ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

বইমেলা

বাংলানিউজকে মহিউদ্দিন আহমেদ

কোয়ালিটির প্রশ্নে নো কম্প্রোমাইজ

আসাদ জামান ও আবু তালহা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৫
কোয়ালিটির প্রশ্নে নো কম্প্রোমাইজ ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বইমেলা থেকে: মহিউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ।

দেশের সর্ববৃহৎ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইপিএল) প্রকাশক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি গ্রন্থোন্নয়ন সংক্রান্ত দেশি-বিদেশি নানা কার্যাক্রমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
 
প্রকাশনার বিভিন্ন বিষয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন’ আয়োজিত ওয়ার্ল্ড বুক কংগ্রেসের বিভিন্ন সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এই প্রকাশক। তিনি ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব স্কলারি পাবলিশাসার্স’ ও ‘আফ্রো এশিয়া বুক কাউন্সিলের’ অন্যতম সদস্য। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতিও।
 
অমর একুশে গ্রন্থমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রান্তে ইউপিএলের প্যাভিলিয়নে বাংলানিউজের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার আলাপচারিতায় উঠে আসে প্রকাশনা শিল্পের সেকাল-একাল, বর্তমান-ভবিষ্যৎ, সমস্যা-সম্ভাবনা। আলাপাচারিতার চুম্বক অংশ বাংলানিউজের পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।
 
 
বাংলানিউজ: প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন কীভাবে?
 
মহিউদ্দিন আহমেদ: আমার পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিলো সাংবাদিকতার মাধ্যমে। লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার পর সেখানেই টানা চার বছর অধ্যাপনা করি। পরে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের পাকিস্তান শাখার সম্পাদক হিসেবে যোগ দেই। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস বাংলাদেশ’র প্রধান নির্বাহী নিযুক্ত হই।
 
বাংলানিউজ: তার মানে পেশাগত জীবনের শুরুর অভিজ্ঞতাই আপনাকে প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করেছে?
 
মহিউদ্দিন আহমেদ: বিষয়টি আরেকটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। বাংলাদেশ জন্মের পর দেখলাম আমাদের এলিট রিডার সোসাইটি (বোদ্ধা পাঠক সমাজ) আমদানি করা বইয়ের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, বুয়েট, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও এনজিওসহ সব জায়গার রেফারেন্স বই ইউকে, ইএসএ, জার্মান, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দেশ থেকে আসছে। আমাদের এখানে কোনো বই প্রোডিউস হচ্ছে না। তখন মনে হলো সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়ার পরও যদি মেধার বিকাশ ও  জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীল হয়ে থাকি, তাহলে আর স্বাধীন হলাম কেন?
 
বাংলানিউজ: এর পরই কী শুরু হলো যাত্রা?
 
মহিউদ্দিন আহমেদ: অক্সোফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রেসের চাকরি ছেড়ে ১৯৭৪-৭৫ এ সীমিত পরিসরে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করি। প্রথম দিকে স্কুল কলেজের পাঠ্য ইংরেজি বইগুলো প্রকাশ করি। যেগুলো আগে বাইরে থেকে আনা হতো।
 
বাংলানিউজ: সৃজন ও মননশীল বই প্রকাশ শুরু হলো কখন থেকে?
 
মহিউদ্দিন আহমেদ: সৃজন ও মননশীল বই প্রকাশের জন্য খুব একটা অপেক্ষা করিনি। খুব সম্ভবত ১৯৭৫-১৯৭৬’র দিকে রিডার সোসাইটি (পাঠক সমাজ) ওপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে ক্লাসিক বইগুলো রি-প্রিন্ট শুরু করি। ওই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মীর মশাররফ হোসেন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়, শেখ ফজলুল করিমসহ বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখকদের বই প্রকাশ হতে থাকে ইউপিএল থেকে।
 
বাংলানিউজ: উত্তরাধুনিককালের সাহিত্যিকদের মধ্যে কাদের বই ওই সময় ছেপেছেন?
 
মহিউদ্দিন আহমেদ: প্রথমেই বলতে হয় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথা। এছাড়া শওকত ওসমান, আশরাফ সিদ্দিকী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, সেলিনা হোসেন, হাসনাত আব্দুল হাই, হুমায়ূন মালিক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, মঞ্জু সরকার, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, আহমদ রফিক ও মুনতাসীর মামুনসহ সৃজন ও মননশীল শাখার অনেক লেখকের বই-ই ইউপিএল প্রকাশ করে।
 
বাংলানিউজ: ইউপিএল থেকে প্রকাশিত সিংহভাগ বই-ই ইংরেজি ভাষার, কারণ কী?
 
মহিউদ্দিন আহমেদ: বিদেশে বাংলাদেশের বইয়ের প্রসার ও রপ্তানি আমার বিশেষ আগ্রহের একটি  জায়গায়। ইউপিএল থেকে প্রকাশিত বইয়ের ৩০/৫০ ভাগ ইউকে, ইউএসএ, ফ্রান্স, জার্মান, জাপান, সুইডেনসহ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে রপ্তানি হয়। আপনি হয়তো জেনে থাকবেন, বই রপ্তানিতে অগ্রণী ভূমিকার জন্য ১৯৮৩-১৯৮৪ সালে আমাকে রাষ্ট্রপতির রপ্তানি ট্রফি প্রদান করা হয়।
 
বাংলানিউজ: বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষার লেখক কারা?
 
মহিউদ্দিন আহমেদ: এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের কথা বলতে হয়। ইংরেজিতে লেখা ওনার অন্তত ১৩টি বই ইউপিএল প্রকাশ করেছে। বিদেশে ওনার এই বইগুলোর ব্যাপক চাহিদা। বিদেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি ওনার বই চেয়ে পাঠায়। এছাড়া বিদেশি লেখকদের বইও আমরা ইংরেজিতে প্রকাশ করি।

বাংলানিউজ: একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। বই প্রকাশের সময় প্রয়োজনীয় এডিটিংয়ের ক্ষেত্রে লেখকের কাছ থেকে প্রকাশক কতটুকু স্বাধীনতা পান বা ভোগ করেন?
 
মহিউদ্দিন আহমেদ: লেখকের সঙ্গে প্রকাশকের একটি কমার্শিয়াল এগ্রিমেন্ট হয়। এডিটিংয়ের পরিধি নিয়ে কোনো এগ্রিমেন্ট হয় না। তারপরও পাণ্ডুলিপি রিডিংয়ের সময় বইয়ের কোনো অংশ, তথ্য বা মন্তব্য যদি প্রিন্ট অ্যান্ড পাবলিশিং অ্যাক্ট’র সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, সে বিষয়টি লেখককে অবহিত করা হয়। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, কাকে দিয়ে আমি পাণ্ডুলিপিটি পড়াচ্ছি। অযোগ্য বা অদক্ষ লোক দিয়ে পাণ্ডুলিপি পড়িয়ে লেখককে বিরক্ত করা সমীচীন নয়।
 
বাংলানিউজ: গত সাড়ে চার দশকে প্রকাশনা শিল্প কী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে; এটাকে পেশা হিসেবে নিয়ে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কতটুকু সম্ভব?
 
মহিউদ্দিন আহমেদ: খুবই সম্ভব। শুধু এ পেশার সঙ্গে যুক্ত থেকে অনেকেই সমৃদ্ধ জীবনের সন্ধান পেয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের কথাই ধরুন না কেন? তিনি বই লিখে বাড়ি-গাড়ি করেছেন। তার বই ছাপিয়ে অনেকেই টাকা-পয়সা উপার্জন করেছেন। অন্য আর দশটি পেশার মতো এ পেশাতেও যেটা প্রয়োজন সেটি হলো- জ্ঞান, যোগ্যতা ও সততা।
 
বাংলানিউজ: এবার একটু মেলা প্রসঙ্গে আসা যাক।
 
মহিউদ্দিন আহমেদ: মেলা নিয়ে তো মেলা কথা, মেলা সুখ, মেলা স্মৃতি। কী জানতে চান প্রশ্ন করুন।
 
বাংলানিউজ: মেলার সেকাল-একাল?
 
মহিউদ্দিন আহমেদ: শুরুতে পাঠক ছিলো কম। অল্প সংখ্যক বই বের হতো। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও ছিলো হাতে গোনা। মেলার পরিধিও ছিলো ছোট। এখন সব কিছুই বেড়েছে। পাঠক বেড়েছে। বেড়েছে বইয়ের সংখ্যা। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও অনেক। আর মেলার পরিধি বাড়তে বাড়তে বাংলা একাডেমির চত্বর ছাড়িয়ে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে ঠেকেছে। এই হচ্ছে বহিরাবরণের বিচারে মেলার সেকাল-একাল। আর যদি বাঙালির আবেগ অনুভূতির কথা বলি, তাহলে মেলার প্রতি প্রেম-ভালোবাসা, ভাষার প্রতি মমত্ববোধ কোনো কিছুই পরিবর্তন হয়নি। সব আগের মতই আছে এবং থাকবে চিরকাল।
 
বাংলানিউজ: মেলায় আসা নতুন বইয়ের মান নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে; এ ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?
 
মহিউদ্দিন আহমেদ : এটি নতুন নয়। সেই শুরু থেকে এ অভিযোগ ছিলো। এ অভিযোগের বোঝা মাথায় নিয়েই অমর একুশে গ্রন্থমেলা এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার বিশ্লেষণ হলো, মেলায় মানসম্পন্ন বই যেমন আসে, নিম্ন মানের বইও তেমন আসে। পাঠক তার মেধা, রুচিজ্ঞান ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বই নির্বাচন করবেন, কিনবেন এবং পড়বেন। এক্ষেত্রে চাপিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, বইয়ের কোয়ালিটির প্রশ্নে- দেয়ার ইজ নো কম্প্রোমাইজ!
 
বাংলানিউজ: বইয়ের বেচা-বিক্রি সম্পর্কে বলুন?
 
মহিউদ্দিন আহমেদ: হরতাল-অবরোধের কারণে ঢাকার বাইরে থেকে মেলায় আসতে পারছেন না পাঠকদের বৃহৎ একটি অংশ। কেবল ঢাকার পাঠকরাই মেলায় আসছেন, বই কিনছেন। সেই হিসেবে আমরা অর্ধেক পাঠক পাচ্ছি। সুতরাং বেচা-বিক্রি নিয়ে প্রত্যাশার পারদটা নিচেই থাকছে।
 
বাংলানিউজ: ধন্যবাদ
মহিউদ্দিন আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।