ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

কাটতি বেড়েছে অনুবাদ বইয়ের

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩
কাটতি বেড়েছে অনুবাদ বইয়ের জি এম মুজিবুর

ঢাকা: থরে থরে সাজানো হাজার বইয়ের ভিড়ে কিছু পাঠকের চোখ খুঁজে ফেরে ভিন্ন কিছু। গল্প, উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থে ঠাসা স্টল বা প্যাভিলিয়নের কোনো এক কোণে তারা খুঁজে পান অনুবাদ ও ইংরেজি সাহিত্যের বই।

থ্রিলার, গোয়েন্দা কাহিনী এবং বিজ্ঞানভিত্তিক বইয়ের পাশাপাশি এ ধরনের গ্রন্থ নিয়েও কিছু পাঠকের আগ্রহও দেখা যায় বইমেলায়। সংখ্যায় খুব কম হলেও এ ধরনের বইয়ের বিক্রি নিছক মন্দ নয়। এ ধরনের বইয়ের লেখক এবং পাঠক- দুই ক্ষেত্রেই তারুণ্যের প্রভাব দেখা গেছে। নতুনের পাশাপাশি এ ধরনের পুরোনো বইয়েরও চাহিদা রয়েছে।

তবে সংশ্নিষ্টরা বলছেন, নতুন প্রকাশিত অনেক অনুবাদ গ্রন্থের ক্ষেত্রেই কমবেশি অনুযোগ রয়েছে। অনুবাদ সাহিত্যের অনেক গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে মূল লেখকের অনুমতি ছাড়া। এ ধরনের বইয়ের ক্ষেত্রে যতখানি মনযোগ ও সতর্কতা দাবি রাখে, তা হয়নি বেশিরভাগ বইয়ে। অবশ্য এতে অনুবাদ ও ইংরেজি সাহিত্যের পাঠকদের উচ্ছ্বাসে ন্যূনতম ভাটা পড়েনি। তারা ঠিকই নতুন গ্রন্থের খোঁজ করেছেন মাসজুড়ে। কিনেছেনও পছন্দের বই।

পাঠকরা বলছেন, ভাষার প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যের সেরা লেখাগুলোর সঙ্গে পরিচয় ঘটছে পাঠকদের। ফিকশন, নন-ফিকশনসহ বহু বিষয়ের বাছাই করা বই অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা ভাষায়। পাঠকদের আগ্রহ দেখে প্রকাশকরাও নতুন নতুন অনুবাদের বই বাজারে নিয়ে আসছেন।

এবার অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অনুবাদের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

একটা সময় ছিল দেশে শুধু পাশ্চাত্যের জনপ্রিয় ও পুরস্কার পাওয়া বইগুলোর অনুবাদ পাওয়া যেত। বর্তমানে প্রাচ্যের ভাষা থেকেও অনুবাদ আসছে। লাতিন, আফ্রিকান, জাপান, কোরিয়া, চীনের শিল্প-সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ হচ্ছে। আরবি, উর্দু, ফারসি থেকেও সরাসরি অনূদিত বই প্রকাশিত হচ্ছে।

বইমেলায় মাওলা ব্রাদার্স থেকে কথাসাহিত্যিক মশিউল আলমের দুটি অনূদিত বই প্রকাশ পেয়েছে। রুশ লেখক দস্তয়েফস্কির ‘নিরীহ’ ও ‘তলকুঠুরির কড়চা’ মূল রুশ ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন তিনি। তলকুঠুরির কড়চা দস্তয়েফস্কির সর্বাধিক আলোচিত ও প্রশংসিত উপন্যাস। বইটি ইংরেজিতে বহুল পরিচিত ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামে। এ উপন্যাসে যেসব দার্শনিক, আধিবিদ্যক, নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে, পরবর্তী সময়ে অপরাধ ও শাস্তি, ইডিয়ট, দানবেরা ও কারামাজভ ভাইয়েরা উপন্যাসে সেগুলোই আরও বিশদভাবে, গভীরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তলকুঠুরির কড়চা দস্তয়েফস্কির বহু বিচিত্রমুখী, ব্যাপক ও সুগভীর সাহিত্যিক সৃষ্টিসম্ভারের ভাবগত নির্যাস। বইটি মূল রুশ থেকে বাংলায় অনূদিত হলো এ প্রথম।

মশিউল আলম বলেন, ‘আমাদের ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব কথা লেখা হয়নি। অনুবাদ না হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপুল ভাণ্ডার থেকে আমরা বঞ্চিত হব। বলার অপেক্ষা রাখে না যে অনুবাদ হওয়াটা জরুরি। ’

বইমেলার বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টল ঘুরে দেখা গেছে, এক শ্রেণির অনুবাদ বই রয়েছে যেগুলো অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক। বিশ্বসাহিত্যের ক্লাসিক নামে নিম্নমানের অনুবাদ বই দিয়ে প্রকাশকরা সাজিয়েছেন স্টল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুরস্কৃত হওয়া বইয়ের সস্তা অনুবাদই বেশি। এ বইগুলোর বেশির ভাগই অসম্পাদিত ও মূলানুগ নয়। এসব বইয়ে তাড়াহুড়ার ছাপ স্পষ্ট। অনেক অনুবাদ বইয়ে মূল লেখকের অনুমতি নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কয়েকজন প্রকাশক মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

মশিউল আলম বলেন, এখন অনেক বই অনুবাদ হচ্ছে। বিশেষ করে বিদেশে পুরস্কৃত বইয়ের অনুবাদ অনেকে তড়িঘড়ি করে থাকেন। আগে মার্কেজের অনুবাদ হতো, এখন মুরাকামির অনুবাদ করছেন অনেকে। কিছু অনুবাদ ভালো, আবার কিছু অনুবাদে আড়ষ্টতা আছে। অনূদিত বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহও আছে। তবে মানের দিকটায় আরো গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

ডা. বি আর আম্বেদকরের ‘বুদ্ধ অথবা কার্ল মার্কস’ প্রবন্ধগ্রন্থে সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানে জন্মানো ও চিন্তার ক্ষেত্রে ভিন্নতর দুজন মানুষের তুলনা করা হয়েছে। অন্যদিকে কোরীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা কিম কি-দুক তার স্বকীয় ধারার চলচ্চিত্রের জন্য ভুবনবিখ্যাত। তার জীবনের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হলো ‘স্প্রিং, সামার, অটাম, উইন্টার... অ্যান্ড স্প্রিং (২০০৩)’, যা রজার এবার্টের ‘গ্রেট মুভিস’ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ‘বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত...এবং বসন্ত’ নামে বইটি এবারের মেলায় অনূদিত হয়ে এসেছে।

কেইলিন সি উইলিয়ামস ও ক্যারোলিন সি উইলিয়ামস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই নামি শিক্ষাবিদ। বর্তমানের অত্যাধুনিক নানা প্রযুক্তি বা বিভিন্ন অ্যাপসের সময়ে শিক্ষার্থীরা যখন পাঠে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, তখন সেসব অ্যাপস ব্যবহারের মাধ্যমে কীভাবে তাদের পাঠে মনোযোগ বাড়ানো যায়, কীভাবে শিক্ষার্থীদের ভেতর চারিয়ে দেওয়া যায় কল্পনা ও সৃজনশীলতার রং, সে বিষয়ে তাদের লিখিত বইয়ের অনুবাদ ‘শিক্ষার্থীদের পড়ার আগ্রহ বাড়ানোর পাঁচটি উপায়’।

অন্যদিকে ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত ‘আদিবাসী জনগণের অধিকারবিষয়ক ঘোষণা’র বাংলা অনুবাদও মেলায় এসেছে। বইমেলায় এ বইগুলো প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য। অনুবাদ করেছেন সাহিত্যিক অদিতি ফালগুনী। তিনি জানালেন, তার আরও দুটি অনূদিত বই প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

ঐতিহ্যের ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন কাজল জানান, তাদের প্রকাশনী থেকে পাঠকরা অনুবাদ বই খুঁজে খুঁজে কেনে। তরুণরা ফিকশন কিনলেও মধ্য বয়সী ও সিরিয়াস ধারার পাঠকদের প্রধান পছন্দ নন-ফিকশন অনুবাদের বই।

আমজাদ হোসেন কাজল আরো জানান, তাদের স্টলে এবার সৈয়দ শামসুল হকের অনুবাদে বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই এসেছে। এছাড়া মোগল সিরিজের বইগুলোর বিক্রি সারা বছরই ভালো।

উমা ত্রিলোকের লেখা ‘অমৃতা-ইমরোজ: আ লাভ স্টোরি’ লেখকের অনুমতি ও আলাপ সাপেক্ষে অনুবাদ করেছেন দিলওয়ার হাসান। ১৬০ পৃষ্ঠার ‘অমৃতা-ইমরোজ: একটি প্রেমকাহিনী’ বইটি প্রকাশ করেছে ‘বাতিঘর’। অনুবাদক জানালেন মেলার শুরু থেকেই বইটির বিক্রি ভালো। তিনি অনুবাদ সাহিত্যের সুদিন দেখতে পাচ্ছেন।

বৈভব থেকে এবার প্রকাশিত হয়েছে মৃদুল মাহবুবের বই ‘কিম জিইয়ং, জন্ম ১৯৮২’। প্রকাশনীটি আব্বাস কিয়ারোস্তামীর কবিতাসমগ্র এনেছে রুহুল মাহফুজ জয়ের অনুবাদে। বৈভবের বিক্রয়কর্মীরা বলেছেন, দুটি বইয়েরই বিক্রি ভালো।

অন্বেষা প্রকাশনী এনেছে 'হরর থ্রিলার- দ্য রেড ডোর'। বইটির লেখক জুনায়েদ ইসলাম পড়াশোনা করেন একটি মেডিকেল কলেজে। বাংলা ভাষায় এটিই তার প্রথম বই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণসমগ্র গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছে অনন্যা। 'দ্য অনার‌্যাবল প্রাইম মিনিস্টার শেখ হাসিনা ইন ইউনাইটেড ন্যাশনস' নামে বইটি লিখেছেন সুভাস সিংহ রায়। নালন্দা এনেছে সুবর্ণ ইসাক বারির 'দ্য লাভ'। অনুপম দেবাশীষ রায়ের 'নট অল স্প্রিংস অ্যান্ড উইন্টার' এনেছে আদর্শ প্রকাশনী। ডেইলি স্টার বুকস থেকে এসেছে মো. তাজদিন হাসানের 'দ্য ট্রান্সজিশন'। সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দারের 'আনভার্নিসড অ্যাসেস' এনেছে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ। চর্চা গ্রন্থ প্রকাশে রয়েছে রাসেল আশেকীর 'দ্য লিজেন্ড আনফিনিশড'। বইটি পুরোনো হলেও পাঠকের বেশ আগ্রহে রয়েছে।

বইমেলা ঘুরে দেখা গেছে, উৎস, ঐতিহ্য, নালন্দা, সন্দেশ, সেবা প্রকাশনী, ইউপিএল, প্রথমা, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সসহ অনেক প্রকাশনী সংস্থা নতুন-পুরোনো লেখকের অনুবাদ সাহিত্যের বই প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে পাঠকের আগ্রহে থাকা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সালেহ মুহাম্মদের 'সেলেশ্চিয়াল বডিজ' (উৎস), সুব্রত বড়ূয়ার 'অনুবাদসমগ্র সাহিত্য' (অনুপম), তারিক আনাম খানের 'কঞ্জুস' (চারুলিপি), খসরু চৌধুরীর 'জুল ভার্ন মাস্টার অব দ্য ওয়ার্ল্ড' (ঐতিহ্য), সাবিদিন ইব্রাহিমের 'হেরাক্লিটাস :কুড়িয়ে পাওয়া মুক্তা' (ঐতিহ্য), শেখ আবদুল হাকিমের 'দ্য ম্যান ফ্রম পাকিস্তান' (প্রথমা), আরিফ জামানের 'দ্য সার্পেন্টস শ্যাডো' (রোদেলা), পি এম রাসেলের 'দ্য টাইম মেশিন' (শামস পাবলিকেশন্স), সুরাইয়া ফারজানা হাসানের 'নির্বাসিত জীবনের গল্প' (সময় প্রকাশনী)।

কয়েকটি প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এক শ্রেণির পাঠক শুধু এ ধরনের অনুবাদ বই কিনতে মেলায় আসেন। অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে তাদের। কেউ কেউ তালিকা ধরে ধরে অনুবাদ সাহিত্যের বই কিনছেন। অনুবাদের পুরোনো বইগুলোর চাহিদাও বেড়েছে। পাশাপাশি নতুন বই নিয়ে প্রচুর আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। অনুবাদ সাহিত্যের লেখক-পাঠকদের মধ্যে ভিন্ন মাত্রার উৎসাহ দেখা যায়।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩
এইচএমএস/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।