ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বইমেলা

মেলায় ঘুরে ঘুরে বই বিক্রি করেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জুঁই

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৭ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০২২
মেলায় ঘুরে ঘুরে বই বিক্রি করেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জুঁই বইমেলায় ঘুরে ঘুরে বই বিক্রি করেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জুঁই | ছবি: জিএম মুজিবুর

ঢাকা: দৃষ্টিশক্তি না থাকলেও অদম্য তার ইচ্ছাশক্তি। ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়া করে এমএ পাস করেছেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য চালাচ্ছেন চিকিৎসাকেন্দ্র, একই সঙ্গে করেন লেখালেখি।

কেবল তাই নয়, নিজের বইগুলো ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছেন বইমেলায়।

রোববার (৬ মার্চ) বিকেলে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে কথা হয় লেখক কোহিনুর আক্তার জুঁইয়ের সঙ্গে। ‘প্রজাপতির খেলা’, ‘শিশুদের ছড়া ও কবিতা’, ‘সুখ’ এবং ‘বাংলাদেশের মহান স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান’ নামে চারটি বই ফেরি করে বিক্রি করছেন তিনি।

লেখক কোহিনুর আক্তার জুঁই বলেন, আমি চোখে দেখি না ঠিক, তবে আমার ইচ্ছা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, কারও ওপর বা সমাজে বোঝা হয়ে না থাকা। তাই তো লেখালেখি করি আর পাশাপাশি একটি চিকিৎসাকেন্দ্র পরিচালনা করি।



তিনি বলেন, লেখার ক্ষেত্রে আমি বলি এবং অন্য একজন সেটি শুনে লিখে দেন। আর বই বিক্রি করে যে অর্থ হয়, সেটা এবং কেউ যদি সাহায্য দেয়, তবে সেগুলো বরাদ্দ দিয়ে দেওয়া হয় একটি হাসপাতালে। সেই হাসপাতালের নাম কোহিনূর চক্ষু হাসপাতাল ও অন্ধ মহিলা সংস্থা। চোখের চিকিৎসাসহ নাক-কান-গলা ও দাঁতের রোগের বিষয়ে এই হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

তার নামে সাভারের জোড়পুলে অবস্থিত এই চিকিৎসাকেন্দ্রে বর্তমানে তিনজন ডাক্তার কর্মরত আছেন বলেও জানান কোহিনুর আক্তার জুঁই। তিনি জানান, সরকার তাকে জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে ১৬ শতাংশ। সেখানেই এই চিকিৎসাকেন্দ্রের কার্যক্রম এবং তার থাকার জায়গা। সেখানে হচ্ছে টিনশেড ঘর। কিছুটা এগিয়েছে, আরও কিছু বাকি। সেটুকু করা হবে এই বইমেলা শেষে।

এই লেখকের লেখালেখির শুরু হয় ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে। তবে প্রথম বই প্রকাশ পায় ২০০৫ সালে। সেই বইয়ের নাম ছিল ‘উপহার’। সেটি বিভিন্ন স্কুল-কলেজে বিক্রি করা হয়েছে। শিক্ষাজীবনে ১৯৮৬ সালে মিরপুরের গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি পাস করেন। মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ থেকে ১৯৮৮ সালে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৯৪ সালে সরকারি বাংলা কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন। ১৯৯৬ সালে জাতীয় বিশেষ শিক্ষাকেন্দ্র থেকে বিএসএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৮ সালে মিরপুর বাংলা কলেজ থেকে এমএ পাস করেন।



বইমেলায় একহাতে বই এবং আরেক হাতে সাদা ছড়ি নিয়ে বই বিক্রি করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এভাবে বই বিক্রি কষ্ট হয়। কিন্তু ভালো লাগে। নিজের আনন্দে কাজ করি। অনেক কষ্ট হলেও ভালো লাগে। এই যে ঘুরে ঘুরে বই বিক্রি করছি, আমার স্টল নেই, তবুও অল্পকিছু বিক্রি হয়। কমবেশি যাই হোক মানুষ কেনে, অনেকে এসে কথা বলে—এটা অন্যরকম একটা আনন্দ দেয়।

কোহিনুর আক্তার জুঁই বলেন, এভাবে বিক্রি না করে কয়েকটি স্টলেও বই রাখার জন্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখানকার নিয়ম হচ্ছে স্টলে শুধু প্রকাশনীর নিজেদের বই থাকবে। আমার তো আর স্টল নেই, তাই রাখতে পারিনি। পরে উপায় না পেয়ে আমি নিজেই এভাবে ঘুরে ঘুরে বই বিক্রি করছি।

বইমেলায় এভাবে বই ফেরি করে বিক্রি করা ঠিক কিনা—জানতে চাইলে জুঁই বলেন, এটা আসলে সেভাবে ঠিক-বেঠিকের বিষয় না। আমি এখন একটা সমস্যায় পড়েছি। এই সমস্যার সমাধান আমি কীভাবে করব! বা যদি বইমেলায় না আসতাম তবে মনে কষ্ট থাকতো, আহারে একটু চেষ্টা করলাম না। এই যে আমি চেষ্টাটা করছি, এখন আমার মনে কষ্ট নাই।

তিনি বলেন, আজ প্রথম এক ঘণ্টায় ৩টা বই বিক্রি করেছি। মেলার প্রথম ১০ দিন আসিনি। এরপর এখন প্রতিদিনই সাভার থেকে এখানে আসি। আবার রাত ৮টা, সাড়ে ৮টার দিকে রওনা করি। যেতে যেতে আমার প্রায় ১১টা বেজে যায়।

নিজের প্রতিষ্ঠান চালানো প্রসঙ্গে জুঁই বলেন, আমি ওটার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। আমার আরও অনেক কাজ করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার তো টাকা নাই, টাকা ছাড়া কিছুই হয় না!

নিজের পরিবার সম্পর্কে এই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বলেন, আমার পরিবারে আমরা দুই ভাই দুই বোন। আমি সবার বড়। ওদের সবারই সংসার আছে। আমার কোনো সংসার নেই। বিয়ে হয়েছে, কিন্তু সংসার হয়নি। বর দেশের বাইরে গেছেন, আর ফেরেননি। আমার ছেলে-মেয়ে বা সংসার কিছুই হয়নি। আমি এখন আমার ভাইদের সঙ্গে থাকি, নিজের কাজ করি।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৬ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০২২
এইচএমএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।