ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

বইমেলা

বইমেলায় ভিক্ষুক!

আসাদ জামান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৬
বইমেলায় ভিক্ষুক! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বইমেলা থেকে: অমর একুশে গ্রন্থমেলার সপ্তম দিন রোববার (৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেল সাড়ে ৪টা। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানাংশে ঢুকে একটু সামনে এগুতেই কানে ভেসে এল-‘এট্টু সাহায্য কইরা যান, আমি অন্ধ, কডা টায়া দিয়া যান।


 
বাম দিকে ফিরে তাকাতেই দেখি ‘ভিক্ষুক ও হকারমুক্ত’ ঘোষণা দেওয়া অমর একুশে গ্রন্থমেলার একেবারে প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করছেন দৃষ্টিশক্তিহীন নুরুন নবী!
 
কোনো চিপা গলিতে নয়, মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানাংশে আইএফআইসি ব্যাংকের প্যাভিলিয়নের সামনে যে জায়গাটিতে তিনি দাঁড়িয়েছেন, সেখান থেকে ঐতিহ্য ও নান্দনিক প্রকাশনীর স্টল এবং অন্য প্রকাশের প্যাভিলিয়ন স্পষ্ট চোখে পড়ে।
 
আর ভিক্ষুক নুরুন নবীর সামনে রয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু পানির ফোয়ারা। অর্থাৎ মোক্ষম জায়গাটিই বেছে নিয়েছেন চল্লিশের কোঠায় পা রাখা পেশাদার ভিক্ষুক নুরুন নবী।
 
সফেদ পাঞ্জাবি ও কালো রংয়ের প্যান্ট পরা নুরুন নবী তার পাঞ্জাবির ঝুলানো অংশটা শাড়ির আঁচলের মত মেলে ধরে ভিক্ষা চাচ্ছেন। এরই মধ্যে দুই টাকা-পাঁচ টাকার বেশ কয়েকটি নোট জমা পড়েছে তার পাঞ্জাবির আঁচলে।
 
একটু দূরে দাঁড়িয়ে স্মার্ট ফোনে ক্লিক মারতেই বোঝা গেল, ভিক্ষুক নুরুন নবী সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তিহীন নন। তার শ্রবনক্তিও প্রখর। কারণ, প্রথম ক্লিকের পরই ক্যামেরার লেন্স খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন এবং ঠিক পোঁজটিই দিলেন তিনি।
 
কোন পাশ দিয়ে কীভাবে মেলায় ঢুকলেন-? কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই নুরুন নবীর উত্তর- পালাইয়া ঢুকি নাই। বড় গেট দিয়াই ঢুকছি।
 
কেউ বাধা দেয়নি- নুরুন নবীর পাল্টা প্রশ্ন, বাধা দিলে কি আর ঢুকতে পারতাম?
 
ঠিকই তো- বাধা দিলে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে ভিক্ষুক ও হকারমুক্ত অমর একুশে গ্রন্থমেলার ভেতর কীভাবে ঢুকে পড়লেন ভিক্ষুক নুরুন নবী এবং কীভাবেইবা মেলার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করছেন তিনি?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রথমেই ছুটলাম মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানাংশের মূল প্রবেশ পথে। কিন্তু সেখানে দায়িত্বপালনরত পুলিশ সদস্যরা এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি হলেন না। দেখিয়ে দিলেন ‘বাহির পথে’ (বেরনোর পথ) কর্তব্যরত এক পুলিশ কর্মকর্তাকে।  
 
সেখানে গিয়ে কথা হয় মেলায় কর্তব্যপালনরত নিউমার্কেট থানার উপ পরিদর্শক মো. মুরাদের সঙ্গে।
 
কিন্তু তিনি মেলায় ভিক্ষুক প্রবেশের দায় নিতে রাজি নন। তার সাফ কথা- আমি ‘বাহির পথের’ (বেরনোর পথ) দায়িত্ব পালন করছি। প্রবেশ পথ দিয়ে কে কখন ঢুকছে, সেটি দেখার দায়িত্ব আমার নয়।
 
পুলিশের এ উপ-পরিদর্শক পরামর্শ দেন মেলায় স্থাপিত র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (ৠাব) বা পুলিশ কন্ট্রলরুমে কথা বলার।
 
পরে ৠাবের কন্ট্রোলরুমে দায়িত্বপালনরত কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করলে তারা জানান, স্পেশাল দায়িত্ব পালন করছেন তারা। বিশেষ কোনো ঘটনা ছাড়া র‌্যাব মুভ করছে না। সার্বিক বিষয় দেখার দায়িত্ব পুলিশের।
 
এর পর পুলিশ কন্ট্রোল রুমে গিয়ে মেলার মধ্যে প্রকাশ্যে ভিক্ষাবৃত্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে দায়িত্বপালনরত পুলিশ সদস্য সাইফুল ইসলাম, ফারুক আহমেদ ও বিমল কর পাত্তাই দিলেন না।
 
এদের সাফ কথা, মেলা সম্পূর্ণ হকার ও ভিক্ষুকমুক্ত। মেলা তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও একজন হকার বা ভিক্ষুক পাওয়া যাবে না।
 
পরে মোবাইলে তোলা ছবি দেখালে নিজেদের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এলেও মেলায় এত নিউজ থাকতে ভিক্ষুকের পেছনে কেন লাগলাম- সে বিষয়টি জানতে চান পুলিশ সদস্য ফারুক আহমেদ।

অপর পুলিশ সদস্য সাইফুল ইসলাম শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক মামুন ফরাজীর ফোন নম্বর দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পুলিশ কন্ট্রোলরুমের দায়িত্ব নাকি তিনিই পালন করছেন।
 
পরে মামুন ফরাজীকে ফোন দিলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের ভিঁড়ে মিশে গিয়ে হয়তো দুয়েকজন ভিক্ষুক ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আমরা দেখা মাত্রই ব্যবস্থা নিচ্ছি।
 
তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, সাদা পাঞ্জাবি ও কালো প্যান্ট পরা লেফাফা দুরস্ত নুরুন নবী ফাঁক-ফোকর গলে মেলায় ঢুকে পড়েছেন। পুলিশ সদস্য বা প্রবেশ পথে দায়িত্ব পালনরত নিরাপত্তাকর্মীরা ঠিক চিনে উঠতে পারেননি- নুরুন নবী একজন পেশাদার ভিক্ষুক!
 
কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় যে ঘটনা ঘটল- সেটিকে রীতিমত ‘পড়বি পর মালির ঘাড়ে’ বলা চলে।
 
বাংলানিউজের স্টলে যখন এই রিপোর্ট তৈরি হচ্ছিল, ঠিক সেই সময় পাটের চট পরা একজন নারী ভিক্ষুক এই প্রতিবেদকের কাছে এসে হাজির। হাত বাড়িয়ে চাইছে সাহায্য।
 
ছবি তোলার প্রস্তুতি নিতেই বহুত সেয়ানা ভিক্ষুক হন হন করে হাঁটতে শুরু করলেন। পেছন পেছন ছুটেও তার সামনের দিক থেকে একটা ছবি নেওয়া সম্ভব হল না। পরে অবশ্যই ফটোগ্রাফার পাঠিয়ে ছবি সংগ্রহ করা হয় ‘হকার ও ভিক্ষুকমুক্ত’ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পাটের চট পরে ভিক্ষারত অপ্রকৃতস্থ ওই নারী ভিক্ষুকের।   
 
বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৬
এজেড/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।