ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে এই অভিযান শুরু হয় দলের কতিপয় নেতার কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষোভ প্রকাশের পর। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় দলের সভাপতি শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কিছু নেতার অপকর্মের কথা উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
পরে ১৮ সেপ্টেম্বর খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়ার মালিকানাধীন অবৈধ ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর গুলশানের বাসা থেকে তাকেও অবৈধ অস্ত্র, গুলি, মাদকসহ গ্রেফতার করা হয়। ২০ সেপ্টেম্বর গুলশানের নিকেতনের কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করা হয় যুবলীগের সমবায় বিষয়ক সম্পাদক পরিচয় দিয়ে আসা জি কে শামীমকে। তার কার্যালয় থেকে তখন ১৬৫ কোটি টাকার বেশি এফডিআর ও নগদ এক কোটি ৮০ লাখ উদ্ধার করা হয়।
এ দু’জনের পাশাপাশি এ ক’দিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় দুর্নীতি, চাঁদাবাজির অভিযোগে এবং মদ ও জুয়ার আড্ডা থেকে যারা ধরা পড়েছেন, এদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের বা তাদের সহযোগী কোনো সংগঠনের লোক। এছাড়া অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত বলে আরও যাদের নাম আলোচনায় আসছে, তাদেরও বেশিরভাগই সরকারি দলেরই লোক। এজন্যই ক্যাসিনো ইস্যু নিয়ে ফুরফুরে বিএনপি। সেজন্য সরকারের পদত্যাগ দাবি পর্যন্ত করছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্যরা।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ২১ সেপ্টেম্বর দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে বলেন, সম্প্রতি আপনারা দেখেছেন, আওয়ামী লীগ, যুবলীগের নেতারা কীভাবে এই ঢাকা শহরে অবৈধভাবে অনৈতিকভাবে ক্যাসিনো চালাচ্ছে, কীভাবে লুট করেছে, চাঁদাবাজি করেছে। ক্ষমতাসীন দলের বড় নেতাদের বাসা তল্লাশি করলে বড় বড় দুর্নীতির থলের কালো বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
সেদিন আরেক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছে দুর্নীতিতে। তাদের একেবারে উচ্চপর্যায় থেকে তৃণমূলের কর্মী পর্যন্ত দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। তারই কিছু প্রমাণ আপনারা গত কয়েক দিন ধরে দেখছেন।
পরের দিন ২২ সেপ্টেম্বর আরেক অনুষ্ঠানে ফখরুল বলেন, দেশটা জুয়াড়িদের দেশ হয়ে গেছে। এ সরকারকে যদি আমি বলি জুয়াড়ি সরকার, আমার অপরাধ হতে পারে না। কারণ, সরকার সব দিক থেকে ব্যর্থ হয়ে এখন জুয়ার আশ্রয় নিয়েছে। তারা ভাবছে জুয়া খেলে কোনো রকমে টিকে থাকা যায় কিনা! যাবে না, কারণ এটা হচ্ছে গণতন্ত্রকামী মানুষের দেশ। আমরা চাই এখনই আপনাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। দেশের মানুষের গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিন এবং খালেদা জিয়ার মুক্তিতে কোনো বাধা হবেন না। তাকে আইনগতভাবে মুক্তি দিন। ভোট চুরি করে যে পার্লামেন্ট গঠন করেছেন তা বাতিল করুন। নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন দিন।
যদিও ২০ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডিতে দলীয় সভাপতি রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ঢাকাকে ক্যাসিনোর শহর বানিয়েছে বিএনপি। তাদের সময় এই ক্যাসিনোগুলো ছিল। সে ক্যাসিনোর ব্যাপারে অ্যাকশন নেওয়া হচ্ছে। ’
ক্যাসিনো ইস্যুতে সরকারকে তোপ দেগে আসা বিএনপি নেতারা কাদেরের এই বক্তব্যকে বলছেন ‘হাস্যকর’। এমনকি জি কে শামীম বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের লোক ছিলেন, পরে তিনি যুবলীগে যোগ দিয়েছেন বলে যে আলোচনা চলছে, সেটাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন দলটির নেতারা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকার সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাস বাংলানিউজকে বলেন, বিএনপি ক্যাসিনো সৃষ্টি করেনি। বিএনপির সময় এদেশে ক্যাসিনো ছিল না। বরং আমি মেয়র থাকাকালে ঢাকা শহরের সব জুয়ার আড্ডা ভেঙে দিয়েছিলাম। এ বিষয়ে আপনারা খোঁজ খবর নিতে পারেন। ওবায়দুল কাদের নিজেদের বাঁচাতে এ ধরনের কথা বলেছেন।
জি কে শামীমের বিষয়ে মির্জা আব্বাস বলেন, শামীমকে আমি চিনি না। সে যদি আমার লোকই হয় তাহলে যুবলীগে গেলো কীভাবে? গত ১০ বছর আওয়ামী লীগ কী করেছে। শামীম যুবলীগে আছে কত বছর?
বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যাসিনো অভিযানে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের ধরপাকড় তারা বেশ উপভোগ করছেন। কেউ কেউ বলছেন, সরকারি দলের ছত্রছায়ায় থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারকারীরা এখন নিজেদের হাতেই শায়েস্তা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক নেতা বলেন, আমাদের দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দিয়ে যখন সরকার নির্যাতন নিপীড়ন চালাচ্ছিল, তখন তাদের দলের মধ্যে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য চলছিল। যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে বিরোধীদলকে হয়রানি করা হয়েছিল, এখন তাদের হাতেই নিজেরা ধরা পড়ছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বাংলানিউজকে বলেন, এটা (ক্যাসিনো ইস্যু) ব্যবহার করার কিছু নেই। একটা বড় ধরনের অপরাধ চলছিল, এত বছর যাবত কেন নজরে এলো না সেটাই অবাক করার বিষয়। এখন কেউ বলছে ৫০-৬০টি, কেউ বলছে ৪-৫শ’। সংখ্যা যেটাই হোক অপরাধ একটা হচ্ছিল। সেটা বন্ধ করা জরুরি। দেশ ও সমাজের জন্যই এটা বন্ধ করা দরকার।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বাংলানিউজকে বলেন, এটাকে ব্যবহার করার কিছু নেই। এ ধরনের অভিযান অন্য কোনো নাটক কিনা সেটাও দেখার বিষয় আছে। ওবায়দুল কাদের এখন সহযোগিতা চাইছেন। সহযোগিতা একজন করতে পারেন যাকে (খালেদা জিয়া) আটক রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়া ১/১১ এর সময় তাদের সহযোগিতা করেছেন।
সরকারের চলমান অভিযান প্রসঙ্গে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, লাখ ঘটনার মধ্যে এখন তিনটি ঘটনা আসছে। শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা ৮শ’ দুর্নীতিবাজের তালিকা আওয়ামী লীগের কাছে দিয়েছে। ওবায়দুল কাদের পারেন এই ৮শ’ জনকে হাজির করে দিতে। তাহলে বোঝা যাবে পরিশুদ্ধ হওয়ার কিছুটা হলেও আপনাদের সদিচ্ছা আছে। চলমান এই প্রক্রিয়াকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাবো। তবে তিনটা লোককে আটক করে লাখ লোককে আড়াল করার প্রচেষ্টা যদি হয়, সেখানে আমরা প্রশংসা করতে পারবো না।
বাংলাদেশ সময়: ০৭২৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৯
এমএইচ/এইচএ/