ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

আপডেট ভুলে গেছে বাংলা একাডেমি!

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৭
আপডেট ভুলে গেছে বাংলা একাডেমি! বইমেলায় বড়দের সঙ্গে উচ্ছ্বসিত শিশুরাও। ছবি: ডিএইচ বাদল

বইমেলা ঘুরে: নজরুল উল্টে গেলো হুট করে। বেয়াড়া বাতাসের হালকা ধাক্কাতেই মুখ থুবড়ে পড়ার দশা হলো জাতীয় কবি নজরুলের ছবি সম্বলিত নির্দেশিকার। তাই না দেখে অস্ফুটে ‘আহা আহা’ করে উঠলো বন্ধ গেটের গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এক স্কুল পড়ুয়া কিশোরী। তারপর চিৎকার জুড়লো- এই যে ভাই, এই ভাই। ওটা তো পড়ে গেলো। তুলে দেন। তুলে দেন।

গ্রিলের ওপাশে চেয়ার পেতে আয়েস করে বসে থাকা সমাধী কর্মী একটু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। কেবল বললেন, আজ সব বন্ধ।

একুশে ফেব্রুয়ারির মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবসে নজরুল ইসলামের সমাধি প্রাঙ্গণ কেন বন্ধ রাখা হলো সে প্রশ্ন ক’জন দর্শনার্থী তুললেন বটে, কিন্তু কোনোটারই জবাব দেবেন না বলে যেনো পণ করেছেন চেয়ারে আসীন নিরাপত্তা কর্মী। এমনকি উল্টে পড়া সমাধি নির্দেশিকাটা তুলে যথাস্থানে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার কোনো গরজও দেখালেন না তিনি। ওটা তোলাও যেনো বন্ধ আজ।

আর এক নিরাপত্তা কর্মী এসে গ্রিলের জোড়া একটু ফাঁক করে তার বান্ধবীকে কেবল ঢুকিয়ে নিলেন ভেতরে। দর্শনার্থীদের ধমকে বললেন, সরেন, আপনারা সরেন।

ওপর থেকে বাংলা একাডেমির মূল প্রাঙ্গণ।  ছবি: ডিএইচ বাদলদর্শনার্থীহীন নজরুল সমাধি প্রাঙ্গণে আজ যেনো প্রেম উৎসব ওদের। অনতি দূরে একুশের বইমেলাকে কেন্দ্র করে গড়া ভাষা শহীদ বরকত তোরণে তখন সেলফি উৎসবে মত্ত দর্শনার্থীরা। দুপুরের খাঁ খাঁ রোদ তাড়ানো বসন্ত বাতাসটাই যা একটু প্রশান্তির পরশ ‍বুলাতে থাকলো শরীরে।

নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনী বুঝি একটু ক্লান্তই হয়ে পড়েছে মানুষের পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে। দিয়াশালাই-সিগারেট সার্চ করার গরজ দেখা গেলো না তাদের মধ্যে।

বর্ধমান হাউসের পাশে মূল মঞ্চের দর্শক সারির পেছনে প্রতিদিনকার অনুষ্ঠান সূচি আপডেট করতে ভুলে গেছে বাংলা একাডেমি। ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলেও টানানো রয়েছে ১৪, ১৫ আর ১৬ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান সূচি। এরপর ৫ দিন আর আপডেট হয়নি। কে জানে ওই কাজটাও একুশে ফেব্রুয়ারির ছুটির খাঁড়ায় পড়েছে কি না।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা ছড়িয়ে দেওয়ার পর জায়গা বেড়েছে লিটল ম্যাগ চত্বরে। কিন্তু ওটা পেরিয়ে পুকুরপাড়ে গড়া আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনের দেওয়ালে চোখ না আটকানোর জো নেই। ধাতব পাতে লেখা নজরুল ইসলামের ই অক্ষর উঠে গেছে স এর ওপরে। রবি ঠাকুরের কবিতার উদ্ধৃতিতে স্থানে স্থানে রঙই নেই। মধুসূদন দত্তের দ তো মনে হয় খুলেই পড়ে গেছে।

ময়লা জমা বাংলা একাডেমির পুকুর।  ছবি: ডিএইচ বাদলসামনের পুকুরটার পাড় জুড়ে দর্শনার্থীদের ভিড়। উৎসাহী নারী-শিশুরা পাড় থেকে তো নেমেই পড়েছে পুকুরের শুকনো অংশে।   গোটা ছয় রাজহাঁস এই পুকুরের পানিতে জলকেলি করার কথা থাকলেও ওগুলো কোথায় যে বেড়াতে গেছে কে জানে। একটাও চোখে পড়লো না কোথাও।

পুকুরজুড়ে কাগজের উচ্ছিষ্ট ভাসছে। ময়লা পানিতে ভাসতে ভাসতে যেনো দাঁত ভেংচাচ্ছে দর্শনার্থীদের শখ করে তৈনি কাগজের নৌকাগুলো। দফায় দফায় ছাড়া শোল-তেলাপিয়া বুঝি দর্শনার্থীদের চাপে ভয় পেয়েছে। একটাকেও নড়তে দেখা গেলো না কোথাও।

মিলনায়তনের সামনে পুকুর পাড়ে গড়া হাউসটার লাল লাল মাছগুলো কোথায় গেলো কে জানে। ময়লা পানিতে দর্শনার্থীদের বোতল ফেলে যাওয়াই বুঝি নিয়ম এখানে।

বইমেলায় ক্লান্ত দর্শনার্থীরা।  ছবি: ডিএইচ বাদলপুকুরের দক্ষিণ পাড়ে পুরো চত্বর জুড়েই মেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি ইউনিয়নের লিজ নেওয়া  খোলা ক্যান্টিন। ছাউনির বাইরে পেতে রাখা চেয়ারগুলো যে বরাদ্দ জায়গার বাইরে তা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

বর্ধমান হাউসের সামনে গড়া মিডিয়া সেন্টারে ধুলোর গড়াগড়ি।   এককোণায় কেবল একটা ভাঙ্গা চেয়ার। বাংলা একাডেমিতে পুরনো অনুষ্ঠান সূচি।  ছবি: ডিএইচ বাদল

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বাংলা একাডেমির বিশাল তথ্য কেন্দ্রে কেবল স্টল নাম্বারের একটি তালিকা। সেটা ঠিক ঠাক বুঝিয়ে দেওয়ার লোকও পর্যাপ্ত নয়।   বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্টলে ব্যানার ছাড়া কিছুই নেই, এমনকি নেই কোনো কর্মীও।   ভেতরে ঢুকে সেলফি তুলছে ক’জন তরুণ। যেনো এই সেলফির জন্যই এখানকার এই স্টলটা।

বইমেলার ওয়াচ টাওয়ারে ঘুমন্ত পুলিশ।  ছবি: ডিএইচ বাদল বইমেলা জুড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা ৠাব আর পুলিশের ওয়াচ টাওয়ারগুলো অধিকাংশই খালি। একটাতে তো এক পুলিশকে রীতিমতো বসে বসে ঘুমাতে দেখা গেলো। আর একটাতে ওয়াচ টাওয়ার লেখা ব্যানারটাই কায়দা করে ধরে রোদ আড়াল করে ঝিমোতে লাগলেন আর এক পুলিশ।

বইমেলায় পুলিশের বিশুদ্ধ পানি।  ছবি: ডিএইুচ বাদল পুলিশ কন্ট্রোল রুমের পাশে বিনা পয়সায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের আয়োজন। কিন্তু বিশুদ্ধকরণ মেশিনে নয়, বালতিতে করে পানি বিতরণ করা হচ্ছে ওখানে। তাও এক বালতি বিতরণের পর অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে পরবর্তী বালতি না আসার। একটু দূরে ওয়াসার একটি প্লাস্টিক ট্যাংকি কড়া রোদে পুড়তে থাকলেও কোনো গ্লাস বা খাওয়ার পাত্র দেখা গেলো না সেখানে।

জায়গা বেশী হওয়ায় এবার সোহরাওয়ার্দী অংশের অধিকাংশ স্টলই পরিণত হয়েছে ৩ দিক খোলা সেলস সেন্টারে। এগুলোর ভেতর তো আবার কতোগুলোর চারিদিকেই খোলা। শিশুতোষ স্টলগুলোর কাউন্টার নিচু করে বই সাজিয়ে রাখা হয়েছে শিশুদের হাতের নাগালে। আর বইয়ের গায়ে বিকাশ নাম্বার লিখে দিয়েছে অবসর প্রকাশনী।

বাংলা একাডেমি আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিলে বিশাল জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বইমেলায় বিশ্রামের ব্যবস্থা নেই কোথাও। নারী-শিশুরা তাই সুযোগ পেলেই বসে পড়ছেন কোনো স্থাপনার দেওয়াল বা রাস্তার পাশের উঁচু জায়গায়।

সন্ধ্যার পর যেনো দাপট বাড়লো বাতাসের। ১২ কিলোমিটার বেগের বাতাস এক ঝটকায় উঠে যাচ্ছে ২৮ কিলোমিটার গতিতে।   ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াম তাপমাত্রায় তাই শরীরে বাতাসের আছড়ে পড়া ভালোই উপভোগ করছে দর্শনার্থীরা। দেবদারু আর নারিকেল গাছের ডগা অনবরত ডগা ঝাঁড়িয়ে যেনো বেয়াড়া বাতাসের সঙ্গে খেলছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।