‘তারান্নুম’ তার থেকে মোটেও ব্যতিক্রম নয়। তার গল্প বলার ভঙ্গিমা অনেকটা নিজের জীবনের ধারা বর্ণনার মতো।
পাঠককে এই দ্বিধা আর বিভ্রান্তির মধ্যে রেখে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে তার একটি সফল কৌশল। বইয়ের নাম গল্প ‘তারান্নুম’ পাঠ থেকেই এ ধরনের একটি বিভ্রান্তি কিংবা দ্বিধা তৈরি হবে।
মোট ৮টি গল্প নিয়ে লেখা হয়েছে ‘তারান্নুম’। প্রথম গল্প ‘তারান্নুম’ বইয়ের অর্ধেক অবয়ব জুড়ে রয়েছে। সেই অর্থে একে ছোটগল্প বলা যাবে কিনা আমি নিশ্চিত নই। কাহিনীর পরিসর আর ক্যানভাসের বিস্তৃতিতে আমার কাছে একে একটি বড়গল্প বলেই মনে হয়েছে।
গল্পে প্রবেশের আগে উপক্রমণিকার প্রথম বাক্যেই দৃষ্টি আটকে যায়। দ্বিধার শুরু সেখান থেকেই। দীলতাজ রহমান বলেছেন, ‘শিল্পসত্তা আর লড়াকুসত্তা এক সঙ্গে বাঁচতে পারে না। ‘
তার এই অভিমতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না করে উপায় নেই। দীলতাজ রহমানের নিজের জীবনই কী তার যথেষ্ট প্রমাণ নয়? এমনকি তার গল্পের চরিত্রগুলোর মধ্যেই লড়াকুসত্তার মধ্যেই শিল্পসত্তার প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি দেখা যায় অহরহ। ‘তারান্নুম’ গল্পের মূল চরিত্র ‘তারান্নুম’ এবং তার একাধিক পার্শ্বচরিত্রেই এই সমন্বয় দৃশ্যমান।
‘তারান্নুম’ গল্পটি মূলত লেখিকার মেলবোর্নে কাটানো সময়ের রোজনামচাই গল্পাকারে লেখা। অবশ্য এই বিষয়টি আমার জানা না থাকলে হয়তো এতো সহজে বিষয়টি বোধগম্য নাও হতে পারতো।
মেলবোর্নে কাটানো সময়টিতে একজন তরুণী পেশাজীবীর সঙ্গে তার পরিচয় এবং ঘনিষ্টতার পটভূমিতে এই গল্প লেখা। গল্পের নায়িকা তার পেশার বাইরে এসে শিল্প সাহিত্যের সুকুমার চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন বলেই শুধু নয়, তার অন্তর্গত মেয়েস্বত্তার আহ্বানেই দীলতাজ রহমান তাকে নিজের কন্যার আসনে বসিয়ে নিজের মাতৃসত্তার ডানা মেলে দিয়েছেন।
তার নিজের কথায় – ‘আসলে যারা অন্তর্গত বিষয়গুলো বোঝে তারাই আসল সন্তান। তাদের জন্য ভাগ হয়ে যায় সত্তার সমস্ত উপাদান। দৃশ্যমান না হলেও মানুষ মূলত তাদের সাথেই বসবাস করে। তাদের নিয়ে বাস করেতে একই ছাদ লাগে না। মানুষের মোক্ষম যে জমিন – চেতনা, সেটাই যার যার নিবিষ্টতা দিয়ে যোগ্যতানুসারে ভাগ করে নিয়ে যায়। ‘ গল্পের ছলে কী অসামান্য জীবনদর্শনের উপস্থাপন!
মানব সম্পর্কের জটিল জৈব রসায়ন দীলতাজ রহমানের গল্পের অন্যতম উপজীব্য। একজন সফল গল্পকারের অন্যতম শক্তি তার এই জৈব রসায়নের স্বরূপ উন্মোচনের সামর্থ্য।
‘প্রতিদান’ গল্পটিতে তিনি গল্পের নায়ককে ঘিরে বউ-শাশুড়ির জটিল জৈব রসায়নকে সরলীকরণ করেছেন। আমাদের সমাজের মধ্য কিংবা উঁচু তলায় বউ-শাশুড়ির সনাতন যে টানাপোড়েন এই গল্পে তা থেকে একটা ভিন্ন মাত্রা চিত্রিত হয়েছে।
কেবল বউ-শাশুড়ির সম্পর্কের ভিন্ন আঙ্গিকই নয়, গল্পে আমাদের সমাজের নিচু তলার কিছু চিরচেনা সংঘাতকেও তুলে আনা হয়েছে। (এখানে সমাজের ‘উঁচুতলা নিচুতলা’ অভিব্যক্তিগুলো আমি সমাজের প্রচলিত ধারার অর্থে ব্যবহার করেছি, এই অভিব্যক্তিগুলো ব্যক্তিগত বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। )
‘শালি’ গল্পে লেখিকা আমাদের সমাজে বৈবাহিক এবং পারিবারিক সম্পর্ক নির্ণয়ে উত্তরাধিকারের ভাবনা কিভাবে প্রভাব বিস্তার করে তার দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। তার এই প্রচেষ্টায় আন্তরিকতা আছে এবং ক্যানভাসের বিস্তৃতি আছে, তবে উত্তরাধিকারে সম্পদ বণ্টন সম্পর্কে যাদের ধারণা সামান্য তাদের অনেকের কাছে বিষয়টি ধোঁয়াশাই রয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে। তবে এর চেয়ে সহজভাবে এই জটিল বিষয়টি উপস্থাপন করাও চাট্টিখানি কথা নয়।
‘মমতাজ’ গল্পে সমাজে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ কারো উপস্থিতির দৃশ্য আঁকা হয়েছে বিদ্যমান বাস্তবতার নিরীখে। আমরা যে যে যেখানেই থাকিনা কেন, আমাদের মনস্তত্ত্ব যে মোটামুটি একইভাবে কাজ করে এই গল্প তারই চিত্রকল্প।
উৎসর্গপত্রে ছাপা হয়েছে ভুল মানুষের নাম…’ এই প্রাক-অভিব্যক্তির নিচে তার ‘আব্রুছেঁড়া শীত’ গল্পে তিনি ভুল মানুষের নামে জীবনের উৎসর্গপত্র ছাপার পরিণতি চিত্রিত করেছেন। সমাজের পরতে পরতে এই দৃশ্য বিরজমান। আমরা অনেকেই তা না দেখার ভান করি। দীলতাজ রহমান শুধু দেখেই ক্ষান্ত হননি, আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েও দিয়েছেন। এখানেই একজন নীরব পর্যবেক্ষক আরেকজন সরব গল্পকারের পার্থক্য।
আগেই বলেছি, গল্পগুলো কী কোনো কল্পিত কাহিনী নাকি লেখিকার জীবনের রোজনামচার অনুষঙ্গ তা নিয়ে পাঠক এক ধরনের বিভ্রান্তিতে থাকবেন। এই বিভ্রান্তিই পাঠককে গল্পের ভেতরে টেনে নিয়ে যাবার একটি চালিকা শক্তি বলে আমার মনে হয়েছে।
তাতে গল্পপাঠের জানালা দিয়ে গল্পকারের জীবনের কিছু দৃশ্য দেখে নেওয়ার একটা হাতছানি দেখা যায়। ‘বাবুডাইং’ও তেমন একটি গল্প। এই গল্পে আমরা একজন পরিণত বয়সের কিশোরীকেই দেখি গল্পকারের ছদ্মবেশে।
তবে শেষের দিকে তার একজন ভ্রমন সহচর ‘আপু’ না ডেকে ‘আন্টি’ ডাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করায় আমাদের এই ধারণায় একটু ধাক্কা লাগতে পারে। হয়তো তখন কোনো কোনো পাঠক গল্পটি আবারো পড়বেন, একজন পরিণত বয়সের কিশোরীর সঙ্গে ক্ষণিকের কৈশোর চর্চা করা একজন পরিণত মানুষকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে বিশ্লেষণ করবেন।
দীলতাজ রহমানের গল্প বলার ঢং সাবলীল। তার গল্পবলার ধাঁচে কোনো আতিশয্য কিংবা কৃত্রিমতা নেই। তবে ‘অবস্থিত’ ‘ইস্কাটনস্থ’ এ ধরনের শব্দগুলোকে আরেকটু কথ্য আঙ্গিকে উপস্থাপন করলে অধিকতর শ্রুতিগ্রাহ্য হতো বলে মনে হয়েছে।
দুই বান্ধবীর যখন কথা হয় তখন পরিবারের সদস্যদের কথা বলতে শুধু নামটুকু উল্লেখ করাই প্রচলিত। সেখানে ‘ মেয়ে শেফাও কলেজ থেকে এর ভেতরে আসার কথা নয়’ এইটুকু না বলে ‘শেফাও কলেজ থেকে এর ভেতরে আসার কথা নয়’ (মমতাজ) বললে আরেকটু বাস্তবানুগ কথোপকথন বলে মনে হতো। পাঠক বুঝে নিতেন যে বর্ণনাকারী তার নিজের কথাই বলেছেন।
১৪২ পৃষ্ঠার ‘তারান্নুম’ প্রকাশ করেছেন ‘প্রকাশ’। শতাব্দী জাহিদের করা প্রচ্ছদ দৃষ্টিনন্দন হয়েছে। বাঁধাই ও অঙ্গসজ্জায় প্রকাশকের যত্নের ছাপ সুস্পষ্ট। বইটি আমাদের ছোটগল্পের সম্ভারে মূল্যবান সংযোজন হয়ে পাঠকের সমাদর পাবে বলেই বিশ্বাস।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৮
এমএ/