ঢাকা, মঙ্গলবার, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২১ মে ২০২৪, ১২ জিলকদ ১৪৪৫

ক্যারিয়ার

গ্র্যাজুয়েশন শেষেই বিসিএসের প্রস্তুতি নিন, তার আগে নয়

ক্যারিয়ার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৭
গ্র্যাজুয়েশন শেষেই বিসিএসের প্রস্তুতি নিন, তার আগে নয় ডা. শোভন চন্দ্র হোড়

ডা. শোভন চন্দ্র হোড়। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে অংশ নিলেন ৩৫তম বিসিএসে। প্রথমবারেই বাজিমাত। তবে স্বাস্থ্য ক্যাডারে নয়, পুলিশ ক্যাডারে মেধা তালিকায় পঞ্চম হয়ে যোগদান করতে যাচ্ছেন সহকারী পুলিশ সুপার পদে। বিসিএসে ক্যাডার চয়েজ, প্রস্তুতি এবং নতুনদের জন্য পরামর্শ জানতে তার সাথে কথা হয় বাংলানিউজ ক্যারিয়ার বিভাগের। সাক্ষাতকার নিয়েছেন রায়হান আহমদ আশরাফী

বাংলানিউজ: চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়াশোনা করে পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করছেন, স্বাস্থ্য ক্যাডারে নয় কেন?
শোভন চন্দ্র হোড়: আমার মতে, একটি চাকরি কেবল চাকরিই না বরং একটি স্বতন্ত্র লাইফস্টাইল। আপনার পরবর্তী জীবনের ত্রিশ বছর, প্রায় অর্ধেক জীবন কিভাবে কাটাবেন সেটা নির্ধারন করে দেয় আপনার চাকরি।

আমার কাছে একজন কূটনীতিক, পুলিশ অফিসার কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরিটা বেশি চ্যালেঞ্জিং এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ মনে হয়। শুধু স্বাস্থ্য ক্যাডার নয় বরং প্রত্যেকটি টেকনিক্যাল এবং প্রফেশনাল ক্যাডারের কর্মপরিধি একটি নির্দিষ্ট ছকে আবদ্ধ। জেনারেল ক্যাডারের চাকরিগুলোতে কাজের যে বৈচিত্র্য সেটা আপনি সেখানে পাবেন না। এই ব্যাপারটা আমাকে সবসময়ই আকর্ষণ করতো। যদিও এগুলোকে পেশা হিসেবে নেয়ার চিন্তাটা আসে ২০১৪ সালের শুরুতে। পররাষ্ট্র, পুলিশ, প্রশাসন- তিনটিই ছিলো পছন্দের তালিকায়। অন্য ক্যাডারগুলো দেইনি কারণ ওগুলোর চেয়ে আমার বর্তমান পেশা, মানে ডাক্তারিই আমার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়।

বাংলানিউজ: বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন কবে থেকে?
শোভন চন্দ্র হোড়: মেডিকেলের ফাইনাল ইয়ারে ওঠার আগ পর্যন্তও চিন্তাভাবনা ছিলো দেশের বাইরে যাওয়ার। তখনো বিসিএস নিয়ে ভাবিনি। বলতে লজ্জা নেই, ডাক্তাররা যে প্রফেশন বদলাতে পারে, সেই ব্যাপারটাই আমি পরিষ্কারভাবে জানতাম না। এ ব্যাপারগুলো জেনেছি আরো পরে। ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক আগে বাবা মায়ের অসুস্থতার জন্য বিদেশে যাওয়ার চিন্তাটা পুরোপুরি বাদ দিই। এরপরই আমার একমাত্র বড় বোনের কাছে বিসিএসের ব্যাপারে হাতেখড়ি। নিজেও একজন বিসিএস ক্যাডার হওয়ায় আমার পরামর্শদাতা কিংবা অনুপ্রেরণার পুরোটাই তিনি। আর জেনারেল ক্যাডারে পরীক্ষা দেয়ার ব্যাপারে সবসময় সাহস যুগিয়েছে আমার স্ত্রী এবং আমার বড় বোনের স্বামী।

বাংলানিউজ: মেডিকেলে পড়াশোনার চাপ তুলনামূলক বেশিই থাকে, আপনার বিসিএসের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাই?
শোভন চন্দ্র হোড়: ডাক্তারি পড়াশোনার চাপটা অন্য যেকোন একাডেমিক কারিকুলাম এর চেয়ে বেশি। প্রস্তুতির কথা বললে, আমার পুরো বিসিএস প্রস্তুতির দৈর্ঘ্য দেড় বছর। প্রিলির ছয় মাস আগে থেকে ভাইবা পর্যন্ত। ইন্টার্নশীপের ডিউটির পর হাতে খুব বেশি সময় থাকেনা। ওর মাঝেই যতটুকু পারা যায় প্রস্তুতি নিয়েছি। প্রিলিমিনারির আগে একমাস ছুটি নিয়েছিলাম। স্কুল কলেজের বেসিকটা বিসিএসে খুব বেশি কাজে দেয়। এটা অনেক বড় পার্থক্য করে দেয়। যারা আমার মত অল্প সময় নিয়ে প্রস্তুতি নেয়, তাদের জন্য আমার বোনের পরামর্শটাই বলি, 'প্রিলিমিনারির প্রস্তুতিতে কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবার প্রয়োজন নেই। গাদাগাদা বই পড়ারও দরকার নেই। বরং বাজারের যেকোন একটি সিরিজের সবগুলো গাইড বই এ-টু-জেড খুব ভালোভাবে পড়লে প্রিলিমিনারি পাশ হবেই'।

লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, লিখিত পরীক্ষার জন্য গাইড বই, অনলাইন সবমিলিয়ে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। গ্রাফ, চার্ট, ম্যাপ, সংবিধানের রেফারেন্স দিয়ে অল্প কথায় তথ্যবহুল লিখা লিখলে ভালো করা সম্ভব। আর, ইংরেজিতে ভালো করার জন্য আইইএলটিএসের রিডিংয়ের বইগুলো এবং নিয়মিত অন্তত একটি ইংরেজি পত্রিকার একটি বা দুটো কলাম অনুবাদ করলে উপকার পাওয়া যায়। দ্রুত এবং পরিচ্ছন্ন লেখা সবসময়ই পরীক্ষকদের সুনজরে পড়ে।

বন্ধুদের সবাই হেলথ ক্যাডারে পরীক্ষা দিচ্ছে, যেখানে প্রিলিমিনারি পাশের পর প্রতিযোগিতা তুলনামূলক খুবই কম, আর আমি একা অনিশ্চিত পথে হাঁটছি, এরকম একটা সিচুয়েশনে একটানা পড়তে পড়তে ক্লান্তি আর হতাশা ভর করতো। তখন সুশান্ত দা কিংবা মাশরুফ ভাইয়ের লেখাগুলো টনিকের মত কাজে দিয়েছে। ফেসবুক গ্রুপগুলো থেকে রিটেনে কিছু হেল্প পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু প্রিলিমিনারির জন্য ওদিকে না যাওয়াই বেটার।

বিসিএসে আমার গ্রুপ স্টাডির সুযোগ ছিলোনা। তবে মেডিকেল কলেজের অভিজ্ঞতা থেকে আমার ধারণা, একা একা পড়ার চেয়ে গ্রুপ স্টাডি বেশি কার্যকরী, অবশ্য যদি পড়ার চেয়ে আড্ডার পরিমাণ বেশি না হয়।

বাংলানিউজ: ভাইভা বোর্ডের অভিজ্ঞতা জানতে চাই?
শোভন চন্দ্র হোড়: আমি আব্দুল জব্বার খান স্যারের বোর্ডে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। প্রথম পছন্দ ছিলো পররাষ্ট্র এবং দ্বিতীয় পছন্দ ছিলো পুলিশ। ভাইবার আশিভাগ প্রশ্নই ইংরেজিতে ছিলো এবং প্রায় সবগুলো প্রশ্নই ছিলো আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কূটনীতি ইত্যাদি থেকে। আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে যে, স্যাররা মূলত জানার কোয়ানটিটি না, কোয়ালিটি যাচাই করার চেষ্টা করেন। ডাক্তারি পড়ার সুবাদে প্রায় প্রতিদিনই ভাইবা দিয়েছি, তারপরেও কিছুটা নার্ভাসনেস তো থাকেই। জীবনের প্রথম চাকরির পরীক্ষায় নার্ভাস হওয়া, একটু তোতলামো করা, জানা প্রশ্নের উত্তর গুলিয়ে ফেলা এগুলো হতেই পারে। ওভারস্মার্টনেস দেখাতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। বোর্ডে স্যাররা অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন। ভাইবা শেষে মনে হয়েছে, এটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা ভাইবা দিয়েছি। পাশ করবো এটা নিশ্চিত ছিলাম। ভাইবার পরই মূলত মনে হয়েছিলো যে একটা ক্যাডার পেলেও পেতে পারি। তবে পুলিশ ক্যাডারের একদম শুরুর দিকে থাকবো, এতোটা কখনোই কল্পনা করিনি।

জুনিয়রদের বলি- আত্মবিশ্বাসী থাকুন, তবে বিনয়ী থাকুন, শান্ত থাকুন। বোর্ডের সাথে তর্কে যাবেন না কোন অবস্থাতেই।

বাংলানিউজ: মানুষ অসুস্থ হলে যেমনিভাবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়, তেমনি বিপদে পড়লে পুলিশের সহায়তা চায়- ভবিষ্যতে জনগণকে কেমন সেবা দিতে চান?
শোভন চন্দ্র হোড়: আমি একটা জিনিস মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আপনার যদি মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছে থাকে, আপনি যেকোনো পেশা থেকে সেটা করতে পারেন। এর জন্য ডাক্তার কিংবা পুলিশ হওয়া জরুরী না। একেকটা পেশা একেকটা উপায় মাত্র। দুর্নাম এর কথা যদি বলেন, যে পেশা যত বেশি যত বেশি জনসংশ্লিষ্ট, সে পেশায় সমালোচিত হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। ডাক্তার হিসেবে মানুষের অসহায়ত্ব খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে, আশা করি সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মানুষের কষ্ট লাঘব করতে পারবো।

বাংলানিউজ: ক্যাডার চয়েজের ক্ষেত্রে আপনার অভিমত কি?
শোভন চন্দ্র হোড়: একেকজন মানুষ সম্পূর্ণ অনন্য একটি সত্ত্বা। তাই একেকজনের পছন্দও একেক রকম। তাই নতুনদের বলবো, কেবল মানুষের মুখে শুনে শুনে না; বরং নিজে জেনেশুনে, খোঁজ নিয়ে তারপরেই ক্যাডার চয়েস দেওয়া উচিত। নাহলে, বিসিএস ক্যাডার হয়ে পরে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন এই সংখ্যাটাও একদম কম না। সেরকম যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

বাংলানিউজ: ভবিষ্যতে যারা বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ?
শোভন চন্দ্র হোড়: বিসিএসের জন্য আটঘাট বেঁধে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। তবে সেটা অবশ্যই এবং অবশ্যই গ্র্যাজুয়েশনের পরে। আগে প্রস্তুতি নিতে গিয়ে দেখা যাবে একাডেমিক রেজাল্ট খারাপ করে বসে আছেন। খারাপ রেজাল্ট ভাইবাতে কখনো ভালো ইমেজ তৈরি করে না। আর দুইশ' নম্বরের ভাইবা কোন ছোটখাটো পরীক্ষা না। এক দুইজন খারাপ রেজাল্ট করে ক্যাডার হয়েছেন, ফার্স্ট সেকেন্ড হয়েছেন, তার মানে এই না যে খারাপ রেজাল্ট করলেই ক্যাডারপ্রাপ্তি নিশ্চিত! বিসিএস অন্য দশটা প্রথম শ্রেণির চাকরির মতই একটা চাকরি। হয়তো সামাজিকভাবে একটু বেশি সমাদর পাওয়া যায়, এতটুকুই। একই গ্রেডের অন্য চাকরিগুলোকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আড়াই লাখ প্রতিযোগীর মধ্যে ক্যাডার হবে মাত্র দুই হাজার। বাকীদের জীবন কি তবে ব্যর্থ? কখনোই না। ভালো প্রস্তুতি নিলে কখনো লাভ বৈ ক্ষতি হবে না। এক্ষেত্রে Les Brown এর একটা কথা বলে শেষ করি, "Shoot for the moon. Even if you miss, you'll land among the stars." সবার জন্য শুভকামনা রইলো।

আপনার সাফল্যের গল্পই অন্যের জন্য অনুপ্রেরণা। আমরা জানতে চাই, জানাতে চাই আপনার ক্যারিয়ারে সফলতার গল্প। আপনার মতামত জানাতে বা লেখা পাঠাতে চাইলে আমাদের ইমেইল করুন [email protected] ঠিকানায়। বাংলানিউজের সাথেই থাকুন...

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।