হুমায়ূন আহমেদ। এক সময় মেলায় প্রবেশ করলেই তাকে ঘিরে পাঠকদের চাঞ্চল্য তৈরি হতো।
হয়তো তিনি এখন অটোগ্রাফ দেন না। হয়তো মেলায় আসে না তাঁর নতুন কোনো বই। তবে এখনো হিমু, মিসির আলি, শুভ্রদের হাত ধরে তিনি মেলায় বিরাজ করছেন। তাঁর রচিত তিনশোর অধিক বই পাঠকের কাছে তাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
২০২৪ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় স্টল ঘুরে হুমায়ূনের বইয়ের প্রতি পাঠকের ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেছে। অনুপম, অন্যপ্রকাশ, কাকলীর মতো প্রকাশনীতে নতুন বই এলেও গত এক যুগ ধরে বিক্রিতে শীর্ষে রয়েছেন হুমায়ূন। প্যাভিলিয়নের যে দিকটিতে হুমায়ূনের বই রাখা, পাঠকদের আগ্রহ যেন সেখানেই।
শনিবার মেলা ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। অনুপম প্রকাশনীতে বিক্রয়কর্মী রিফাতের কাছে ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে’ বইটি খোঁজ করলেন ফার্মগেট থেকে আসা মণিকা। বইটির ২ কপি কিনে টাকা পরিশোধ করতে করতে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘আমি বই পড়া শুরু করেছি হুমায়ূনকে দিয়ে। ভাইয়া প্রচুর বই পড়তেন। ওনার কাছে তাঁর প্রচুর বই থাকত। হুমায়ূনের গল্পগুলো শেষ হয়েও হয় না। আমার মধ্যে এক ধরনের ভাবনা তৈরি করে। ’
বিক্রয়কর্মী রিফাত বলেন, ‘আমাদের কয়েকটি নতুন বই এলেও সবাই এসে হুমায়ূনের বই খোঁজেন। এখনো ওনার বইয়ের বিক্রি সবচেয়ে বেশি। ’
কাকলী প্রকাশনী ঘুরেও একই চিত্র দেখা গেছে। এখানে হুমায়ূন আহমেদের ‘ছেলেবেলা’, ‘নি’, ‘সমুদ্র বিলাস’, ‘মিসির আলি সমগ্র’, ‘হিমু সমগ্র’, ‘অনন্ত নক্ষত্র বিথী’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘আঙুল কাটা জগলু’, ‘হোটেল গ্রেভার ইন’, ‘নলিনী বাবু বিএসসি’, ‘গৌরীপুর জংশন’সহ ৪০টির বেশি বই বিক্রি হচ্ছে। সেসব বই কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাঠকরা।
বিক্রয়কর্মী জুয়েল জানান, হুমায়ূন আহমেদের ‘কবি’ উপন্যাসে পাঠকের আগ্রহ বেশি। ১৯৯৬ সালে বইটি যখন বের হয়, মেলা তখন একাডেমি প্রাঙ্গণে ছিল। পাঠকের সারি ঠিক রাখতে তখন বাঁশের লাইন করতে হতো; তবুও অনেক সময় ভিড় সামলানো যেত না।
একই অবস্থা অন্যপ্রকাশেও। সেখানে ‘বলপয়েন্ট’, ‘হিজিবিজি’, ‘ফাউন্টেনপেন’, ‘কাঠপেন্সিল’, ‘কিছু শৈশব’, ‘আজ দুপুরে তোমার নিমন্ত্রণ’, ‘আজ আমি কোথাও যাব না’, ‘মৃন্ময়ী’, ‘এই বসন্তে’, ‘একা একা’, ‘বাদশা নামদার’, ‘লীলাবতীর মৃত্যু’, ‘দ্বিতীয় মানব’, ‘অচিনপুর’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘আমি ও কয়েকজন প্রজাপতি’, ‘রাবণের দেশে আমি ও আমরা’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘দেয়াল’, ‘হলুদ হিমু কালো র্যাব’, ‘শুভ্র’, ‘কুটু মিয়া’, ‘নন্দিত নরকে’সহ প্রায় ১১৬টির বেশি হুমায়ূন আহমেদের বই পাওয়া যাচ্ছে।
হুমায়ূন পাঠকরা বলছেন, রচনাশৈলী, ভাষার সারল্য, সূক্ষ্ম হিউমার মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ একটি ‘হুমায়ূনীয় ধারা’র সৃষ্টি করেছেন, যা তাঁর পাঠককে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। তিনি রচনার ভাষাশৈলী নিয়ে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেননি। প্রথম থেকেই তাঁর যে সহজাত লেখার ধরন, সেটা তিনি ধরে রেখেছিলেন।
হুমায়ূন পাঠক ও গল্পাকার তানসীর আলম বাংলানিউজকে বলেন, সাহিত্যিক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সাহিত্যে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কারণ, বিশ্বের অজস্র ভাবাদর্শের প্রচণ্ড প্রভাবের ফলে বাংলাদেশের লেখকেরা অনেক সময় প্রাত্যহিক জীবনযাপনকে খালি চোখে দেখতে পারেন না। জীবনকে তারা দেখেন বিভিন্ন মতবাদের আরোপণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। হুমায়ূন এমন একজন লেখক, যিনি এই আরোপণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জীবনদৃষ্টি দিয়ে তিনি জীবনকে দেখেছেন, লেখক হিসেবে নিজের জায়গায় তিনি মৌলিক থেকেছেন।
তিনি বলেন, হুমায়ূন যেভাবে লিখেছেন, পরবর্তীতে তাঁর এই সরল ধারা অনেকে অনুকরণ করতে চাইলেও প্রত্যেকেই ব্যর্থ হয়েছেন। এ থেকেই বোঝা যায় তার ব্যবহৃত ভাষা সরল হলেও সেটা একান্তই তার নিজের।
আরেক পাঠক মোরশেদুল ইসলাম তাসফিন বাংলানিউজকে বলেন, হুমায়ূন আহমেদের লেখা ট্যাটু করার বেদনার মতো, মৃদু ছন্দে ছোট ছোট প্রবাহ ধীরে ধীরে পাঠকের মনে একটা স্থায়ী চিত্র তৈরি করে ফেলে। লেখার মানের ভালো-মন্দের হিসেবের ঊর্ধ্বে, হুমায়ূন আহমেদ টিকে আছে—ধীরগতির কিন্তু কার্যকরী প্রভাব তৈরি করার ক্ষমতার কারণে তিনি টিকে থাকবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৪
এমজেএফ