ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

ভাঙল প্রাণের মেলা

আদিত্য আরাফাত, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৫
ভাঙল প্রাণের মেলা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

গ্রন্থমেলা থেকে: শেষ হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৫। একে একে নিভে গেল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের সব বাতি।

আর কানে ভেসে আসবে না নতুন বই আর মোড়ক উন্মোচনের খবর; থাকবে না লেখক আর পাঠকের আড্ডা। আর কেউ স্টলে স্টলে খুঁজবে না নতুন বই।

ফের শুরু হলো এগারো মাসের অপেক্ষা। রোববার থেকে আবারও আগের চেহারায় ফিরবে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণ। এবছরের জন্য শেষ হয়েছে প্রাণের একুশে বইমেলা।

টানা এক মাসের মেলা শেষ করে শনিবার ঘরে ফিরে গেলেন লেখক-প্রকাশকরা। তবে শেষ মুহূর্তের ভালোলাগা আর আনন্দের নির্যাস নিতে ভোলেননি কেউই। আর দর্শনার্থীরা অন্য দিনের মতোই শেষ দিনেও আড্ডা আর ঘোরাঘুরি করে কাটিয়েছেন সময়। সব মিলিয়েই লেখক, পাঠক, প্রকাশক আর দর্শনার্থীর সরব উপস্থিতিতে মুখরিত ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। তাই বেদনার সুর ছাপিয়ে পরের বছরের মেলার জন্য ভালোবাসার বীজ বুনে কাটিয়েছেন মেলার শেষ দিন।

মেলার শেষ দিন বিকেলে ৪টা থেকে ৪টা ১০ মিনিট পর্যন্ত লেখক অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে প্রতীকী ধর্মঘট পালন করেছেন প্রকাশকরা। এসময় মেলায় আগত লেখক পাঠক প্রকাশক দশমিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে মৌন প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল ও অবরোধের মধ্যেও এবার প্রায় ২২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। যা গতবছরের তুলনায় সাড়ে ৫ কোটি বেশি।

২৮ ফেব্রুয়ারি শনিবার মেলার শেষদিন সকাল ১০টায় দুয়ার খোলে গ্রন্থমেলার। বসন্তের সকালেই একচোট গ্রন্থানুরাগীর ঢেউ বয়ে যায় মেলার শরীরজুড়ে। আর বিকেল থেকেই যেন অদ্ভুত রূপে রাঙা হয়ে ওঠে মেলা। পাঠকে পাঠকে ছেয়ে যায় মেলার দুই প্রান্তর। আর সে কারণেই প্রতিটি প্রকাশনা সংস্থাতেই ছিল বইপড়ুয়াদের ভিড়। বিক্রয়কর্মীরা সর্বদাই তৎপর ছিলেন পাঠকের হাতে তার পছন্দের বইটি তুলে দিতে। ফলে শেষ দিনে জ্ঞান ও প্রাণের এই সার্বজনীন মেলাটি হয়ে ওঠে মুখরিত। আর সন্ধ্যার পর বই কেনা মানুষের জনস্রোত প্রবল রূপ ধারণ করে। এদিন দর্শনার্থীর চেয়ে বইপ্রেমীর সংখ্যাই ছিল চোখে পড়ার মতো। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে নবীন-প্রবীণসহ সব বয়সী পাঠকের ভিড়ে স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে মেলার রূপ।

সব মিলিয়ে বলা যায় মেলার শেষ দিনে সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা-রাত বই নিয়ে কেটেছে প্রকৃত পাঠকের পুরোটা দিন। তবে মেলার বাকি ২৭ দিনের মতোই শেষ দিনেও মেলাঙ্গন ঘিরে ছিল বারোয়ারি পণ্যের পসরা। ফলে শেষ দিনেও ভোগান্তির কমতি ছিল না মেলায় আগতদের। টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশজুড়েই ছিল এই পণ্যের পসরা। এখানে পাইরেটেড বই থেকে হাঁড়ি, জুতো, স্যান্ডেল, কড়াই, খুন্তি, মুড়ি-মুড়কিসহ রকমারি পণ্যের দোকান। আর শেষ দিনেও মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি এ বিষয়ে ছিল নির্বিকার।

নতুন বই ৩৭০০টি
হরতাল-অবরোধ সত্ত্বেও এবারের মেলা ছিলো মানুষের পদচারণায় মুখর। ধারণা করা হচ্ছে, কোটি মানুষের সমাগম ছিল মাসজুড়ে। এবছর নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৭০০টি। প্রকাশের দিক থেকে এগিয়ে আছে কবিতা। প্রবীণ-নবীন কবি মিলিয়ে কবিতা এসেছে ৮৭৭টি, উপন্যাস ৬২৯টি, গল্প ৫৭৪টি। এছাড়া প্রবন্ধ ২০২, ছড়া ১৩৭, গবেষণা ১১৯, শিশুতোষ ৯৪, জীবনী ৯০, ভ্রমণ ৭৪, বিজ্ঞান ৭১, ইতিহাস ৫৪, মুক্তিযুদ্ধ ৫৩, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ৩৩, রম্য/ধাঁধা ৩০, ধর্মীয় ৩০, নাটক ২৯, কম্পিউটার ১৮, অনুবাদ ১২, রচনাবলী ও অভিধান ৭টি করে এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর এসেছে ৩৩টি নতুন বই। মাসজুড়ে নজরুল মঞ্চে মোড়ক উন্মোচন হয় পাঁচ শতাধিক নতুন বইয়ের।

বিক্রি ২২ কোটি টাকা
এবারের গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমিসহ সব প্রকাশনী মিলে বিক্রি হয়েছে প্রায় ২১ কোটি ৯৫ লাখা টাকার বই। গতবছরের তুলনায় যা সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা বেশি। গতবছর মেলায় বিক্রি হয় সাড়ে ১৬ কোটি টাকার বই।

এক নজরে এবারের মেলা
এবারের গ্রন্থমেলায় ৩৫৩টি ইউনিটে ৫৬৫টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। প্যাভিলিয়ন ছিল বাংলা একাডেমিসহ ১১টি। লিটল ম্যাগ চত্বরে ৭২টি প্রতিষ্ঠানকে তাদের প্রকাশনা প্রদর্শন ও বিক্রির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। ছোট ছোট প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যেসব লেখক বই প্রকাশ করেছেন তাদের বই বিক্রির সুযোগ করে দেওয়া হয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে। মেলা প্রাঙ্গণকে বিশিষ্টজনদের নামে ১১টি চত্বরে বিভক্ত করা হয়। স্মরণ করার হয় বিশিষ্ট গুণীজনকে।

লেখকদের জন্য ছিল মনোরম সাজে ‘লেখক আড্ডা’ শিরোনামে লেখককুঞ্জ। টেলিটকের আর্থিক সহায়তায় মেলার অবকাঠামো নির্মাণ ও সাজসজ্জার সব কাজ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি স্টেপ মিডিয়া লিমিটেড সম্পন্ন করে।

শনিবার মেলা মঞ্চে ছিল সমাপনী আয়োজন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি সচিব রণজিৎ কুমার বিশ্বাস।

এর আগে স্বাগত বক্তব্য রাখেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। মেলা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন মেলা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ। সভাপত্বি করেন একাডেমির সভাপতি এমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এবার প্রবাসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় অবদানের জন্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পুরস্কার পেয়েছেন ইকবাল হাসান ও সৈয়দ ইকবাল।

চিত্তরঞ্জন সাহা পুরস্কার পেয়েছে মাওলা ব্রাদার্স। শহীদ মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লিমিটেড ও পাঠক সমাবেশ। রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই) স্মৃতি পুরস্কার সময় প্রকাশন। চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল), প্রথমা ও জার্নিম্যান। সমাপনী আয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির হাতে পুরস্কার তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আসাদুজ্জামান নূর।

শেষ দিনে ১২৫ বই
শনিবার মেলার শেষ দিনে নতুন ১২৫টি বই এসেছে। এর মধ্যে গল্প ২১, উপন্যাস ২১, প্রবন্ধ ৮, কবিতা ৩৪, গবেষণা ৩, ছড়া ৩, শিশুসাহিত্য ১, জীবনী ৩, মুক্তিযুদ্ধ ১, নাটক ২, বিজ্ঞান ১, ভ্রমণ ৮, ইতিহাস ৩, স্বাস্থ্য ১, অনুবাদ ১ এবং অন্য বিষয়ের উপর এসেছে ১৪টি নতুন বই। এছাড়াও মেলার নজরুল মঞ্চে উন্মোচিত হয়েছে ১৫টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন।

মেলামঞ্চের আয়োজন
শনিবার মেলার সমাপনী দিনে মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘নাট্যকার শম্ভুমিত্র’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিল্প সমালোচক আবুল হাসনাত। আলোচনায় অংশ নেন হাসান ইমাম, মামুনুর রশীদ এবং এসএম মহসীন। সভাপতিত্ব করেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।

সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার, শাম্মী আখতার, তপন মাহমুদ, ফেরদৌস আরা, অদিতি মহসীন, সুজিত মোস্তফা, তালাত সুলতানা, ফারহানা ফেরদৌসী তানিয়া, সারোয়ার হোসেন এবং পারভীন আক্তার।

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।