সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর বুধবার (০৭ জুন) অভিযান চালিয়ে বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউক।
রাজউকের অন্যতম পরিচালক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খন্দকার অলিউর রহমানের নেতৃত্বে বুধবার দুপুর ১২টার দিকে গুলশান এভিনিউয়ের ১৫৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের বাড়িতে অভিযান শুরু হয়।
কিছু মালপত্র গুলশান ২ নম্বর সার্কেলের ৮৪ নম্বর সড়কের একটি বাসায় রাখা হয়েছে। এ বাসাটি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মালিকানাধীন বলে জানা গেছে।
দীর্ঘ ৩৬ বছর দখলে থাকা ৩০০ কোটি টাকার বাড়ি থেকে মওদুদ আহমদকে উচ্ছেদ করার সময় নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিপুল সংখ্যক পুলিশ, দু’টি জলকামান, কয়েকটি প্রিজনভ্যান, সাঁজোয়া যান ও রাজউকের বুলডোজার প্রস্তুত রাখা হয়।
তবে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বাসা থেকে কয়েকশ’গজ দূরের এ বাসা থেকে মওদুদ আহমদকে উচ্ছেদ করতে কোনো বেগ পেতে হয়নি রাজউক বা পুলিশ বাহিনীকে। বিকেল ৩টা থেকে ইফতারের আগ মুহূর্ত পযর্ন্ত ওই বাড়ির সামনে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ছাড়া আর কেউ যান নি। সারা দিন একাই বাড়ির সামনে বসে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ‘অসহায়’ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখেছেন ৩৬ বছর ধরে একটু একটু করে গড়া সংসার রাজউকের বুলডোজার বেয়ে উঠছে খোলা ট্রাকে। সন্ধ্যার পর রাজউকের এমন একটি ট্রাক থেকেই বিশাল আকৃতির একটি আলমারি বিকট শব্দে সড়কের উপর পড়ে যায়। বাসার সামনে নির্বাক বসে থাকা মওদুদ কয়েক পায়ে হেঁটে সামনে গিয়ে দেখে আসেন সড়কের উপর পড়ে থাকা প্রিয় আলমারিটি।
এ সময় অস্পষ্ট স্বরে তিনি বলেন, একটু একটু করে গোছানো জিনিসপত্র সব তছনছ করে দিলো। সারাদিন কেউ না আসলেও ইফতারের পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ১৫৯ নম্বর বাসার সামনে বসে থাকা মওদুদের সঙ্গে দেখা করতে যান। এ সময় তিনি মওদুদ আহমদকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেন।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর একে একে সেখানে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে (অব.) মাহবুবুর রহমান, আমীর খসরু মাহমদু চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, মেজর (অব.) রুহল আলম চৌধুরী, মীর মোহম্মদ নাসির উদ্দিন, চেয়ারপারসনে উপদেষ্টা তৈমুর আলম খন্দকার, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, এনডিপির চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা, এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদ হোসেন সেলিম, বিএনপির নির্বাহী সদস্য আবু নাসের মোহম্মদ রহমতউল্লাহ প্রমুখ।
এদিকে বাড়ি থেকে মওদুদ আহমদকে উচ্ছেদের সময় রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিজস্ট্রেট অলিউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, এটা রাজউকের সম্পত্তি। দীর্ঘদিন ধরে উনি দখল করে রেখেছিলেন। আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। আমরা এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছি।
আর মওদুদ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, আমরা রাজনীতি করি বলে, বিরোধী দল করি বলেই আজকে এই অবস্থা? সরকারি দলের কেউ হলে আজকে এরকম হতো? আজকে বিরোধী দল করি বলেই প্রতিহিংসার শিকার হতে হলো। সন্ত্রাসী কায়দায় আমাকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হলো। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের জুনিয়র ব্যারিস্টার এহসানুল করিমের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছর দেড়েক আগে একমাত্র ছেলে মারা যাওয়ার পর (আরেক ছেলে বহু বছর আগেই মারা গেছেন) স্ত্রী হাসনা মওদুদকে নিয়ে এ বাড়িতে বসবাস করছিলেন মওদুদ আহমদ। একমাত্র মেয়ে লন্ডনে সেটেল। এ মুহূর্তে হাসনা মওদুদ লন্ডনে মেয়ের কাছে অবস্থান করছেন।
উচ্ছেদের সময় বাড়ির কেয়ারটেকার ও অন্যরা রাজউক শ্রমিকদের কাজে সহযোগিতা করেন। উচ্ছেদ অভিযানের খবর পেয়ে বিকেল পৌনে ৩টার দিকে বাড়ি সামনে এলে সামান্য সময়ের জন্য ভেতরে ঢোকার অনুমতি পান ব্যারিস্টার মওদুদ। যেটুকু সময় ভেতরে ছিলেন তার মধ্যে ৫ মিনিট পর পর উপর থেকে ফোন আসে রাজউক কর্মকর্তার কাছে। বার বার জানতে চাওয়া হয় উনি (মওদুদ) বাসা থেকে বের হয়েছেন কি না?
দুপুর আড়াইটা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায় একটি পিয়ানো, কাঠের একটি বড় সিন্দুক, অর্ধশতাধিক স্যুটকেস, কয়েক ডজন সোফা ও চেয়ার, বেশ কয়েকটি আলমারি, খাটসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র, রেফ্রিজারেটর, শীতাতপ নিযন্ত্রণ যন্ত্র, গৃহস্থালির বিভিন্ন সামগ্রী ট্রাক ও পিকআপে করে দফায় দফায় সরিয়ে নেওয়া হয়। এতো জিনিসপত্রের মধ্যে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বার বার বলছিলেন, আমার অজস্র বই, মূল্যবান ফাইল-নথি, দলিল, ব্যাংকের কাজগপত্র কোথায় কী অবস্থায় আছে কিছুই জানি না। একটু একটু করে গত পঞ্চাশ বছরের সঞ্চয় ওরা সব নষ্ট করে দিলো।
ওই বাড়ির বাড়ির প্রকৃত মালিক ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক মো. এহসান। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ডিআইটির কাছ থেকে তিনি ওই বাড়ির মালিকানা পান।
১৯৬৫ সালে বাড়ির মালিকানার কাগজপত্র এহসানের স্ত্রী অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে নিবন্ধন করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এহসান স্ত্রীসহ ঢাকা ত্যাগ করেন। তারা আর ফিরে না আসায় ১৯৭২ সালে এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়।
ওই বছরই মওদুদ ওই বাড়ির দখল নেন। কিন্তু ইনজে মারিয়া প্লাজের মৃত্যুর পর ‘ভুয়া’ আমমোক্তারনামা তৈরি করে মওদুদের ভাই মনজুর আহমদের নামে ওই বাড়ির দখল নেওয়া হয়েছে অভিযোগ এনে দুদক মামলা করলে চার বছর আগে শুরু হয় আইনি লড়াই।
মওদুদ সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গেলেও রায় তার বিপক্ষে যায়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলেও গত রোববার তা খারিজ হয়ে যায়। ফলে মওদুদের বাড়ি ছাড়া অনিবার্য হয়ে পড়ে।
রায়ের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মওদুদ বলেছিলেন, দেশে কি আইন নাই? আমি আইনের আশ্রয় নেবো। আদালতের আশ্রয় নেবো
বাংলাদেশ সময়: ০০৪২ ঘণ্টা, জুন ০৮, ২০১৭
এজেড/এএটি/