শনিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখা যায়, দুপুর ৩টা পর্যন্ত মেলা প্রায় জনশূন্য। আর বিকেলের দিকে লোক সমাগম হলেও তা বেশ কম।
এমন অবস্থায় অনেক বিক্রেতাই স্টলে বসে শুধু বই পড়ে সময় পার করছিলেন। কেউ আবার চেয়ারে বসে-ঘুমিয়ে বা একে অন্যের সঙ্গে অলস গল্পে মেতে থাকছিলেন। তবে বই বিক্রি হয়নি বললেই চলে।
শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত মেলার তিন দিনে মাত্র একটি বই বিক্রি করেছে অয়ন প্রকাশনী। এদিন বিকেল ৪টা পর্যন্ত কোনো বই বিক্রি হয়নি কথাপ্রকাশ, বাতিঘর, অনন্যা বা অন্যপ্রকাশের মতো নামকরা প্রকাশনীগুলোতেও। সার্বিক বিবেচনায় তারা বেশ হতাশ।
‘আরো প্রকাশন’র পরিচালক রোমান মল্লিক বলেন, বইয়ের ক্রেতা একেবারেই নেই বললেই চলে। বই কেউ কিনুক বা না কিনুক, মানুষ স্টলে বই দেখতে এলেও ভালো লাগে, কিন্তু এখানে তাও নেই। পুরো মেলায় ১০টি বই বিক্রি করতেই দম বেরোনোর অবস্থা। বইয়ের কাস্টমার একদমই আসছে না, শিশু একাডেমির যেসব শিশুরা বই দেখতে আসাছে, তার সংখ্যাও হাতেগোনা।
তিনি মূলমঞ্চের আয়োজনের কথা উল্লেখ করে বলেন, অন্য জায়গায় মেলাকে কেন্দ্র আয়োজন হয়। আর এখানে যেন আয়োজনকে কেন্দ্র করেই মেলা। তিন দিনে বিক্রি হয়েছে মাত্র পাঁচটি বই। যতটুকু মনে হচ্ছে মেলার প্রচার কম। পত্রপত্রিকায় এই মেলার প্রচারণা আরও বাড়ানো উচিত।
প্রথমা প্রকাশনের গোলাম সামদানী বলেন, প্রচার কম হওয়ায়ই এই অবস্থা মেলার। একটি স্টলে দিনে যা খরচ হয়, হিসেব করলে সেই পরিমাণ টাকারও বই বিক্রি হয় না। আবার যেসব ক্রেতা আসেন, অনেকেই মাছের বাজারের মতো বইয়ের দরদাম করেন। সেদিক থেকে বললে বলতে হয়, বাহ্যিক পরিবর্তনের তুলনায় আমাদের মননের পরিবর্তনটা জরুরি। সপ্তবর্ণ প্রকাশনীর প্রকাশক শিখা সরকার বলেন, গণমাধ্যমে প্রচারণার অভাব, ভেতরে এতোবড় একটা মেলা চললেও মেইন গেইট সবসময় বন্ধ করে রেখে পকেট গেট খুলে রাখা, অনেকের ধারণা শুধু ছোটদের বইমেলা, এসব কারণেই মানুষ আসছে না মেলায়। কিন্তু ছোটদের পাশাপাশি বড়দের জন্যওতো বই আছে সব প্রকাশনীতে। আর সারাদিনে যেন ৫০০ টাকারও বিক্রি নেই।
অয়ন প্রকাশনের আব্দুল ওয়াফি বলেন, মেলায় যতজন বিক্রেতা আছে, ততজনও ক্রেতা নেই। দু’একজন স্টলে যা বই দেখতে আসছেন, সবাই শিশু একাডেমির শিশুরা। বাইরের কেউই নেই। আর একাডেমির শিশুরাও মঞ্চে অনুষ্ঠান দেখে চলে যায়, এদিকে কেউ আসে না।
সাম্প্রতিক প্রকাশনীর রামিসা ফারিহা (রাহা) জানান, শিশুরা এলেও তাদের সঙ্গে অভিভাবক নেই। ফলে তারা নিজেরা নিজেরাই ঘুরে-ফিরে চলে যায়, বইয়ের সঙ্গে পরিচয়টা এখান থেকে সেভাবে হচ্ছে না।
অনিন্দ্য প্রকাশের সিনিয়র সেলস ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম বলেন, স্টলে কাস্টমার এলে ভালো লাগে। অন্তত তাদের ডিমান্ডটা বুঝতে পারি। কিন্তু কোনো কাস্টমারই নেই। বিকেলে বাচ্চারা এলেও তারা মেতে থাকে আয়োজন নিয়ে। আমরা চাই তারা বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হোক। বই না কিনুক, অন্তত বই নেড়েচেড়ে দেখুক। কিন্তু এ মেলায় সেটাও পাচ্ছি না। আবার অনেক অভিভাবক আসছেন, যারা সন্তানের আবদারের বইটিও কিনছেন না, বলছেন মোবাইলে দেখে নিও। তারা সন্তানকে আইসক্রিম কিনে দেন, কিন্তু বই কিনে দেন না। আমরা চাই সন্তানদের কাছে বই পৌঁছাতে। কমিশন বেশি দিয়ে হলেও কিন্তু এখানে সেই মানুষই নেই।
তিনি বলেন, মেলার আয়োজন ভালো থাকলেও প্রচারটা কম। আর এই মেলা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে হওয়ায় এর মধ্য দিয়ে আমাদের শিশুদের বঙ্গবন্ধুকে জানার বিষয়টিও জড়িত। সেদিক থেকে প্রায় প্রতিটি স্টলই বঙ্গবন্ধু-কেন্দ্রিক বই এনেছে, কিন্তু পাঠক, দর্শনার্থী কেউই নেই। বিকেলে একাডেমির শিশুরা এলেও তারা মঞ্চের আয়োজন দেখেই চলে যায়।
সার্বিক প্রসঙ্গে কথা হলে শিশু একাডেমির পরিচালক আনজীর লিটন বাংলানিউজকে বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিতভাবে বইমেলার খবর প্রচার করা হচ্ছে। শিশুদের আগ্রহ বাড়াতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এবং তারা নিয়মিত আসছে। প্রচার হয়নি এটা ভুল কথা। তবে গণমাধ্যমকেও আরও একটু সচেষ্ট হতে হবে।
তিনি বলেন, এই মেলাটা বাংলা একাডেমির মতো অত বড় আঙ্গিকের মেলা নয়। এটা বাচ্চাদের নিয়ে মেলা, বাচ্চাদের বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে মেলা। তারা যেসব ভালোবাসে, যেমন সিসিমপুর আসছে নিয়মিত। আলী ইমাম মজুমদার, আনিসুল হক, মফিদুল ইসলামের মতো বিশিষ্টজনেরা এসে বাচ্চাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছেন। আর সকালের দিকে বাচ্চাদের স্কুল থাকায় হয়তো অনেকেই আসতে পারে না, তবে বিকেল থেকে ঠিকই তারা আসছে। আর নিরাপত্তাজনিত কারণেই মেইন গেইটটা বন্ধ রেখে পকেট গেইট চালু রাখা হয়েছে।
প্রকাশকদের সম্পর্কে তিনি বলেন, কিছু প্রকাশনার স্বত্বাধিকারীও এখনো মেলায় আসেননি। কিছু প্রকাশনী আছে যারা এখনো স্টলে তাদের সেলসম্যান পাঠায়নি। সেগুলো বাংলাদেশের বড় বড় প্রকাশনী। প্রকাশকদেরতো উচিত, মেলায় আসা, জনগণকে উৎসাহিত করা। তবে মেলায় বাচ্চারা যেটা চায়, একটু আনন্দ, একটু হৈ-চৈ, সেটার মাধ্যমে বাচ্চাদের বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করানোর কাজটা হচ্ছে। বিকেলে বাচ্চারা এসে দৌড় দিয়ে মেলায় ঢুকছে, এই পরিবেশটাতো সে পাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ২২০৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৯
এইচএমএস/এইচএ/