টক অব দ্যা কান্ট্রি নয়, শুধু এই সময়টায় দুনিয়াজুড়ে সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলায় দণ্ডের ঘটনা। ৪০ বছর পার করা এই দলটি এখন সবচেয়ে দুর্দশার সময়টি পার করছে বলে ধরেই নেওয়া যায়।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার দাবি আর আন্দোলনের মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা একটি দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। যেখানে সংগ্রামের পথে নতুন নতুন নেতারা এসে দলটিকে শক্তি জুগিয়েছেন। দীর্ঘ পথে ত্যাগের অনেক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তারা।
অন্যদিকে সামরিক ক্ষমতাকে গণতন্ত্রের মোড়ক দিতে সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। জাগদলের ব্যর্থতার পর ৭৮ সালে গঠন করা হয় বিএনপি। রমনায় আত্মপ্রকাশ করলেও দলটির নকশা করা হয়েছিল সেনানিবাসের এলিট ক্লাস থেকেই। ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাসহ অন্য পেশাজীবীদের নিয়ে গঠন করা একটি দল। যেখানে জিয়াউর রহমান ডানপন্থি, বামপন্থি, সুবিধাপন্থি সব মতের সমন্বয় করেন। আওয়ামী লীগের গাঁয়ে যখন ভারতপ্রীতি আর রাশিয়া ঘেঁষার একটি ছোঁয়া লেগে ছিল, তখনই দলটি মধ্যপ্রাচ্য ঘেঁষা এক রাজনীতির আবর্তন করে।
তবে আওয়ামী লীগ শিকড় থেকে গাছের মগডালে ওঠা দল হওয়ায় ভিত যতোটা দৃঢ় থাকলো, মগডাল থেকে শিকড়ে নামার প্রচেষ্টায় থাকা বিএনপির ভিত কিন্তু নড়বড়েই থাকলো। তবে এলিট ক্লাসের বুদ্ধিদীপ্ত মাথাগুলো টিকিয়ে রাখলো দলটিকে।
৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরও কিন্তু বিএনপি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। কিছু বুদ্ধিদীপ্ত নেতা দলটিকে জাগিয়ে রেখেছিলেন। যার হাল ধরেন ১৯৮৩ সালে খালেদা জিয়া। বিএনপির গাঁয়ে সেনানিবাসের যে প্রলেপ ছিল, সেখান থেকে জনগণের মাঝে নিয়ে আসতে কিন্তু অনেকটাই সফল হলেন তিনি। স্বৈরাচার সরকার পতনে বড় ভূমিকা পালন করলো দলটি এবং খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে কালের পরিক্রমায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রলেপও লেপে নিলো শরীরে। পাশাপাশি আসনে বসে থাকা বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে গেলে যোজন যোজন।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চরিত্রে জাতীয় নির্বাচনের প্রথম ধাপ ১৯৯১ সাল। সব দলের অংশগ্রহণে জয়ী হওয়া এ নির্বাচনে জামায়াতের সহযোগিতায় সরকার গঠন করে বিএনপি। ক্ষমতা লাভে পর থেকে ধীরে ধীরে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীটিকে পাশ কাটিয়ে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করে দলটি। জিয়া পরিবারের সন্তান, ভাগ্নে, ভাতিজাদের প্রভাব লক্ষ্যণীয় হতে শুরু করে।
যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়েছিলেন খালেদা জিয়া সেই প্রক্রিয়াকে বানচাল করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একদলীয় নির্বাচন করলেন। দীর্ঘদিনের বন্ধু জামায়াতে ইসলামও বিরোধীপক্ষে অবস্থান নিলো। টিকতে পারলেন না খালেদা, মসনদ ছাড়তে বাধ্য হলেন। যার ফল নির্বাচনে বড় ধরনের পরাজয়। ২০০১ সালে কিন্তু শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে অনুসরণ করলেন না। বরং ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন দিলেন। খালেদা আবারো ক্ষমতায় আসলেন। এই বড় জয় বিএনপিরর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো।
জোট সঙ্গী জামায়াতে ইসলামের পেটের ভিতর আশ্রয় নিলো দলটি। সুবিধাবাদী বিএনপির নেতারা অর্থ উপার্জনে মন দিলেও রাজপথের কথা ভুলে গেলেন। রাজপথে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করলো জামায়াত। বিএনপির স্টিয়ারিং তখন থেকেই খালেদার হাত থেকে তার বড় ছেলে তারেক রহমানের হাতে চলে গেলো। দলের অভিজ্ঞ সিনিয়র নেতাদের অবহেলা করা হলো চরমভাবে। একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কর্নেল অলি, মেজর আব্দুল মান্নানরা মান বাঁচাতে দল ছাড়লেন। তাদের ক্ষোভ মেটানোর বিপরীতে জঞ্জালের মতো ছুঁড়ে ফেললেন খালেদা-তারেক।
বিনা বিচারে মানুষ হত্যার সংস্কৃতি, ফুলবাড়িতে গুলি করে কৃষক হত্যা, সিএনজি বাণিজ্য, শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা ছাড়াও দেশে জঙ্গি উত্থানে ভয় পেয়ে যায় সাধারণ মানুষ। আবারো ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে মরিয়া হয়ে উঠলো বিএনপি। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে ক্ষমতা ছাড়ার আগে সমালোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে আবারো ক্ষমতায় আসার নীলনকশা তৈরি করে। তবে আওয়ামী লীগ যে এমন প্রতিরোধ গড়ে তুলবে সেটা আঁচ করতে পারেননি মওদুদরা। আম-ছালা সবই হারায় বিএনপি।
আওয়ামী লীগেরও অনেক নেতা ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়কের সময় সংস্কারে নাম লিখিয়েছিলেন। তাদের অনেকেই এখন সংসদ সদস্য আবার মন্ত্রীও। শেখ হাসিনা তাদের বিষয়ে কৌশলী হয়েছেন। তবে বিরোধীদলে থাকাকালীন দলের এক সময়কার প্রভাবশালী মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়ার মৃত্যুতেও আপসহীনতা দেখালেন খালেদা। পরিবারকে সান্ত্বনা পর্যন্ত দিতে গেলেন না। সুবিধাপন্থি নেতারাও সরে দাঁড়ালেন ধীরে ধীরে। নাজমুল হুদাতো এখনো সরকারের সঙ্গে মিশতে মরিয়া হয়ে আছেন।
তারেক রহমান দুর্নীতির দায় নিয়ে লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখান থেকেই মূলত দল চালাচ্ছেন তিনি। সিনিয়র নেতাদের অবমূল্যায়ন চলতেই থাকলো। দলের ভেতরে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। ৩৫-৪০ বছর বয়সী ব্যক্তিদের ছাত্রনেতা বানানোর সংস্কৃতি থেকে বেরোতে পারলো না বিএনপি। তারেক রহমানের উগ্রতা আর একরোখা ভাবের কারণে বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীরা দূরে সরে যান।
রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব দেখা দেয় দলটিতে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলেও সিটি করপোরেশন ও উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচনে ঠিকই অংশ নিয়ে যাচ্ছে। বারবার বিদেশি শক্তির কাছে ধর্না দেওয়া, অন্যদিকে ভারত বিরোধিতা, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে বসতে রাজি না হওয়া- এসব সিদ্ধান্তের মধ্যদিয়ে খালেদা জিয়াকে ধীরে ধীরে ব্যাকফুটেই নিয়ে যেতে থাকেন তার বুদ্ধিদাতারা।
বিরোধীদলে থেকেও আন্দোলনে ব্যর্থ হয় দলটি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজের আত্মগোপনকে কৌশল হিসেবে উল্লেখ করে আন্দোলনের মাঠ ছাড়লেন। 'পথে বের হলে পুলিশ গুলি করে' এই মতবাদ ছড়িয়ে সিনিয়র নেতাদের অনেকেই ছাড়লেন মাঠ। রুমে বসে প্রেস কনফারেন্স করা আর হরতাল দিয়ে নেতাদের বাড়িতে ঘুমানোর স্বভাব দলটিকে রাজপথ থেকে ছিঁটকে দিলো। এর মধ্যে এক জু জু তাদের পেয়ে বসলো। বিদেশি কোনো শক্তি এসে তাদের ক্ষমতায় বসাবে। এই মোহ তাদের ভাঙতে সময় লাগলো।
ইতিহাস নির্মম হয়ে ফিরে এলো। বৃহস্পতিবার সংসদে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ইয়াহিয়া চৌধুরী ঠাট্টা করে বললেন, জেলখানায় খালেদা জিয়া সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের লাগানো গাছ থেকে বরই খেতে পারবেন!
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৮
এমএন/এএ