ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

মোস্তফা কামালের ‘মানবজীবন’: জীবন্ত আখ্যান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০
মোস্তফা কামালের ‘মানবজীবন’: জীবন্ত আখ্যান

বলা হয়ে থাকে জীবন আসলে কুসুমাস্তীর্ণ নয়। জীবনে থাকে বন্ধুর পথ। থাকে চড়াই-উৎরাই। সুললিত মূর্চ্ছনাও থাকে। আশা থাকে। হতাশা থাকে। অর্জন থাকে। বিসর্জন থাকে। সবমিলিয়ে জীবন এক মহা আয়োজন। 

জীবন জীবনে আসার আগেই কত আয়োজন! কত পথ-পরিক্রমা! এভাবেই জীবনে জীবন চলে। সেই জীবনের জীবন্ত আখ্যান রচনা করা সোজা কথা নয়।

জনপ্রিয় লেখক মোস্তফা কামাল রচিত ‘মানবজীবন’ উপন্যাসের কথাই বলছি, যা প্রকাশিত হয়েছে এবারের বইমেলায়।

এই দেশে একদিন যুদ্ধ হয়েছিল। মুক্তির জন্য যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের পর আরেক যুদ্ধ নেমে আসে বাঙালির জীবনে। ক্ষুধার যুদ্ধ। ভালো বাংলায় যার নাম দেওয়া হয় ‘দুর্ভিক্ষ’। কিন্তু এই যুদ্ধগুলো প্রাকৃতিক নয়। মানবসৃষ্ট। সব যুদ্ধের বিরুদ্ধেই বাঙালি জয়ী হয়েছে। কিন্তু পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ। এই অর্জনের পেছনে ছিল মহৎ বিসর্জন। ছিল সংগ্রাম। ছিল ত্যাগ। আরো কত কী!

এসবেরই এক অনুপুঙখ বয়ান মোস্তফা কামালের উপন্যাস ‘মানবজীবন’। একটি যুদ্ধের ভেতরে থাকে অনেক যুদ্ধ। অনেকটা নদীর স্রোতের মতো। স্রোতের ওপরের অংশটুকুই দেখা যায়। কিন্তু এর ভেতরে থাকে আরেক স্রোত। থাকে অন্তঃস্রোত। সব স্রোত দেখা যায় না।

কিন্তু কেউ কেউ দেখেন। দেখেন অনুপূঙ্খভাবেই। দেখেন কীভাবে মিলমিশ খায়। দেখেন তাদের ভেতর কীরূপে রচিত হয় আন্তঃসম্পর্ক। লেখক মোস্তফা কামাল ঠিক এ কাজটিই করেন। কীভাবে? সেটা জানতে হলে যেতে হবে মানবজীবনের ভাষ্যে। যেতে হবে মানবজীবনের গভীরে। কী আছে এতে? আছে সংগ্রামের চিত্র। আছে জীবনকে জটিল করে তুলবার চক্রান্ত। আছে বাধা। আছে বিপত্তি। আছে ষড়যন্ত্র। আছে কুট কৌশল।

তবুও জীবন এগিয়ে চলে। কারণ যে জীবনে সরলতা থাকে তাকে কুটিলতা দিয়ে একটু বাধা প্রদান করা যায়। আটকানো যায় না। যে জীবনের প্রণোদনা থাকে তাকে নিরাশা দিয়ে স্তিমিত করা যায় না। সরলতা আর প্রণোদনা নিয়ে জীবন এগিয়ে চলে। মোস্তফা কামাল এই জীবনের কথাই তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন এক চার বছরের শিশুর সরল চোখ দিয়ে। তার অনুভূতি দিয়ে। তার আবেগ দিয়ে। তার সরল বিচক্ষণতা দিয়ে।

এটা করতে গিয়ে তিনি কি নতুন এক কৌশল এবং আঙ্গিকেরই সূচনা করলেন না? অবশ্যই করলেন। কারণ এই বালকের দেখবার চোখকে অভিজ্ঞ লেখকের চোখ কোনোভাবেই প্রভাবিত করেননি। লেখকের নানমুখি দৃষ্টি এই বালকের চোখকে অভিজ্ঞ করে তোলেনি। এই সরলতা হচ্ছে এই উপন্যাসের অন্যতম লক্ষণ।

তো এই সরল চোখ লেখককে দিয়ে কী লিখিয়ে নিলো? লিখিয়ে নিলো স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী সময়কে। যে সময় বাঙালিকে নামতে হয়েছিল আরেক যুদ্ধে। যে যুদ্ধের নাম ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানাবিধ চক্রান্তে সদ্য স্বাধীন দেশ যখন অসংখ্য টানাপোড়েনে জর্জরিত ঠিক তখনই এই আরেক চক্রান্ত আমাদের জীবনে নেমে আসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাহত হয়েছে কাঙ্ক্ষিত খাদ্য উৎপাদন।  

রিজার্ভ সামান্য। অবকাঠামো অপ্রতুল। রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত। জনসাধারণ নানাবিধ মানসিক টানাপোড়েনে ক্ষতিগ্রস্ত। ঠিক এই সময়ে এক কিশোর তার সরল চোখ দিয়ে দেখছে তার চারপাশ। চারপাশ বলতে তার পরিবার। কারণ তার জগত তখনো অত বড় হয়ে ওঠেনি। দেখছে তার মাকে। দেখছে তার বাবাকে। দেখছে তার ভাইবোনকে। দেখছে মা আগে যে পরিমাণ ভাত খেতে দিতো এখন সে-পরিমাণ খেতে দেয় না। দেখছে আগে মা সবার সঙ্গেই খেতে বসত।  

এখন সবার শেষে খাওয়ার কথা বলে। সবাইকে খাওয়ায়। বলে আমি পরে খাব। সবার খাওয়া শেষ হলে মা চুপিচুপি টিউবওয়েলে গিয়ে পানি খায়।  

এই কঠিন দৃশ্য লেখক যখন আঁকেন তখন চোখের পানি ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে যায়। এই একটি চিত্রই বলে দেয় সে-সময়ের হাহাকারের স্বরূপ। লেখক মোস্তফা কামাল এই চিত্র এঁকেছেন।

তারপর বালকের স্কুলে যাওয়ার সময় হয়। সেটা নিয়েও তাকে যুদ্ধে নামতে হয়। যুদ্ধে নামতে হয় তার মাকে। সে-যুদ্ধে তারা জয়ী হয়। বালক বড় হতে থাকে। সঙ্গে বাড়তে থাকে তার দেখবার ভঙ্গি। বাড়তে থাকে তার বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতা। তার সরল মন যখন জানতে পারে এদেশে এক জঘণ্যতম হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত করা হয়েছে।  

সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে মহান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে। তখন সে খুব বিচলিত বোধ করে। সে এক সময় জানতে পারে সামরিক শাসন জারি হয়েছে। জানতে পারে জিয়াউর রহমান নামের একজন সেনাশাসক দেশ শাসন করছে। এভাবে একদিন সে জানতে পারে এরশাদ নামের একজন সেনাকর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের মতোই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। বালক এভাবে বড় হতে থাকে। তার জানার পরিধি বাড়তে থাকে। তার মানসগঠন হতে থাকে।  

সে হয়ে ওঠে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন। প্রতিবাদী। সে একসময় স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে কলেজে ভর্তি হয়। ঢাকায় চলে আসে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে একসময়। সে এসবের অংশীজন হয়ে ওঠে এবং এখানেই উপন্যাস শেষ হয়ে যায়। তখন জানা যায় এ উপন্যাসের প্রথম পর্বের সমাপ্তির কথা।
জীবন সবসময় জীবনের ভেতরে থাকে না। জীবন অনেক সময় জীবনের বাহিরে চলে যায়। দুই পরিস্থিতির ভেতরে থেকে বা পরিস্থিতির বাহিরে এসে যে অবলোকন এবং তার যে যথাযথ উপস্থাপন- তাই হয়তোবা মহৎ সাহিত্য। লেখক মোস্তফা কামাল এই অবলোকন এবং উপস্থাপনে এতই সৎ যে উপন্যাসের কোথাও অতিরঞ্জন মনে হয়নি। মনে হয়নি আরোপিত। জীবনের গভীরে অবগাহন এবং পর্যবেক্ষণ ছাড়া এরকম উপস্থাপন সত্যিই অসম্ভব।

লেখক মোস্তফা কামাল এই অসম্ভব কাজটিই সম্ভব করে তুলেছেন তার সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস মানবজীবন- এ।

মোস্তফা কামালের ‘মানবজীবন’ বইটি প্রকাশ করেছে পার্ল পাবলিকেশন্স। ধ্রুব এষের প্রচ্ছদে বইটির মূল্য রাখা হচ্ছে ৩০০ টাকা।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০
এমএ/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।