ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

ঋতুমঙ্গল: নিসর্গে সমর্পিত শামীম হাসানের কাব্যগ্রন্থ

আহমেদ শরীফ শুভ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৫
ঋতুমঙ্গল: নিসর্গে সমর্পিত শামীম হাসানের কাব্যগ্রন্থ

শামীম হাসান পেশায় শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, নেশায় কবি এবং আলোকচিত্র শিল্পী। লেখালেখি করছেন বহু বছর ধরেই।

প্রচার বিমুখ এই কবির লেখালেখি এতোদিন সীমাবদ্ধ ছিল চট্টগ্রামের প্রত্রপত্রিকা আর বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে। সম্প্রতি প্রচার বিমুখতার আগল ভেঙে বেরিয়ে এসেছে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঋতুমঙ্গল’।

নিজের তোলা আলোকচিত্রগুলোর মতোই তার কবিতা বারবার ঘুরে ফিরে গেছে ফুল, পাখি আর নদীর কাছে। প্রকৃতির চিত্রকল্প শামীমের কবিতার পরতে পরতে। পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে নিসর্গেই সমর্পিত তার ‘ঋতুমঙ্গল’। তবে প্রকৃতি বর্ননা এবং প্রকৃতিপ্রধান হলেও তার কবিতায় সহজাত অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে নষ্টালজিয়া, প্রেম, প্রেমের রূপান্তর। সমকালও বাদ যায়নি একেবারে।

আর দশজন কবির মতো শামীমও বিরাজ করেন কল্পলোকে। কল্পলোকে গা ভাসানো এই পরিভ্রমনকে তিনি যৌবনের অস্থিরতা প্রসূত বলেই মনে করেছেন।

‘মস্তিষ্কের কি দোষ!
করোটির কঠিন দেয়াল
ভেদ করে অনায়াসে
ঢুকে পড়ে উত্তাল যৌবন’।
(অলস সময়)

একজন কবিকে তার স্বপ্নবিলাস থেকে আলাদা করা যায় না। শামীম হাসানের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ব্যতিক্রম শুধু স্বপ্নের ব্যপ্তিতে। খুব সহজ কথায় নিজের অতি সাধারন স্বপ্নের কথা বলেছেন তিনি। এই স্বপ্নগুলো চাইলেই ধরা যায়, দুষ্প্রাপ্য কিছু নয়। তবে সেটুকু পেতে হলেও এই স্বপ্নগুলো জাগিয়ে রাখতে হয়। সে কাজটিই তিনি করেছেন।

‘স্বপ্নগুলো ভারিক্কি নয়, একপেশে নয়, একেবারেই
                                              সাদামাটা,
নয়কো কোন বিত্ত-বিভব, রণরণানী, ঝঝনানীর
                                             তকমা আঁটা’।

(স্বপ্নকারিগর)

অথবা

‘আমার নদীটিও যেন থাকে
থাকে তীরে বাঁধা তরী,
আকাশের ধ্রুবতারা থেকো,
আর থেকো সমুদ্রের জলপরী’।
(চাওয়া পাওয়া)

মিলনাকাংখা, অনিশ্চয়তা ও বিরহবাদিতার টানাপোড়েনে শামীমের প্রেমের কবিতা এগিয়ে গেছে। কিন্তু প্রকৃতিবাদী কবি তার প্রেমের কবিতাগুলোও নিসর্গের আভরনেই সাজিয়েছেন।

‘শীতের আগেই ভেবেছিলাম
উড়াল দেব তোমার হ্রদে,
ক্রমশ টানা ভারী  হয়ে আসে,
এই মোম জোছনায়
ডানায় আজ শুধু উত্তরের ঘ্রাণ,
আর সব ম্লান’।
(ভারী ডানায় উড়াল দেই)

অথবা

‘পাথরের মতো কঠিন যত মন
পাথরেই হবে একদা দারুন বন’।
(পাথর)

এবং

‘স্নান ঘরে বরফ কুচি,
হাতে তার খোলা খঞ্জর,
শরীরে শীতল কাঁপুনি জ্বর,
যত নিষ্ঠুর ভেবেছিলাম, তুমি
তার চেয়ে বেশী খুনী – হে ঈশ্বরী’।
(দেবী)

শামীম তার দৃষ্টি সীমার চারপাশ এমন মুন্সীয়ানায় তুলে ধরেছেন যে অবলীলায় আমাদের মনে পড়ে যায় তিনি মূলত আলোকচিত্র শিল্পী। তার কবি স্বত্ত্বা মূলত তার সেই আলোকচিত্র শিল্পী স্বত্ত্বারই বর্ধিতাংশ। যেমন লিখেছেন -

‘বিকেলের রোদে আলস্যমাখা মৌনি গাংচিল,
ছড়ানো খাবার খেয়ে নেয় ভাগাভাগি,
ফেডারেশন স্কোয়ারে ছড়ানো থাকে উষ্ণতা,
রাতের আঁধার ঘিরে থাকে স্বপ্নের কথোপকথন’।
(মেলবোর্ন স্মৃতি)

এবং

‘রমনীরা এখানে হেঁটে যায়, আশ্চর্য অবলীলায়।
আগুন পাহাড় থেকে নেমে আসে অলিক মানব’।
(নীলগিরি)

অথবা

‘হরিণ শাবকেরা আসেনি শালিক ডানায়
খুঁটে খুঁটে খেতে আজ, ভোরের শিশির’।
(নিঝুম দ্বীপ)

আমাদের পারিপার্শ্বিক সমকালও এড়িয়ে যায়নি কবির দৃষ্টি। হয়তো বাস্তবানুগ ভাবেই এসেছে হতাশাবাদীতার সুর। যেমন-

‘মাঠে আজ কেবলি ক্ষরার গ্রাস।
মৃত্তিকায় আজ বড্ড পোড়ামাটির ঘ্রাণ’।

কিংবা
‘কথা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে এলো,
গলায় পাকানো দলা দলা বরফ,
এই এলাকা অনেক দিন ডুবে থাকবে বরফে’।

তবে যদি একটি অভিব্যক্তি দিয়ে শামীম হাসানের কবিতাগ্রন্থকে পরিচিত করতে হয় তবে সেই অভিব্যক্তিটি হচ্ছে ‘প্রকৃতি প্রেম’, যা তার প্রতিটি কবিতায় প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্নভাবে ফুটে উঠেছে শৈল্পিক নিপুনতায়। তার ‘সমুদ্রের  গান’ কিংবা ‘উপত্যকার বৃষ্টি জানে’ কবিতাগুলোর কথা আলাদা ভাবে না বললেই নয়, যেখানে প্রকৃতির সাথে নষ্টলাজিয়ার অপূর্ব সংমিশ্রন ঘটানো হয়েছে।

শামীমের কবিতার সবচেয়ে আকর্ষনীয় বিষয় হচ্ছে তিন আধুনিকতাকে অত্যন্ত সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু দূর্বোধ্যতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই সহজ এবং আটপৌঢ়ে উপস্থাপনায়ও তিনি আধুনিকতার মানদন্ডের সাথে আপোষ করেন নি। এখানেই তিনি হয়ে উঠেছেন সাধারনের কবি, পাঠকের কবি।

খালিদ আহসানের আঁকা ঝকঝকে প্রচ্ছদে ‘ঋতুমঙ্গল’ এর অন্তর ও বহিরাঙ্গিক এক কথায় অনবদ্য। দেখলেই হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে ইচ্ছে করবে। নাড়াচাড়া করতে করতেই ছন্দে অবগাহন করে গ্রন্থের অভ্যন্তরে চষে বেড়ানো যাবে অনায়াসেই। তবে কবিতায় বিরাম চিহ্নের অতি ব্যবহার ক্ষেত্র বিশেষে অপ্রয়োজনীয় ও দৃষ্টিকটু লেগেছে। কবি আগামীতে এই বিষয়ে অধিকতার যত্নবান হবেন বলে আমার বিশ্বাস।

চার ফর্মার ‘ঋতুমঙ্গল’ প্রকাশ করেছেন ‘টিনটিন’। মূল্য একশত টাকা। শামীম হাসানের নিসর্গে সমর্পিত এই কাবিতাগ্রন্থ সব শ্রেনীর কবিতা পাঠকের কাছে সমাদৃত হবে বলে আশা করি।

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।