ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

কথা না রাখাই ঐতিহ্য প্রকাশনী ‘ঐতিহ্য’র!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৭
কথা না রাখাই ঐতিহ্য প্রকাশনী ‘ঐতিহ্য’র! ঐতিহ্য প্রকাশনীর লোগো

ঘটনা-১
বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রাকিবুল ইসলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র। ২০১৩ সালে ঐতিহ্য প্রকাশনীর বিশেষ আয়োজন ৩০ খণ্ডের রবীন্দ্র রচনাবলি নেওয়ার জন্য অগ্রিম পাঁচ হাজার টাকা জমা দেন।

তখন ঐতিহ্যের পক্ষ থেকে বিশেষ ঘোষণা ছিলো, যারা অগ্রিম পাঁচ হাজার টাকা জমা দিয়ে বুকিং দেবেন, তারা বিশেষ প্যাকেজ ১২ হাজার ৫শ টাকায় গোটা রচনাবলি পাবেন। বইমেলাতে এই রচনাবলির দাম রাখা হবে ২০ হাজার টাকার উপরে।

সেবছর বইমেলায়ই তারা সংকলন হাতে পাবেন, এমনটি কথা হয়।

বাকি অভিজ্ঞতা শোনা যাক রাকিবের মুখেই, আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সৈয়দ আকরম হোসেনের সম্পাদনায় রবীন্দ্র রচনাবলি বের হচ্ছে শুনে আগ্রহ দেখিয়েছিলাম। আমি নিজেই অনেক সহপাঠী-বন্ধু-সহকর্মীকে বলেছি সংগ্রহে রাখার জন্য। তারা আমার কথামতো বিশেষ প্যাকেজে রচনাবলি পেতে অগ্রিম টাকা জমা দেন।  

‘আমাদের বলা হয়েছিল, পরের বইমেলাতেই রচনাবলি হাতে পাবো। বইমেলা এলো, কিন্তু রচনাবলির দেখা নেই। যোগাযোগ করলে বলা হলো, মেলার শেষে আসবে। এলো তো না-ই, এরপর আট-নয় মাস কোনো খবর নেই। ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫- তিন বছর কেটে গেলো কিন্তু আমরা কেউই রচনাবলি হাতে পাইনি। খোঁজ নিলেই তারা নিজেদের হাজারটা সমস্যা দেখায়। আসবে, আসছে করে কিন্তু আসে না। ’

তিন বছর যাওয়ার পর বলা হলো, তারা বই দিতে পারছেন না, কেউ চাইলে অগ্রিম দেওয়া টাকা ফেরত নিতে পারেন। আমার বাকি সহকর্মী-বন্ধুরা টাকা ফেরত নেওয়ায় আমিও নিয়ে নেই, বলেন রাকিব।

তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, তারা শুধু ক্রেতাদের ভোগান্তি আর সম্মান নষ্ট করেননি- আকরম স্যারের মতো একজন গুণী শিক্ষকের সম্মানও নষ্ট করেছেন।

রবীন্দ্র রচনাবলি নিয়ে একই অভিজ্ঞতা জানান জামান নামে এক সাংবাদিক।  

তিনি বলেন, ঐতিহ্যের এই আচরণে আমরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। বিশেষ করে আমার মতো অনেকেরই সুযোগ ছিলো, তাদের কথা দিয়ে কথা না রাখার বিষয়টি গণমাধ্যমে তুলে ধরার। কিন্তু নানা কারণে আকরম স্যারকে সম্মান করি। তিনি এটির সঙ্গে জড়িত থাকায় আমরা বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্য করিনি।

অনেক তরুণ লেখককে বই করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শেষ পর্যন্ত না করার অনেক ঘটনা শুনেছি। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়, যোগ করেন জামান।  

ঘটনা-২
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণ লেখকের বই করার প্রতিশ্রুতি দেয় ঐতিহ্য। পাণ্ডুলিপি নেওয়া পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো ওই তরুণ লেখকের। কিন্তু মেলার আগ থেকে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় প্রকাশনীটি।

এ নিয়ে ওই লেখকের বক্তব্য, চলতি মেলার (২০১৭) তিন-চার মাস আগে ঐতিহ্যের প্রধান নির্বাহী পাণ্ডুলিপি জমা নেন। বইটি প্রকাশে তার নিজেরও আগ্রহ ছিলো। মেলায় আসছে এরকমই কথা হয়। কিন্তু মেলার ঠিক দু’মাস আগে থেকে তিনি আর ফোন ধরেন না, মেসেজের উত্তর দেন না। আমি নানাভাবে তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু কোনোভাবেই তিনি সাড়া দেননি।

‘মেলার ঠিক ২০-২৫ দিন আগে হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে তার সঙ্গে কথা হয়। পারিবারিক অনেক সমস্যার কথা শোনান এবং এ কারণে যোগাযোগ করতে পারেননি বলে জানান। সেইসঙ্গে এটিও নিশ্চিত করেন, বই মেলাতেই আসছে। এরপর আবার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মেলাও চলে আসে। মেলার ঠিক চার-পাঁচদিন আগে একদিন ফোন করে বলেন, তিনি দুঃখিত এবং বইটি এই মেলায় প্রকাশ করতে পারছেন না’।

খুব দুঃখ করে লেখকটি বলেন, খুশি হয়েছিলাম যে, ঐতিহ্যের মতো প্রকাশনী বইটি করছে। কাছের মানুষদের খুশিমনে জানিয়েও ছিলাম। কিন্তু এমন সময় তিনি অপারগত‍া জানান, যখন বইটি অন্য কোথাও থেকে করার বাস্তব অবস্থা নেই। অথচ আমার এই বইটি করার ব্যাপারে অন্য দুই-তিনটি প্রকাশনী আগ্রহী ছিলো। ঐতিহ্য করছে বলে তাদের না করেছি। এখন তাদের কাছে কীভাবে যাই! একটি বই একজন লেখকের কাছে কতোটা আবেগের জায়গা দখল করে থাকে, প্রকাশক হিসেবে তার বোঝা উচিত।

এরকম আরও অনেকের সঙ্গেই এমন ঘটেছে বলে জানান তিনি।

এবং অন্যান্য
বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পে ‘ঐতিহ্য’ একটি পরিচিত নাম। ২০০০ সালে আত্মপ্রকাশ করা এ প্রতিষ্ঠানটি এর মধ্যেই কাটিয়ে ফেলেছে দীর্ঘ ১৬ বছর। যা সময়ের বিচারে নেহাত কম নয়।  

বিষয়গুলো তুলে ধরে মতামত চাওয়া হয় বইমেলায় আসা দীপেন ধর নামে এক উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকের কাছে। তিনি বলেন,  আমাদের গোটা প্রকাশনা শিল্পই অপেশাদার কার্যক্রমে জর্জরিত। অধিকাংশ প্রকাশনীর ক্যাটালগ অনুযায়ী ২০১৭ সালে প্রকাশিত বইয়ের তালিকা ধরে বই কিনতে গেলে শুনি, ‘এখনও মেলায় আসেনি, পরে যোগাযোগ করেন’। ১৫ দিন পার হয়ে গেলো, আর কবে বই আসবে!

ঐতিহ্যের অনেক সুনাম শুনি। কিন্তু তাদের মতো পুরনো প্রকাশনীর কাছে এরকম আচরণ আশা করা যায় না। এসব করবে ‘মৌসুমী প্রকাশক’রা। লেখকের বই প্রকাশ করতে না পারলে যথাসময়ে তাকে জানানো উচিত, বলেন তিনি।  

রাকিব, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই লেখকের মতো অনেকেই বাংলানিউজে ফোন করে ঐতিহ্য প্রকাশনীর ব্যাপারে তাদের অভিযোগ জানিয়েছেন।

তারা জানান, প্রতিশ্রুতি দিয়ে বই প্রকাশ না করা এবং প্রকাশ যে করতে পারছে না, সেটি জানানোর বিন্দুমাত্র প্রয়োজন বোধ না করার রোগ ঐতিহ্যের পুরনো। এমনকি, লেখক ও সংশ্লিষ্টরা নিজ দায়িত্বে জানার চেষ্টা করলেও তাতে সাড়া দেওয়া হয় না। প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য হারে এমন ঘটনা বাড়ছে। এ থেকে বাদ যায়নি রবীন্দ্র রচনাবলির মতো বড় সংকলনও। বিষয়টি যেনো এমন, কথা দিয়ে কথা না রাখাই ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ঐতিহ্য প্রকাশনীর।

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।