সম্প্রতি বাংলানিউজকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাতকারে বর্তমান রাজনীতি, অতীতের চর্চা এবং ভবিষ্যত করণীয় নিয়ে নিজের সুচিন্তিত মতামত তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
বাংলানিউজ পাঠকদের জন্য তার সঙ্গে কথোপকথনের চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
বাংলানিউজ: দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার অভিমত কি?
এমাজউদ্দীন আহমদ: দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ভালো না। যেখানে গণতন্ত্র থাকে না সেখানে রাজনৈতিক অবস্থাও ভালো থাকে না। সুষ্ঠু গণতন্ত্র এই দেশে কোনো সময়ই ছিল না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে কেউ যদি বলে ‘গণতন্ত্র’ আছে। তাহলে এটা হবে গণতন্ত্রের উপর প্রহসন, অপমান। এটা তো গণতন্ত্র না।
জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের ১৫৪টিতে বিনা ভোটেই প্রার্থীরা আটো ইলেক্টেড হয়ে গেল। এটাকে কি গণতন্ত্র বলা যায়? গণতন্ত্রের কোনো চিহ্নই এখানে নেই। এই নির্বাচনের পর বিদেশি সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, এই যে নির্বাচন করলেন, এটা তো অগণতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক সিস্টেমে হলো না। হাসিনা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এখানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য করতে বাধ্য হয়েছিলাম, করেছি এবং অচিরেই সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করবো’। ২০১৪ থেকে আজ পর্যন্ত ওই ধরনের কোনো নির্বাচনের ব্যবস্থা কিন্তু হয়নি। সুতরাং দেশ আজ ভালো নেই।
বাংলানিউজ: বিএনপির ২০১৭ সালের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে, মামলা দেওয়া হয়েছে, জেলে নেয়া হয়েছে। যে কোনো একটা কর্মসূচি দিলেই পুলিশ বাধা দেয়। এ পর্যন্ত ২৫ হাজারের মত মামলা দেয়া হয়েছে। সেই মামলায় ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ নেতাকর্মীর নাম রয়েছে। তারা কর্মসূচি দিলেও পুলিশ অনুমতি দেয় না। অনুমতি দিলেও বাধা দেয়া হয়। আরেকটা দিক হলো, পুলিশের মামলা দিয়ে হয়রানির ভয়ে অনেকে এগোয় না। সুতরাং এগুলোকে ব্যর্থতাও বলা যায়। এক অর্থে, আবার ব্যর্থতা বলাটা ঠিক না-এই কারণে যে, পরিবেশটাই এমন যে তার সময় হচ্ছে না, সাহস হচ্ছে না। মারপিট হচ্ছে এবং মারপিট খাওয়ার পর যে বিচার আচার হবে তাও হবে না। প্রতিটা মিটিংয়ে, মিছিলে ধড়পাকড় করা হয়। তারপর টাকা পয়সা, মামলা মোকদ্দমা চলতে থাকে।
বাংলানিউজ: ২০১৭ সালে বিএনপির অর্জন কি?
এমাজউদ্দীন আহমদ: আমার দৃষ্টিতে অর্জন বলতে এইটুকু বুঝি যে, খালেদা জিয়া এখনো অত্যন্ত জনপ্রিয় নেত্রী। মাস তিনেক আগে তিনি যখন লন্ডন থেকে ফিরলেন তাকে শুভেচ্ছা জানানের জন্য প্রচুর লোকের সমাগম হলো। যা সাধারণত হয় না। এরপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ পুলিশের অনুমতি নিয়ে করতে হলো। কিন্তু তারপরও জনসাধারণের বিপুল উপস্থিতি। বিজয় দিবসের যে মিছিল হলো তাতেও প্রচুর লোকের সমাগম হলো। এতেই প্রমাণ হয় চেয়ারপারসনের জনপ্রিয়তা ম্লান হয়নি। এখন নেতাকর্মীদের গা বাঁচিয়ে চলতে হয়, মার খেতে হয়, আবার জেলে যেতে হয়। গণতান্ত্রিক পরিবেশ হলে যে কোনো দাবি নিয়ে বক্তব্য দেয়া মিটিং করা যায়। কিন্তু এখন তো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ জাতীয় ইস্যুতেও কথা বলা সম্ভব হয় না।
বাংলানিউজ: ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের পর ২০১৭ সালে এসে বিএনপি কোনো ধরনের হরতাল বা অবরোধের মতো কর্মসূচি দেয় নি। এতে করে তারা কতটুকু জনগণের কাছাকাছি যেতে পেরেছে বলে মনে করছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: বিএনপি কতটুকু জনগণের কাছাকাছি গেছে সেটা বলা শক্ত। তবে জনগণ অন্যভাবে নিয়েছে। জনগণ বর্তমান পরিস্থিতিতে একটা পরিবর্তন চায়- এটা বোঝা যায়। সেক্ষেত্রে যখনই কোন মিছিল মিটিং হয়, উপস্থিতির হার প্রচুর। মারধর খাওয়ার পরও তারা সেখানে উপস্থিত হয়। এতেই বোঝা যায়, জনসাধারণের একটা আগ্রহ- ‘টু হ্যাভ এ চেঞ্জ’-একটা পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি আছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে জনগণের পক্ষ থেকে অসন্তোস সৃষ্টি হয়েছে। তারা চায় যে বিএনপি একটা পদক্ষেপ নিক। যেভাবে জনগণ চাচ্ছে সেভাবে হচ্ছে না। তারপরও জনসাধারণের দিকে তাকালে এটা বোঝা যায় যে, ‘দে ওয়ান্ট এ চেঞ্জ’।
বাংলানিউজ: ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন ও ২ মেয়াদে ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি এই মুহূর্তে সঠিক পথে এগুচ্ছে বলে মনে করেন কি?
এমাজউদ্দীন আহমদ: সঠিক বেঠিক এগুলো স্পষ্ট করে বলা ঠিক হবে না। নেতাকর্মী বিশেষ করে তরুণ কর্মীদের মধ্যে তীব্র আগ্রহ আছে, ‘লেট দেয়ার বি সামথিং’। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হোক। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বা ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়া যায়।
বাংলানিউজ: সরকার বলছে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে এবং বিএনপি বলছে সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকার যদি তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে তাহলে বিএনপির কি করণীয় হতে পারে বলে মনে করেন?
এমাজউদ্দীন আহমেদ: বিএনপি বিরোধী দল হিসেবে দীর্ঘ ৯ বছর ক্ষমতার বাইরে আছে। সুতরাং ক্ষমতায় না যেতে পারলে কর্মী বা নিম্ম পর্যায়ের নেতাদের তাদের ধরে রাখা শক্ত হবে। এজন্যই ডু হ্যাভ টু সামথিং’ কিছু একটা করতেই হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি চালু রাখতে হয় তাহলে কতগুলো পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে। এগুলো বিরোধী দল নয়, সরকারকেই নিতে হবে। জাতীয় সংসদকে ভেঙ্গে দিয়ে তফসীল ঘোষণা করতে হবে। যেসকল নেতাকর্মীদের নামে মামলা আছে, সেগুলো হয় তুলে দেয়া উচিত না হয় সাসপেন্ড করা উচিত নির্বাচন পর্যন্ত (টিল দ্যা ইলেকশন)।
এই নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশগ্রহণ না করে তাতে তাদের ক্ষতি হবে। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলও ভয়ঙ্করভাবে জাতীয় পর্যায়ে তো বটেই, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সমালোচিত হবে। এজন্য তাদের উচিত একটা সংলাপ আহ্বান করা যাতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আবহ তৈরি হয়। তা না হলে বাইরে থেকে যে সমর্থন পাওয়ার কথা সেটা পাবে না এবং প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
বাংলানিউজ: রোহিঙ্গা সংকট থেকে উত্তরণে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ বলে মনে করেন?
এমাজউদ্দীন আহমেদ: ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার থেকে প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ লোক এসেছে। এর আগে অনেকে এসেছিল এবং থেকেও গেছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা এখানে এসেছে। এ সময়ে বিরোধী দল থেকে দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল যে, এখানে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় নি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহায়তা-সহযোগিতা লাভ করে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো উচিত যাতে তারা নিশ্চিন্তভবে সেখানে থাকতে পারে। এ ব্যবস্থা তৈরি করার জন্য দরকার ছিল জাতীয় ঐক্য। যাতে করে সবদল মিলে একভাবে এক কথা বলতো। এতে করে শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী হতো।
প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ১৯৯২ সালে একুশে পদক লাভ করেন। দীর্ঘদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান, উপ-উপাচার্য এবং উপাচার্য হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা) এর ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গত ১৫ ডিসেম্বর ছিলো তার ৮৫তম জন্মবার্ষিকী।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৭
এএম/জেডএম