ঢাকা, বুধবার, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২ রবিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

বিদায় লগ্নে বই কেনার মিছিলে পুলিশও

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৭
বিদায় লগ্নে বই কেনার মিছিলে পুলিশও বই মেলায় বই দেখছেন পুলিশ কর্মকর্তা

অমর একুশে গ্রন্থমেলা ঘুরে: একটা স্টলের কোণে দাঁড়িয়ে বইয়ের সারি থেকে চারটে বাছাই করে একটা একটা করে দেখছেন মোহাম্মদ মোস্তফা। পাশে দাঁড়িয়ে স্টলে সাজানো বইয়ের সারিতে ওপর চোখ বুলাচ্ছেন ফয়সাল। দু’জনেই শাহবাগ থানার কনস্টেবল। মোস্তফা একটা কবিতার বই হাতে নিয়ে পড়ছিলেন, ফয়সাল আরেকটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোমার না দেশাত্মবোধক কবিতা পছন্দ, এই নাও এটা দেখতে পারো’।

যখনই ডাক পড়েছে, অমর একুশে গ্রন্থমেলার নিরাপত্তায় এখানে ছুটে এসেছেন মোস্তফা-ফয়সালরা। প্রায় আটাশটে দিনের এই প্রাণের মেলা এবার সাঙ্গ হতে চললো।

এই বইয়ের উৎসবকে নির্বিঘ্ন করতে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা বাংলা একাডেমি অংশ, যেখানে যখন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেখানে তা পালন করেছেন। কোনো রকমের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া এবারের মেলা শেষ হতে চলার পেছনের গল্পটা মোস্তফা-ফয়সালদের মতো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সকাল-দুপুর, দুপুর-বিকেল, বিকেল-রাতের নিরলস পরিশ্রমের।

থেকেছেন বইয়ের উৎসবে, দায়িত্বটা পালন করেছেন বইয়ের উৎসবে। এই বইয়ের মেলায় নিজেরাও বই-টই কেনার সুযোগ পেয়েছেন? মোস্তফা-ফয়সালদের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল তা নিয়েই।

‘গতকাল ভাতিজির জন্য ড্রয়িংয়ের কয়েকটা বই কিনেছি, আজকেও নেবো। নিজের জন্যও কিনবো আজ-কাল। ’ বলছিলেন মোস্তফা। তিনি কবিতা পছন্দ করেন বেশি। আরও বেশি পছন্দ করেন স্বাধীনতা বিষয়ক কবিতাগুলো। তার মনে হয়, পুলিশে চাকরি করেন দেশসেবার জন্য। এই স্বাধীনতা আর দেশাত্মবোধক কবিতা পড়লে সেই দেশসেবার চেতনা শানিত হয়। ডিএমপির নিজেদের প্রকাশনা স্টলে বই দেখছেন এক ক্রেতা

বই পড়ার সময় পান? মোস্তফার উত্তর, ‘সময় বের করে নিতে হয়। অবসর যখন পাই, একটু একটু করে পড়ি। একটানে আর শেষ করা হয় না। ’ ফয়সালও বই দেখছেন, তবে তিনি শেষ দিনে কিনবেন কিছু।

মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে নিয়ন্ত্রণকক্ষ বসিয়ে তার পাশেই বিনামূল্যে সুপেয় পানি সরবরাহ করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। সেখানে কাজ করছিলেন আনসার সদস্য সেন্টু মিয়া। তার তথ্য, রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৩টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ২ ঘণ্টার মধ্যে ২০ লিটারের ২০টি জার শেষ হয়েছে। সেন্টু এখনও বই কেনার সুযোগ পাননি। তবে শেষ দিন কিনতে পারেন।

তার পাশে শাহবাগ থানারই আরেক কনস্টেবল মিজানুর রহমান দাঁড়িয়ে। মিজানুরও বই পড়তে পছন্দ করেন। সময় পেলে আইন-কানুন এবং শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের বই পড়েন তিনি। মিজানুরও জানালেন, মেলার শেষ বিকেলটায় কয়েকটা বই কিনবেন তিনি। মিজানুর বলেন, ‘বই পড়ার সময় কম। কিন্তু কিনে রাখলে তো ক্ষতি নাই, যখন সময় পাওয়া যাবে, তখন পড়া যাবে। ’

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে নিয়ন্ত্রণকক্ষ হলেও ডিএমপির নিজেদের প্রকাশনা স্টল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। অবশ্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে র‌্যাব ও আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নেরও নিয়ন্ত্রণকক্ষ। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে নজরুল মঞ্চের পেছনটায় ডিএমপির স্টলের কাছে গিয়ে দেখা গেল মানুষের ভিড়। ভিড়ই বললো যেন, বিক্রি-বাট্টা ভালোই চলছে।

এখানে মিলছে পুলিশ সদস্যদের নিজেদের লেখা বা সম্পাদিত সব বই। মেলায় বিদায়ের সুর যেমন, তেমনি এ স্টলের বইও প্রায় শেষ হয়ে গেছে। কাছে গিয়ে কথা হলো স্টলে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে। অটোগ্রাফ দিচ্ছেন মোশতাক

ডিএমপি ট্রেইনিং একাডেমির সংরক্ষণ অফিসার (আরও) আইন প্রশিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর আলম স্টলের তত্ত্বাবধানে। তিনি বললেন, ভালো বেচা-বিক্রি হয়েছে। এখান থেকে পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি অনেক সাধারণ মানুষও বই কিনেছেন বেশ।

কেমন বিক্রি হয়েছে তার প্রমাণ নিয়ে যেন হাজির হলেন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহমেদ আমিন চৌধুরী। স্বাধীনতার ওপর তার লেখা ‘ইতিহাসের আলোকে: মুক্তিযুদ্ধ ও রাউজান’ বইটির এক সংস্করণ ছিলো এখানে, ২৭তম দিনেই শেষ হয়ে গেছে। এ মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সুপার বইটি অবসর নেওয়ার পর লিখলেও তিনি তথ্য ঘেঁটেছেন স্বাধীনতার পর থেকেই। অবশ্য দায়িত্ব পালনকালেও শিল্প-সাহিত্য চর্চায় পিছিয়ে থাকেননি আহমেদ আমিন চৌধুরী। সেসময় তিনি লিখেছেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রথম অভিধান (১৯৯৮)। এমন আরও একটি বই লিখেছেন, সেটা তারও আগে, নাম সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার প্রথম অভিধান।

আহমেদ আমিন চৌধুরী বলেন, শিল্প-সাহিত্য চর্চা ও এর সৃজনশীল বিকাশ সবই নিজের ওপর নির্ভর করে। নিজে সময়টুকু বের করতে পারলেই হয়। সে অনডিউটি হোক, বা রিটায়ারমেন্টে।

ডিএমপির স্টলে সবচেয়ে বেশি দেখা গেল উপ-কমিশনার (ডিসি) মোশতাক আহমেদ রচিত বই। ৭৪টা বইয়ের রচয়িতা মোশতাকের এবারের বইমেলায়ই বেরিয়েছে ৫টি বই, রিবিট ও দুলাল, প্রতিশোধের আত্মা, লো. শিকার, কঙ্কাল ঘর এবং নরেন্দ্র জমিদারের যুগে। তার বেশিরভাগ বই-ই বেরোয় অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনিন্দ্য’র স্টলে গিয়ে কথা হলো মোশতাক আহমেদের সঙ্গে। তখন অটোগ্রাফ শিকারীদের সামলাচ্ছিলেন তিনি।

অটোগ্রাফ দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকেই মোশতাক বলছিলেন পুলিশ কর্মকর্তাদের সৃজনশীলতার বিষয়ে। বলেন, ‘সবার মধ্যেই সৃজনশীলতা আছে, কেউ প্রকাশ করে কেউ করে না। শিল্প-সাহিত্য চর্চার মতো সৃজনশীলতায় মন-মনন উর্বর থাকে। ’

নিজের লেখালেখি বিষয়ে মোশতাক বলেন, সবার দিনে ২৪ ঘণ্টা। আমার দিনে ২২ ঘণ্টা। কারণ আমি সকাল ৬-৮টা বরাদ্দ রেখেছি লেখালেখির জন্য। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৫০ দিনই আমার দু’ঘণ্টা করে লেখালেখিতে যায়।

দায়িত্ব পালনের ফাঁকে লেখালেখি বা সাহিত্য চর্চার বিষয়টা একান্তই আগ্রহের ব্যাপার বলে মনে করেন কথাসাহিত্যিক মোশতাক আহমেদ। তবে এও মনে করেন, সবার মধ্যেই থাকা দরকার শিল্প-সাহিত্য চর্চা। এতে জানাশোনা বাড়ে, নিজের জ্ঞানের পরিধি সমৃদ্ধ হয়। আত্মা তৃপ্তির খোরাক পায়।

এবারের বইমেলা নির্বিঘ্ন করতে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচেষ্টা এবং তার প্রায় সফল সমাপ্তির বিষয়ে ডিএমপির এ ডিসি বলেন, দেশে জঙ্গিবাদের অব্যাহত উত্থান প্রচেষ্টার মধ্যে এমন নির্বিঘ্ন আয়োজন আমাদের মুখ উজ্জ্বল করে। এই নির্বিঘ্ন আয়োজনে নিজেদের লেখা বই থাকলে সেটা এক স্বর্গীয় অনুভূতি দেয়। আনন্দের এ উৎসব এমনই নির্বিঘ্ন হোক।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৭
এইচএ/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।