ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

ফাগুনের আগুন ছিলো বইমেলায়

আদিত্য আরাফাত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৬
ফাগুনের আগুন ছিলো বইমেলায় ছবি: জি এম মুজিবুর / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বইমেলা থেকে: ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/ আমার আপনহারা প্রাণ/আমার বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ/ তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান...। ’

সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ-তরুণী খালি গলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক প্রান্তে গোল হয়ে বসে ধরেছিলেন এ গান।

সে গানের সুর যেনো ছড়িয়ে গেছে মেলাজুড়ে।

শনিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) পুরো বইমেলার চিত্রই ছিলো অন্যদিনের চেয়ে ভিন্ন। গত ১২ দিনের চেয়ে ১৩তম দিনের পরিবেশ আলাদা। মেলার এ পরিবর্তন এনে দিয়েছে ফাল্গুন। এদিন ফাগুনের আগুন ঝরেছিলো প্রাণের এ মেলায়!

এদিন মেলাজুড়ে নেমেছিলো বসন্ত। বাসন্তী রঙের শাড়ি, কপালে লাল টিপ, খোঁপায় হলুদ গাঁদাফুল আর হাতভর্তি কাচের চুড়িসহ সুসজ্জিত তরুণীদের পদচারণায় মুখরিত ছিলো বইমেলা।
 
এক হাতে প্রিয়জনের হাত, অন্য হাতে সদ্য কেনা বই। গালে-কপালে বাহারি আলপনা। ছেলেরাও কম যান না! হলুদরঙা পাঞ্জাবি ও ফতুয়া পরে নতুন সাজে সেজেছিলেন তারাও।

মেলায় আসা বেশিরভাগই ছিলো কপোত-কপোতিরা। প্রিয়জনের হাত ধরে তারা মেলা ঘুরেছেন, দেখেছেন আর বই উপহার দিয়েছেন।

এদিন মেলাজুড়ে ছিলো ফাল্গুনের হু হু বাতাস। সে বাতাস যেনো বই মেলায় আগতদের দেহমনে শীতলতা ছড়িয়ে দিয়েছে।

রাজধানীতে বসন্তের উৎসব মানেই যেনো অমর একুশে গ্রন্থমেলা। শত ব্যস্ততার মাঝেও অনেকেই ফাল্গুনের প্রথম দিনটিতে চলে আসেন বইমেলায়।

শনিবার বেলা ১১টা থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রবেশ দ্বার খোলে। বেলা যতো বাড়ে লেখক-পাঠক আর প্রকাশকের পদচারণায় মুখরিত হতে থাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। সন্ধ্যা নামতেই যেনো সব পথ মিশে যায় মেলার দুই প্রাঙ্গণে।

কেউ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এসেছেন, আবার কেউ একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে উদ্যানে প্রবেশ করেছেন। দর্শনার্থীরা বই কিনুন আর না কিনুন, তাদের পদচারণায় মুখরিত হতে থাকে বইমেলা।

প্রকাশকরাও অপেক্ষায় থাকেন এ দিনটির। বিশেষ দিন মানেই বিক্রি-বাট্টা ভালো। কয়েকজন প্রকাশক জানান, অন্যদিনের তুলনায় শনিবার বই বিক্রিও হয়েছে বেশি।

দুপুরে অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণে আসেন পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক। এসময় তিনি বইমেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখেন। পরে সাংবাদিকদের বলেন, বইমেলার সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখতে মেলায় আসা। এ পর্যন্ত বইমেলায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। মেলায় নিরাপত্তাসহ পরিবেশ ঠিক রাখতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট সতর্ক আছে।

বই কিনেছেন কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি আজ বই কিনতে আসিনি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখতে এসেছি।

অটোগ্রাফ-সেলফি প্লিজ...
শুক্রবার প্রথমবারের মতো এবারের বইমেলায় এসেছিলেন জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। শনিবারও আসেন তিনি।

বিকেল সোয়া ৪টার দিকে নজরুল মঞ্চে আসেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এসময় তরুণ লেখক মোস্তফা মনোয়ারের ‘গণিতের হাত-পা ও রুবিক্স কিউব’ বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন।

উন্মোচন শেষে তিনি বলেন, নতুন লেখকরা অনেক কষ্ট করে বই লিখছে। তাদের বইতে রয়েছে যত্নের ছাপ। আমি চাই, আরও অনেক তরুণ বই লিখবে।

মোস্তফা আনোয়ারের বইটি গণিতপ্রিয় শিশু-কিশোররা পড়বে, এমনটাই আশা করেছেন তিনি।

শনিবার দুপুর থেকেই বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রের মাইক থেকে ভেসে আসে জাফর ইকবাল আসার খবরটি।
 
এ সংবাদ শোনামাত্র বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের দিকে ছুটতে দেখা গেল অনেককে। এসময় অনেকেই তার অটোগ্রাফ নেন। সেলফি'র জন্য অনুরোধ করেন। তিনিও অনুরোধে সাড়া দেন।

এরপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের হুমায়ূন চত্বরে গড়া নতুন মঞ্চটিতে আসেন। এবারের মেলায় প্রকাশিত সবকটি সায়েন্স ফিকশন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি।

অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রথম সায়েন্স ফিকশন বই লেখেন হুমায়ূন আহমেদ। তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই।

এখানেও দীর্ঘসময় অটোগ্রাফ ও সেলফিতে হাসিমুখ দেন তিনি। শিশুরাও অটোগ্রাফের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর।

জনপ্রিয় এ লেখক বলেন, লিখিতো তাদের জন্য। তারা পড়ছে- এটি আমাদের সৌভাগ্য। দায়িত্ব আরও বেড়ে যায় তাদের এ আগ্রহ দেখে। মনে হয়, আরও ভালো লিখতে হবে। তাদের খুশি-খুশিতে জ্ঞানের দিকে আগ্রহী করতে হবে।

এ শিক্ষাবিদ আরও বলেন, চমৎকার অনুভূতি হয় মেলায় এসে। খুব ভালো লাগে। কচি কচি হাতে ওরা বই নেড়েচেড়ে দেখছে, আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
 
নতুন বই
বাংলা একাডেমির তথ্যমতে শনিবার মেলায় এসেছে ১৩৫টি নতুন বই। এর মধ্যে গল্প ২৫, উপন্যাস ২২, প্রবন্ধ ১, কবিতা ৪২, গবেষণা ৩, ছড়া ৫, জীবনী ৫, রচনাবলী ১, মুক্তিযুদ্ধ ৬, নাটক ১, বিজ্ঞান ১, ভ্রমণ ৩, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ১, কম্পিউটার ১, সায়েন্স ফিকশন ১ ও অন্যান্য ১৭টি।

উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- আগামী থেকে হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘শুচিতা’, আফসার ব্রাদার্স থেকে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘যখনি জাগিবে তুমি’, মাওলা ব্রাদার্স থেকে মহাদেব সাহার ‘মধুর মুহূর্তগুলি চলে যায়’, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে শাহনাজ মুন্নীর ‘থেমেছে শহর’, প্লাটফর্ম এনেছে আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়,’ ঝিঙেফুল এনেছে রণজিৎ কুমার বিশ্বাসের ‘দুরন্ত দুপুর’, কাব্যগ্রন্থ এনেছে তুষার আবদুল্লাহর ‘তোমাকে পাঠ করিব’, অন্যপ্রকাশ এনেছে ‘সেলিনা হোসেনের সেরা ১০ গল্প,’ পূরবী বসুর ‘সেরা ১০ গল্প’, বটেশ্বর বর্ণন এনেছে আলী ইমামের ‘জাতক কাহিনী’, কথা প্রকাশ এনেছে আহসান হাবীবের ‘অরম্য রম্য’, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী এনেছে ‘বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির ‘ভাষা আন্দোরনের দলির সংকলন’, স্বরবৃত্ত এনেছে সেলিনা হোসেনের ‘সোনার তরীর ছোট মনিরা’, শামীম পাবলিশার্স এনেছে শাহজাহান আবদালীর ‘ছোটদের প্রিয় শেখমুজিব’।

হরিশংকর জলদাসের ‘একলব্য’
শনিবার বিকেল ৫টায় বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান হলে প্রকাশনা উৎসব হয় জনপ্রিয় লেখক হরিশংকর জলদাসের এপিকধর্মী উপন্যাস ‘একলব্য’-এর। মহাভারতের দুর্দমনীয় প্রান্তজন একলব্যকে নিয়ে এটি বাংলাভাষায় রচিত প্রথম উপন্যাস, যেখানে আর্য সমাজ ব্যবস্থার পাশাপাশি ব্রাত্যজনের জীবনও সুনিপুণভাবে এঁকেছেন লেখক। বইটি প্রকাশিত হয়েছে অন্যপ্রকাশ থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ‘একলব্য’ বইটি নিয়ে আলোচনা করেন কথাশিল্পী জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও ইমদাদুল হক মিলন। স্বাগত বক্তব্য দেন অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম।

অর্থমন্ত্রীর রচনাবলির পাঠ উন্মোচন
উৎস প্রকাশনী প্রকাশ করেছে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের রচনাবলি। ১০ খণ্ডে এ রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমির শামসুর রাহমান হলে বইগুলোর পাঠ উন্মোচন করা হয়।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ও অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ।

শনিবারের আয়োজন
সকাল ১০টায় বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় শিশুকিশোর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন শিশুসাহিত্যিক সুজন বড়ুয়া, নাট্যজন মাসুম রেজা এবং বাংলা একাডেমির পরিচালক শাহিদা খাতুন।

মূলমঞ্চের আয়োজন
বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধচর্চা: অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক মেসবাহ কামাল। আলোচনায় অংশ নেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ড. মোহাম্মদ সেলিম ও দিব্যদ্যুতি সরকার।

সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক সনৎকুমার সাহা। অনুষ্ঠানের শুরুতে সদ্যপ্রয়াত কবি কায়সুল হকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী নিমাই মণ্ডল ও তামান্না নীপা। সোহেল রহমানের পরিচালনা নৃত্য পরিবেশন করেন নৃত্য সংগঠন ‘শিখর কালচারাল অর্গানাইজেশন’-এর শিল্পীরা।

রোববারের আয়োজন
রোববার মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায় ও চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা: অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ।

আলোচনায় অংশ নেবেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, অধ্যাপক করুণাময় গোস্বামী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ। এছাড়া প্রতিদিনকার মতো সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

একইসঙ্গে বিকেল ৪টায় বাংলা একাডেমির শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে বিরূপাক্ষ পাল রচিত ‘সিডনির পথে পথে’ বইটির প্রকাশনা উৎসব।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৬
এডিএ/এসএস

** শিক্ষার্থীদের জন্য বই কিনে ‘সেরা ক্রেতা’ ফজল মাহমুদ
** বইমেলা জুড়ে রঙের মেলা
** ইন্দ্রজিৎ সরকারের নতুন দুই কিশোর উপন্যাস
** শাহ ইয়াছিন বাহাদুর পুঁথিনিলয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ
** বাতিঘর এনেছে ভাগ্যধন বড়ুয়ার দ্বিতীয় কবিতার বই
** জাফর ইকবালকে ঘিরে অটোগ্রাফ-সেলফির বন্যা
** অন্যপ্রকাশে সিদ্ধার্থ হকের নতুন কবিতার বই
** বইমেলায় ‘তনিমার সুইসাইড নোট’
** লেখক-পাঠকের র‌্যালি, থাকবেন জাফর ইকবাল

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।