, যেগুলোর বয়স ২০ বছর বা তার থেকেও বেশি। পাশাপাশি ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলায় ২৫ বছরের পুরোনো পণ্যবাহী (ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ট্যাংকলরি) মোটরযানের সংখ্যা ১৪ হাজার ৬৮৩টি। এর বাইরে সারাদেশে আরও ৩১ হাজার ৭৯৮টি পণ্যবাহী মোটরযান রয়েছে, যেগুলোর বয়স ২৫ বছর বা তার থেকেও বেশি। সব মিলিয়ে দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ বাস ও ট্রাকের সংখ্যা ৭৫ হাজারের বেশি।

ফিটনেসবিহীন মোটরযান সড়ক-মহাসড়কে অবাধে চলাচল করায় নানাবিধ ঝুঁকিতে পড়ছেন যাত্রী এবং পথচারী। যখন তখন স্টার্ট বন্ধ হয়ে কিংবা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় বাড়ছে হতাহতের ঘটনা। এসব গাড়ির কালো ধোঁয়া ও বিকট শব্দ পরিবেশ দূষিত করে, ফলে দেশের জনগণ আক্রান্ত হচ্ছে বহুবিধ রোগে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি মাঝ রাস্তায় খারাপ হয়ে যানজট তৈরি করে।

দুর্ঘটনা ও যান্ত্রিক ত্রুটি অধিকাংশ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ির ফিটনেস ঠিক থাকে না। ব্রেক, চাকা, স্টিয়ারিং, গিয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ অংশ দুর্বল থাকায় চালক নিয়ন্ত্রণ হারান। একটি ফিট গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়লে যে পরিমাণ হতাহত হয়, ফিটনেসবিহীন গাড়িতে তা কয়েক গুণ বেশি হয়। রাজধানীসহ সারা দেশে কিছু বাস এতটাই আনফিট যে যাত্রী বহনে একেবারেই অনুপযোগী। গণপরিবহনের স্বল্পতার কারণে যাত্রীরা বাধ্য হয়ে এসব বাসে ঝুঁকি নিয়েই যাতায়াত করতে। এসব বাসের অধিকাংশই রংচটা, জানালার কাচ ভাঙা, সিট ভাঙাচোরা এবং নোংরা।

বিশেষজ্ঞ ও কর্তৃপক্ষের মন্তব্য
ফিটনেসবিহীন যানবাহন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৎস্য-ভবন ট্রাফিক পুলিশের শহর ও যানবাহন শাখার পুলিশ পরিদর্শক মো. আশিকুর রহমান বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় (ডিএমপি) ডকুমেন্টারি ফিটনেসবিহীন গাড়ি পাওয়া খুব দুষ্কর। ডিএমপিতে ফিটনেসবিহীন গাড়ি খুব একটা পাওয়া যায় না। বাইরে থেকে দেখে অনেক বলেন ফিটনেস নেই, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাস্তবতা হচ্ছে, ডিএমপিতে চলাচল করা গাড়িগুলোর ফিটনেস আছে, আপ-টু-ডেট ডকুমেন্টও আছে। ডকুমেন্টারি সমস্যা না থাকলে আমরা সেই যানবাহন আটক করতে পারি না। যানবাহনের কালো ধোঁয়া নির্গত হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, কালো ধোঁয়া মাপার যন্ত্র পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আমাদের দেওয়া হয়নি। তারপরেও আপাতত দৃষ্টিতে দেখে আমরা মামলা দেই।
 
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ফিটনেসবিহীন যানবাহনের ঝুঁকি প্রসঙ্গে বলেন, লক্কড়-ঝক্কর মেয়াদোত্তীর্ণ বাসের কারণে ঝুঁকি বাড়ছে। যে বাসগুলো মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে, রাস্তার পাশে গাছের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে, আমরা দেখছি যানবাহনগুলো একবারে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। যাত্রীকে দুর্ঘটনায় যানবাহনগুলো যে প্রটেকশন দেওয়ার কথা, সেটা দিতে পারছে না। যখন মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, তখন দেখা যায় বাসগুলো দুমড়ে-মুচড়ে যায়। যে সিট আঁকড়ে ধরে যাত্রীদের বসে থাকার কথা, সেই সিটগুলোও খুলে যায়, অন্য সিটের সাথে ধাক্কা লেগে যাত্রীর হতাহতের ঘটনা ঘটে। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কারণে যাত্রীর জীবনের ঝুঁকি বাড়ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বাংলানিউজকে বলেন, আমরা সাধারণত দুর্ঘটনার যেসব কারণ দেখি, তার মধ্যে একটি হচ্ছে মেকানিক্যাল ফেইলিওর অব ভেহিকেল। আনফিট গাড়ির মেকানিক্যাল ফেইলর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সুতরাং দুর্ঘটনা ঘটার এটা একটা অন্যতম কারণ।

তিনি আরও বলেন, সরকার যেগুলোকে আনফিট গাড়ি বলছে সেগুলো রেজিস্ট্রেশনভুক্ত। তার চেয়ে বেশি পরিমাণ অবৈধ গাড়ি, যেগুলোর কোন মান পরীক্ষা ও সেফটি টেস্ট নেই, সেই গাড়িগুলো আবার যারা চালাচ্ছে তাদেরও কোনোরকম রোড সেন্স নেই। ঝুঁকির যদি র‍্যাংকিং করা হয়, বিআরটিএ যদি অভিভাবক হয় তাহলে তার জানা উচিত সড়কে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কারা। সেই হিসেবেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিষয়ে পদক্ষেপ প্রসঙ্গে জানতে বাংলাদেশের সড়ক পরিবহনখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ, রোড সেফটি শাখার পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাস এবং রোড সেফটি শাখার সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল নোমানের সাথে একাধিকবার চেষ্টা করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও সুপারিশ
জাতিসংঘের ‘গ্লোবাল প্ল্যান ফর সেকেন্ড ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেইফটি ২০২১-২০৩০’-এর পাঁচটি পিলারের তিন নম্বরটি হচ্ছে নিরাপদ যানবাহন। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনেও ফিটনেসবিহীন যানবাহন একটি অন্যতম বাধা। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ফিটনেস যাচাই ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়, সড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।

সুপারিশ:
১. ফিটনেস পরীক্ষা ও আপডেট বাধ্যতামূলক করা।
২. মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি রুট থেকে সরানো।
৩. পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ যানবাহন ব্যবহার নিশ্চিত করা।
৪. সড়ক নিরাপত্তা আইন আরও শক্তিশালী করা।
৫. নিয়মিত মনিটরিং ও জরুরিসেবা নিশ্চিত করা।

ফিটনেসবিহীন যানবাহনের ঝুঁকি অবজ্ঞা করা সম্ভব নয়। প্রতিদিন এই যানবাহনগুলো মানুষের জীবন বিপন্ন করছে। তাই সরকার, বিআরটিএ, পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও নাগরিকদের যৌথ উদ্যোগে সড়কে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।

আরকেআর/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।