বইমেলা থেকে: অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫-য় শুদ্ধস্বর প্রকাশ করেছে মাসুদুজ্জামানের তৃতীয় কবিতার বই ‘নভোনীল সেই মেয়ে’। এর আগে ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘উদিত দুঃখের দেশ’ ও ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কবিতার বই ‘আগুনের ডালপালা’।
শিল্পী খেয়া মেজবার আঁকা প্রচ্ছদে ৬৪ পৃষ্ঠার নতুন প্রকাশিত বইটিতে আছে মোট ৫৩টি কবিতা। কবি জানান, বইয়ে স্থান পাওয়া সবগুলো কবিতাই গত একবছরে লেখা। নিয়মিতই মেলায় আসছেন মাসুদুজ্জামান, সমসাময়িক ও পরের প্রজন্মের কবি লেখকদের সঙ্গে দিচ্ছেন আড্ডা।
বই, সাম্প্রতিক লেখালেখি ও মেলা আয়োজন সহ নানা প্রসঙ্গে বইমেলা প্রাঙ্গণে মাসুদুজ্জামানের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। দীর্ঘ দশ বছর পর নতুন কবিতার বই, কেমন লাগছে?—জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ যেন হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাকে ফিরে পাওয়া। ’
মাসুদুজ্জামান বলেন, কবিতা এমনই, একবার যে কবিতার প্রেমে পড়েছে, কবিতার সম্মোহন থেকে তার মুক্তি নেই। অনেক দিন পর তাই কবিতা আমার কাছে ফিরে এলো। আমার লেখালেখি শুরু হয়েছিল কবিতা দিয়ে। মাঝে প্রবন্ধের প্রতি ঝুঁকে পড়ায় কবিতা লেখা হয়নি। কবিতার কাছে ফিরে আসার আনন্দ তাই আলাদা। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাকে ফিরে পাওয়ার মতই। ’
নতুন করে কবিতায় ফিরতে পারার অনুভূতি ব্যাক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, কবিতার সংক্রাম এমনই যে আবেগ অনুভূতির তীব্রতায় সে যেন আমাকে উন্মোথিত কোনও কল্পলোকে নিয়ে চলেছে। অনেকটা সেই রাবিন্দ্রীক অভিজ্ঞানের মত, আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী! তো এভাবেই কবিতা-সুন্দরীর কাছে ফিরে আসাটা বেশ ভালোই উদযাপন করছি আমি। তার সঙ্গেই এখন আমার মধুর জীবনযাপন। ’
এবার প্রকাশিত বইটি সম্পর্কে জানতে চাইলে মাসুদুজ্জামান বলেন, নাম থেকেই বোঝা যায়, এটি প্রেমের কবিতার বই। প্রেম, বলা বাহুল্য, চিরায়ত কিন্তু বহুল চর্চিত একটি বিষয়, যদিও এর রয়েছে বহুমাত্রিকতা। এই বইতেও আছে সেই প্রেমের কথা যা একইসঙ্গে বহুমাত্রিক কিন্তু গভীর। প্রেমের কবিতা লেখা, অনেকেই মনে করেন, খুব কঠিন। কারণ, আবেগের তারল্যে এই ধরনের কবিতা কখনও কখনও জোলো হয়ে যেতে পারে, যায়ও। তাছাড়া নতুন বাকভঙ্গি নিয়ে কথা না বললে এই ধরনের কবিতা পাঠকের মনে কোনো আবেদনই সৃষ্টি করতে সমর্থ হয় না।
তিনি বলেন, আমি যখন এই বইয়ের কবিতাগুলো লিখছিলাম তখন এই কথাটাই আমার কাছে গুরুত্ব পাচ্ছিল। এখানে বলে রাখি, এই বইয়ের কবিতাগুলো আমি লিখেছি মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে, প্রায় ঘোরের মধ্যে। বাগদেবী তখন আমার ওপর এমনভাবে ভর করেছিল যে কবিতাগুলো না লিখে থাকতে পারিনি। কবিতাগুলো পাঠকদের ভালো লাগবে বলে আমার বিশ্বাস। ’
আগে প্রকাশিত বই দুটোর সঙ্গে এ বইটির পার্থক্যের জায়গাগুলো কী?
‘ওই বই দুটির তুলনায় আমার নতুন বইটি বেশ আলাদা। কেননা প্রেমের এই যে বিচিত্র রূপ, তা আমার কাছে আগে এইভাবে ধরা পড়েনি। ফলে ওই বই দুটোতে প্রেমের কবিতার সংখ্যা খুব কম। তাছাড়া গত প্রায় দুই দশকে কবিতার ভাষা ও নির্মাণেও নতুনত্ব এসেছে। নতুন বাগভঙ্গি ও স্বরে কবিতা লেখার চেষ্টা করছেন এই সময়ের তরুণ কবিরা।
বিষয়টি আমারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমি নিজেও খুঁজে পেতে চাইছি নতুন স্বরভঙ্গি আর বাকরীতি। নভোনীল সেই মেয়ের কবিতাগুলি এই দৃষ্টিভঙ্গির কথা মনে রেখেই লিখেছি। কতটা সফল হয়েছি সে বিচারের ভার পাঠকদের।
তরুণদের কবিতার ব্যাপারে তো দুর্বোধ্যতার অভিযোগ চরমে। আপনার কবিতাগুলোও কি দুর্বোধ্য?
একটা কথা বলি, নতুন কবিতার নামে আমি অবশ্য কবিতাকে অসম্ভবের উটে চড়িয়ে বিমূর্ত আর অর্থহীন করে তোলার পক্ষপাতী নই। কবিতার কাছে অর্থ নয়, আমি পেতে চাই এমন এক ধরনের ইমপ্রেশন যা আমাকে অভিভূত করবে। অনাস্বাদিত অনুভূতির স্বাদ দেবে। আমার নতুন কাব্যগ্রন্থে এই ধরনের কবিতা লেখারই চেষ্টা করেছি আমি। সফলতা বিচারের ভার পাঠকদের। ’
বইমেলা কেমন দেখছেন? কতদিন হয় আপনি নিয়মিত বইমেলায় আসেন?
‘গত প্রায় ১০ বছর ধরে নিয়মিত বইমেলায় আসছি। লক্ষ করেছি, ধীরে ধীরে এর পরিসর বেড়েছে। বেড়েছে প্রকাশক ও লেখকের সংখ্যাও। বইমেলার পরিসর এভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণেই বাংলা একাডেমি গত বছর থেকে মেলাটাকে দুই খণ্ডে ভাগ করে মেলাটি আয়োজনের ব্যবস্থা করেছে। এই উদ্যোগকে আমি সমর্থন করি।
কিন্তু দুই খণ্ডে বইমেলা আয়োজন নিয়ে অনেকের আপত্তি, তারা বলছে পুরো মেলাটাকে একত্রে রাখার কথা। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
‘আমি বলব, লিটল ম্যাগ চত্বরটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরিয়ে আনা উচিৎ। এই চত্বরটি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরিয়ে আনা হলে উদ্যানের বইমেলাটা আরও জমে উঠত বলে আমার ধারণা । কেননা যে তরুণ লেখকেরা আমাদের সাহিত্যের ধারাকে প্রবহমান রাখছেন, যারা আমাদের সাহিত্যের লাইফলাইন, তাদের জায়গা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই হওয়া উচিত। ’
মেলা আয়োজন নিয়ে মাসুদুজ্জামান আরও বলেন, গতবারের তুলনায় এবার দেখলাম, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে এর পরিসর প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এতে পাঠকেরা বেশ স্বচ্ছন্দে মেলায় ঘুরে ঘুরে বই কিনতে পারছেন। আমি নিজেও এটা উপভোগ করছি। তবে ধুলোর প্রকোপ আগের মতই আছে, এর তীব্রতা কমেনি। আছে বিচ্ছিন্নতার কষ্ট। মেলা দুই প্রান্তে ভাগ হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা, অর্থাৎ যেসব লেখক নিয়মিত মেলায় আসি তাদের এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত করতে করতে প্রাণান্তকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ’
তবে তিনি মনে করেন, নানা সমস্যা সত্ত্বেও এবারকার বইমেলা, তাঁর দেখা বিগত কয়েকটি মেলার মধ্যে সবচেয়ে সফলভাবে আয়োজিত মেলা।
মেলা থেকে এবার কী কী বই কিনলেন? কেনার ক্ষেত্রে কোন ধরনের বইয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন?
‘ইতোমধ্যে আমি দুই দফায় বেশ কিছু বই কিনেছি। বেশিরভাগ বই-ই তরুণ কবিদের। আমাদের অগ্রজ কবি যারা, সত্যি বলতে কি, তথ্যগত কৌতূহল আর অ্যাকাডেমিক গবেষণার প্রয়োজন ছাড়া তাদের কবিতা আমি অনেক দিন হলো পড়ি না। পড়তে ভালো লাগে না। ইতোমধ্যে অগ্রজ কবিদের কবিত্বশক্তিও ক্ষয়ে এসেছে। এখন তরুণরাই আমাদের সাহিত্যের প্রাণশক্তি।
তিনি বলেন, তরুণরাই আমাদের সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি নানা অর্থবহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিচ্ছেন। আমি তাই তাদের বই কিনেছি। যেহেতু আমি কবিতা লিখি, ফলে তরুণদের কবিতার বই-ই কিনেছি—তাদের কে কেমন লিখছেন সেটা বোঝার জন্যে। আমার আড্ডাটাও বেশিরভাগ সময়ে ওই লিটলম্যাগ চত্বরেই সীমাবদ্ধ থাকছে। তরুণ কবিদের সঙ্গে আমি মানসিক সংযোগ অনুভব করি। ’
বাংলাদেশ সময়: ২০৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৫