ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

সেরা সাহিত্যের খরায় ভুগছে বইমেলা!

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৭
সেরা সাহিত্যের খরায় ভুগছে বইমেলা! বইমেলা ২০১৭

এবারের বইমেলায় সেরা বই কোনটি? দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেওয়া এই প্রশ্নে প্রতি দশজনে আটজনেরই উত্তর ছিলো- সেরা বই কোনটা জানি না। দুজনের উত্তরে দুটি ভিন্ন বইয়ের নাম এলো। তার মানেই হচ্ছে সেরা বই হিসেবে কোনও একক বই চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। 

প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে- তিন হাজারের বেশি নতুন বই এলো… সেসবের মধ্যে সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ একটি সেরা বইও কি রয়েছে... যা অনাগত কালে এই সময়টির… কিংবা এই বছরটির প্রতিনিধিত্ব করবে? 

কে করবে বইয়ের গুণবিচার? সে প্রশ্নটিও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।  

এটা নিশ্চিত যে, দেশে যারা প্রতিষ্ঠিত বইবোদ্ধা রয়েছেন তারা ব্যস্ত তাদের নিজেদের বই রচনায় আর প্রচারে।

অন্যের লেখা বই পড়ে তা নিয়ে দুটো ভালো কি মন্দ কথা বলার সময়ই কই তাদের! ফলে মেলায় কারো কোনও ভালো বই এলো কি না, তরুণদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভালো কে লিখছে তা দেখার সুযোগ, সময় তাদের মেলে না।  

কেউ কেউ তো বলছেন- এসব দেখার মতো মানসিকতাও তারা রাখেন না।  

তাহলে ভালো বই বিচারের জন্য যোগ্য বিচারক মেলা ভার।  

একটি কথাতো বলাই হয়, পাঠকই সবচেয়ে বড় বিচারক। পাঠক যে বই বেশি কিনবে সে বইই ভালো বই হিসেবে বিবেচিত হবে। এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তাই এমন উপসংহার এককথায় টেনে দেওয়া যাবে না। কারণ একজন জনপ্রিয় লেখক, সেরা লেখক নাও হতে পারেন সেকথা জনপ্রিয়রাও স্বীকার করেন।

আর বইমেলায় যে হাজারও মানুষ আসেন তারা সবাই বই কেনেন না… বই নেড়েচেড়ে দেখাই তাদের মূল লক্ষ্য। ফলে যারা ‘এলেন-দেখলেন-চলে গেলেন’দের দলে, তারা তো সেরা বইয়ের বিচার করতে পারবেন না। এরপর থাকলেন যারা বই কেনেন।  

এমন বই হাতে যারা ফিরছিলেন মেলা থেকে তাদের বক্তব্য ছিলো এমন যে, তারা জানেন না, এবারের সেরা বই কোনটি।

তাহলে সাহিত্যগুণের বিচারে সেরা বই এবার নেই।  

যারা নিয়মিত লেখেন এবং নিয়মিতই সেরা লেখক হিসেবে বিবেচিত হন, অন্তত জনপ্রিয়তার বিচারে, তাদেরই কেউ কি এবার এমন একটি বই এনেছেন যেটি তার অতীতের যে কোনও বইয়ের চেয়ে মানবিচারে অপেক্ষাকৃত ভালো? এমনটাও নয়। যদি হতো, তাহলে লেখকরা বিনয়ের সঙ্গে হলেও সে কথা এক-দুবার বলতেন। আর তারা না বললেও পাঠক ঠিকই ধরে ফেলে আওয়াজ দিতো। এই বইটি অতীতের যেকোনও বইয়ের চেয়ে ভালো। এবারের বইমেলায় তেমন কোনও আওয়াজ পাওয়া যায়নি।  

কথা হচ্ছিলো বাংলা একাডেমির পরিচালক জালাল আহমেদের সঙ্গে। দুই-তিনটি সেরা বইয়ের নাম জানতে চাইলে তিনি জানালেন অন্য খবর। বললেন, সেরা কিছু প্রকাশনা বাংলা একাডেমি এনেছে যা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে 'বিষাদসিন্ধু'র ইংরেজি অনুবাদ 'দ্য ওসান অব সরোজ'। তিতাস একটি নদীর নাম, শকুন্তলা এমন বেশ কয়েকটি কালোত্তীর্ণ ব্ই নতুন করে প্রকাশ করা হয়েছে। এসব ক্ল্যাসিকের মর্যাদা আগে পাঠকের মধ্যে যেমন ছিলো এখনও আছে। আর এই বইগুলো বেশ চলছে বলেও জানালেন।  

ভবিষ্যতে এমন কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠতে পারে এমন একটি বইও কি এবছর প্রকাশিত হয়েছে? সে প্রশ্নে সরাসরি ‘না’ উত্তরই দিলেন বাংলা একাডেমির এই পরিচালক। প্রতিবছর তার নেতৃত্বেই সেরা বইয়ের বাছাই কমিটি কাজ করে। ‘এই বছর তো দূরের কথা, গত কয়েক বছরেই কি এমন একটি বই প্রকাশিত হয়েছে যা পাঠকের কাছে কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠবে?’ পাল্টা প্রশ্ন জালাল আহমেদের।  
সেরা জানাশোনা লেখকদের বাইরে থাকে নতুন অজানা লেখকদের বইয়ের কথা। তারা কি লিখেছেন?

একটি কথা দৃঢ়তা ও বিশ্বাসের সাথে বলা যায়- একটি না একটি ভালো বই, যা সাহিত্যগুণের বিচারেই ভালো, আধেয়র কারণেই ভালো- এবারের বই মেলাতেও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তা থেকে গেছে স্রেফ অন্তরালে। কারণ সেগুলো নিয়ে গাওয়া হয়নি কোনও প্রশংসার গান। যিনি লিখেছেন তিনি যেমন নিভৃতে লিখেছেন, তেমনি নিভৃতেই থেকে গেছেন প্রকাশের পরেও।

এদের খুঁজে বের করতে হবে। আর সেজন্য দায়িত্ব নিতে হবে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থ সমালোচকদেরই। স্রেফ মলাট সমালোচনা করলে চলবে না, বইয়ের পূর্ণাঙ্গ রিভিউ করতে হবে। তাতে ভালো কিছু যদি থেকেও থাকে এই হাজার তিনেক কিংবা তারও বেশি বইয়ের ভিড়ে তা উঠে আসবে। তখন পাঠক সেসব বই পাঠের আগ্রহ দেখাবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, সেরা কিংবা কালোত্তীর্ণ হতে পারে এমন বই নেই সেকথা বলা যায়, তবে কয়েকটি বই ছিল যা গুরুত্বপূর্ণ ও সংগ্রহে রাখার মতো। এগুলো প্রবন্ধধর্মী ও প্রামাণ্য দলিল। এসবের মধ্যে ইতিহাসনির্ভর চিত্রকলার ওপর একটি চলচ্চিত্রের এবং অপর একটি জীবনীগ্রন্থ দৃষ্টি কেড়েছে। উপন্যাস কিংবা ফিকশনধর্মী এমন বইয়ের কথা একবাক্যে বলা কঠিন বলেই উল্লেখ করেন সার্বক্ষণিক লেখালেখি ও গবেষণার সঙ্গে জড়িত এই  অধ্যাপক। তবে তিনি এ-ও বিশ্বাস করেন এর মধ্যেও বইমেলায় দু'চারটি ভালো বই আসে, যেগুলো লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। বইগুলোর কথা সামনে আনতে মিডিয়াকে ভূমিকা নিতে হবে এই মত দিয়ে তিনি বলেন, এজন্য দক্ষ সাহিত্য-সমালোচকের অভাব প্রকট। বইগুলো পর্যালোচনা করে তা সামনে আনা প্রয়োজন। কিন্তু সে দায়িত্ব কে নেবে? সে প্রশ্ন রেখেই ফাহমিদুল হক বলেন, সাহিত্য সমালোচনা, বইয়ের সম্পাদনা ও  পেশাদারিত্ব জরুরি, যা আমাদের নেই বললেই চলে। প্রতিবছর হাজার হাজার বই প্রকাশিত হয়, যার ভিড়ে ভালো বইগুলো হারিয়ে যায় এটা যেমন সত্য, তেমনি ভালো সম্পাদনার অভাবে একটি ভালো রচনাও তার সকল সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলে, বলেন ফাহমিদুল হক।

এবার এমন কোনও একটি একক বই আসেনি যা নিয়ে কথা হচ্ছে। মুখে মুখে যার নাম ছড়াচ্ছে। কিংবা বোদ্ধামহলেও দু-চার কথা শোনা যাচ্ছে, এমন মত দিলেন বইমেলায় নিয়মিত যান এমন অনেকেই।  

বিষয়টি নিয়ে কয়েকজন প্রকাশকের সঙ্গেও কথা হয়। ভালো বই, মানের বিচারে কালোত্তীর্ণ হতে পারে এমন বই তারা যে পাচ্ছেন না সেকথা স্বীকার করলেন। একাধিক বড় প্রকাশক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন- সত্যিই এমন একটি বইও নেই যার কথা দায়িত্ব নিয়ে ফলাও করে প্রচার করা চলে।  

ভালো লেখকরা চলে যাচ্ছেন, ভালো লেখক তৈরি হচ্ছেন না, সে আক্ষেপও ঝরলো কোনও কোনও প্রকাশকের কণ্ঠে।  

কালোত্তীর্ণ বই রচনা কি তাহলে স্রেফ অতীতেরই বিষয় হয়ে রইলো? যে প্রশ্নে প্রকাশকরা বললেন, নতুন নতুন লেখক সৃষ্টি হলে তার মধ্য থেকে আবার বের হয়ে আসবে এমন লেখক।  

আর আশাবদ ছড়ালেন জালাল আহমেদও। তিনি জানান, পর্যবেক্ষণে দেখেছেন, এবছর পাঠকের চাহিদা, মেলায় বই ক্রেতাদের প্রবণতা থেকে তারা দেখতে পেয়েছেন পাঠকের মধ্যে সিরিয়াস বইয়ের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে।  

এটি একটি ইতিবাচক দিক, এমন মত দিয়ে জালাল আহমেদ বলেন, সিরিয়াস বইয়ের প্রতি, চটকদার সস্তা জনপ্রিয়তা থেকে সরে গিয়ে সাহিত্যমানে উন্নত বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ যখন বাড়ছে তখন ভবিষ্যতে লেখকরাও এমন বই রচনায় আগ্রহী হবেন।

এবছরে বই বিক্রির প্রবণতাও আগের বছরের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভালো বলেই জানায় বাংলা একাডেমি।  

বাংলাদেশ সময় ১৮৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৭
এমএমকে/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।