অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে: গোপালগঞ্জ থেকে মেলায় এলাম। বই বলে কথা, বইয়ের জন্য জার্নি করে এতোদূর থেকে চলে আসা কোনো বিষয়ই নয়! বাড়িতে ব্যক্তিগত একটা পাঠাগার আছে, প্রতিবছর গ্রন্থমেলা এলে আমার সে পাঠাগারে বসন্ত লাগে যেন!
বসন্তের ঠিক তিনদিন আগে এভাবেই বইয়ের প্রশ্নে ঋতুরাজকে মনে করিয়ে দিলেন তাসলিমা।
সকাল সকাল রওয়ানা দিয়ে দুপুরের মধ্যেই তিনি পৌঁছে গেছেন। ভেবেছিলেন মেলা ২টা থেকে শুরু হয়, কিন্তু তার সে ধারণা ভুল ছিলো। যথারীতি বিকেল ৩টায় মেলার মাঠে প্রবেশ করলেন তিনি। তার আগে কিছু সময় আলাপকালে জানা গেলো আরও নানা কথা।
মঙ্গলবার ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখ। মেলারও নবম দিন। বাংলা একাডেমির গেটে দাঁড়িয়ে তাসলিমা বাংলানিউজকে বলেন, বই পড়তে খুব ভালোবাসি। প্রতি বছরই অনেক টাকার বই কেনা হয়। মনে করি ঈদে যেমন মানুষ কেনাকাটায় কার্পণ্য করেন না, তেমনি ফেব্রুয়ারি এলে বই কেনায় কার্পণ্য রাখেন না কেউ।
রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন স্কুলের অষ্টম ও চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শামস এবং সাইমন। বাবা হাবিবুর রহমানের সঙ্গে মেলায় উপস্থিত তারা। হাবিবুর রহমান পুলিশের এসবিতে কর্মরত। টানা ডিউটি শেষে দুপুর ২টা থেকে পেয়েছেন ছুটি। তবে দুই সন্তানের বইয়ের আবদার মেটাতে চলে আসতে হলো মেলায়। এ বিষয়ে হাবিবুর বলেন, ভালো কাজের বায়নার জন্য যে কোনো বাবা-মাই কষ্ট মেনে নেবেন বলে মনে করি। ছেলেদের বইয়ের শখ জেগেছে- তাই ছুটে এলাম।
‘এই শখ যদি অভ্যাস করিয়ে দিতে পারি তবে আমার আর ওদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে না’- যোগ করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
তার একটু আগের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। স্টলের পর্দা খুলে বসে পড়েছেন বিক্রেতারা। একে একে দর্শনার্থীদেরও ভিড় হচ্ছিলো। তখনও বাংলা একাডেমির পুকুরে হাঁসদের গোসল যেন শেষ হয়নি। রোজকার দৃশ্য হলেও এতো মানুষজন হুট করে ঢুকে যাচ্ছেন একে একে- এতে হাঁসদের যে কী লজ্জা! দ্রুত পুকুর থেকে উঠে গিয়ে তারা স্থান নিলো লিটলম্যাগ চত্বরের পেছন অংশে।
সঙ্গে দৌড়ে বেড়ানো কুকুর ছানারাও ঢুকে পড়লো পেছনের শৌচাগারের দেয়ালের ভাঁজে। এখন যে শুধুই বইপ্রেমীদের পদচারণার সময়। গত কয়েকদিনের পরিস্থিতি অবলা প্রাণীদেরও যেন তাই শিখিয়ে দিয়েছে।
সোমবার (০৮ ফেব্রুয়ারি) দিনগত রাতের বৃষ্টিতে প্রকৃতিতে যেন একটা পরিবর্তন মনে হচ্ছে! যেন মাঘের ছায়া ধুয়ে বসন্তের অবয়ব তৈরি করলো বৃষ্টি। হালকা শীতল বাতাসও বইছে। এখনই তো সময় শান্ত-স্নিগ্ধ এই পরিবেশে পছন্দের বইটি নেড়েচেড়ে দেখার। নেই ধুলা-বালি নেই কোনো ময়লা পরিবেশ। এমন পরিবেশে বই নাড়ানাড়িতে যদি প্রকৃতির শীতল বাতাসে আরও একটু খুসবু ছড়ায়, দোষ কী তাতে!
বৃষ্টিতে অবশ্য বেশ কয়েকটি দোকানে টিপটিপ পানি পড়েছে। রাতে স্টল বন্ধের সময় প্লাস্টিক না দেওয়ায় সামান্য কিছু জল ভিজিয়েছে বই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ সমস্যাটি মূলত বেশি।
সেখানে পাতাবাহার প্রকাশনীর নাজিয়া মেহজাবিন বাংলানিউজকে বলেন, রাতে বৃষ্টিতে পানি পড়ে অনেকগুলো বই ভিজে গেছে। আমি ও আমার স্বামী কাজী মারুফ হোসেন মিলে তা শুকাতে চেষ্টা করছি। মূলত এটি আমার বাবা মুস্তফা পান্নার প্রতিষ্ঠান। আমরাই দেখাশোনা করি, ভুল আমাদেরই। রাতে ফেরার সময় একটু সতর্ক থাকলে হয়তো এমন হতো না।
এখন প্রকৃতিই তো এমন- যেন যেকোনো সময় বৃষ্টির শঙ্কা থেকে সচেতন থাকতে হবে বলেও মত দেন নাজিয়া।
ব্যাংক কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম ও সোলায়মান। রীতিমতো অফিস ফাঁকি দিয়ে মেলায় চলে এসেছেন! মুখ ফসকে তা বলেও ফেললেন। তারা জানান, রাতে পড়ার জন্য বই লাগবে। বই পড়তে পড়তে ঘুমানোর অভ্যাস। এতে নাকি ভালো ঘুম হয়। গ্রন্থমেলায় এ বছর নতুন কী এলো তা নিতে চলে আসা তাদের।
ওদিকে (মেলা শুরুর আগেই) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পানি নিয়ে প্রবেশ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বড় পানিবাহী যান। সেখানকার পুলিশ সমন্বয়ক উপ-পরিদর্শক (এসআই) মামুন ফরাজি ব্রিফ সারেন প্রতিদিনের মতো তার নারী ও পুরুষ কনস্টেবলদের সঙ্গে। আবার এপারে অর্থাৎ, বাংলা একাডেমি অংশে সেখানকার সমন্বয়ক উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাহফুজও যথানিয়মে ব্রিফ সম্পন্ন করেন।
পুলিশের এমন চিত্র চোখে পড়ছিল, তখনই পানের আড়তদার আবদুস সামাদের ঘোরাফেরাটা একটু দ্রুত দ্রুতই মনে হলো। সকালে মেলা খুলেছে ভেবে তিনি অনেক বেশি আগে চলে আসেন। কথা বলে জানা গেলো বাসা সাভার। ইচ্ছে ছিল বই কিনে বিকেলেই বাড়ি ফিরবেন, তবে মেলার সময় জেনে বিকেলকে সন্ধ্যার মধ্যে নিয়ে এসেছেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পত্রিকায় পড়েছি ১৫৫ নম্বর স্টলে ডা. আলমগীর মতির বই পাওয়া যাচ্ছে, যা সবার আগে কিনবো। এরপর অন্য বই ভালো মনে হলে নিয়ে যাবো।
সামাদ বলেন, মেলায় ঘুরে দেখেশুনে বই কিনবো বলেই ছুটে চলে আসা। এক্ষেত্রে দূরত্ব বা দেরি হয়ে যাওয়া কোনো বিষয় নয়। দুপুরে ভাত খাইনি এখনও বই কিনেই খানিক খেয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দেবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৬
আইএ/এএ