বইমেলা থেকে: বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে নির্মিত ভাষা শহীদ রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকতের ভাস্কর্য বড় বেশি চাপে আছে! এগুলোর যদি প্রাণ থাকতো অথবা থাকতো বাকশক্তি তাহলে হলফ করে বলা যায়, সেলফিবাজদের ধমক দিতো ওরা!
জগতের বড় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার ট্র্যাডিশন অনেক পুরনো। বড় মানুষগুলো মরে যাওয়ার পর তাদের ভাস্কর্য বা ম্যুরালের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার ঘটনাও নতুন নয়।
এই সেলফি শিকারীদের মধুর যন্ত্রণা থেকে জীবিত বড় মানুষগুলো যেমন পার পাচ্ছেন না, তেমনি মৃত বড় মানুষগুলোর ম্যুরাল-ভাস্কর্যগুলোর মিলছে না রেহাই। এতে ওই ভাস্কর্যগুলোর নান্দনিক ক্ষতি সাধন কতটা হচ্ছে তা নিরূপণ করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে সেলফি শিকারীদের কারণে সাধারণ দর্শনার্থীরা ভাস্কর্যের সৌন্দর্য উপভোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন-তা বলাই যায়।
বৃহস্পতিবার বইমেলার আদিপ্রান্ত বাংলা একাডেমি চত্বরে ঢুকতেই দুই ভাষা শহীদের ভাস্কর্যের সামনে দুই তরুণের সেলফি উৎসবে আটকে গেলো চোখ। মুঠোফোনে নিজেদেও সেলফি তুলতে ব্যস্ত ঢাকা কলেজের স্নাতক সম্মান শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র আবু মুসা অনিক আর আবু ওবায়দা।
আজিমপুরে এক মেসের বাসিন্দা এই দুই বন্ধু প্রায় প্রতিদিনই মেলায় আসছেন। বইপত্র এখনো কেনা হয়নি তেমনভাবে। জিজ্ঞেস করতেই আবু ওবায়দা বললেন, ঘুরছি, দেখছি, তালিকা করছি। তালিকা দেখে বাছাই করে পরে বই কিনব। মেলা শেষ হতে তো অনেক দেরি। আবু মুসা অনিক বললেন, জসিম উদ্দীনের ‘বাঙালির হাসির বই’টা খুঁজছি। পেলে আজই কিনে ফেলবো।
‘সেলফি’ প্রসঙ্গ তুলতেই দুই তরুণ সমস্বরে বলেন, ডিজিটাল যুগে মেলায় আসব, অথচ সেলফি তুলব না, তা কি হয়? মেলার সেলফির জন্য ফেসবুক বন্ধুরা অপেক্ষায় আছে!
এই দুই তরুণের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন ভাস্কর্যটি ঘিরে চলছিলো অন্যদের সেলফি উৎসব। এ উৎসবে তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি শিশু এবং বয়স্করাও অংশ নিচ্ছেন।
এখান থেকে বাংলা একাডেমির পুকুরপাড়ে নতুন ভবনের পাদদেশে গিয়ে চোখে পড়লো সেলফি উৎসব। বাসন্তি রংয়ের শাড়ি পড়ে একদল তরুণী সেলফি উৎসবে মেতে উঠেছেন। সহকর্মী ফটোসাংবাদিককে ছবি তোলার ইঙ্গিত দিতেই বাঁধলো গোল! এক তরুণী লাফ দিয়ে এসে বললেন, ভেরি ব্যাড, উদাউট পারমিশনে ছবি তুলছেন কেন?
সামনে এগুতেই লালনের আখড়ায় দেখা মিলল নজরুল-রবীন্দ্রনাথের। এখানেও সেই একই দৃশ্য। যে যেভাবে পারছে সেলফি তুলছে। মনীষীদের ম্যুরাল পেছনে রেখে নিজ হাতে মুঠো ফোনের ক্লিক!
বাংলা একাডেমি চত্বর থেকে বেরিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকে সেলফিওয়ালাদের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মূল প্রবেশ পথের কাছেই বইয়ের অনুকৃতি’র সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছেন ইডেন কলেজ থেকে আসা পাপড়ী, লুবনা, সুপ্রিয়া, সোভা আর শিখা।
‘এই, একটু হাসি দে, এদিকে সরে দাঁড়া, চুলগুলো ঠিক কর,’-এমন টুকরো টুকরো কথামালায় একেরপর এক সেলফি তুলছেন তারা।
শুধুই কি সেলফি? নাকি বইও কেনা হবে?
হাতে রাখা বইটি এ প্রতিবেদকের দিকে এগিয়ে দিয়ে পাপড়ীর চটজলদি উত্তর, এই দেখুন, বইও কিনেছি। আরো কিনবো। বই না কিনলে মেলায় আসা পূর্ণতা পায়?
ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের প্যাভিলিয়নের সামনে গিয়েও চোখে পড়লো সেলফি তোলার ধুম! স্ত্রী-পুত্র-কন্য, ছোট ভাইয়ের বউ-মেয়ে ও ছেলেসহ পরিবারের ৭ সদস্য নিয়ে মেলায় আসা টিকাটুলির আবু নাসের মোহাম্মদ সালেহও যোগ দিয়েছেন সেলফি উৎসবে।
বইপ্রেমী এই মানুষটি প্রতি বছরই মেলায় আসেন। সাধ্য মতো কেনেন বই। সুবিধামতো একটি দিনে পরিবারের সবাইকে নিয়েই মেলায় ঢুঁ মারেন।
সেলফি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই আবু নাসের মোহম্মদ সালেহ বলেন, ‘পাঠক, লেখক ও প্রকাশদের এই মিলন মেলায় এক সময় দুই শ্রেণীর মানুষ আসত। ক্রেতা এবং দর্শনার্থী। এবার আরেকটি শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে-তা হলো সেলফি শিকারী। নতুন এই শ্রেণীটা যে বই কিনছে না, তা নয়। তারা বইও কিনছে, সেলফিও তুলছে। সুতরাং বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে নেওয়াটাই মঙ্গল। যুগের কোনো দাবিকেই অগ্রাহ্য করার নেই। যদি না সেখানে অমঙ্গলের কিছু থাকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২,২০১৫