জ্যাক মা’র উক্তিটি ছিলো -
“Find the Right People, not the Best People”
আমি আগে যেখানে কাজ করতাম, সেখানে আমি কয়েকজন সহকর্মী পেয়েছিলাম, যারা কাজের ব্যাপারে ছিলো খুবই উদ্যমী, পরিশ্রমী, নতুন কিছু শিখতে উৎসাহী ও কঠিন কাজের চ্যালেঞ্জ নিতে সব সময় প্রস্তুত। বিশ্বাস করুন বা না করুন, এক কথায় এই টিমকে বলা যায় "সুপার কুল"।
এবার আমার দেখা আরেকটি টিমের উদাহরন দেই। টিম বন্ডিং ও উদ্যম এর সম্পূর্ণ বিপরীত দৃশ্য এটি। আমার চোখের সামনেই টিমটিকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখি। এমন না যে, এখানকার কোনো কর্মী কম মেধা সম্পন্ন ছিলো বা তারা তাদের কাজ করতে অপারগ। সমস্যাটা শুরু হয় কিছু ভুল নির্দেশনা ও অযাচিত ব্যবহার থেকে। টিম ম্যানেজার কারো উপর ভরসা পেতেন না। অল্পতেই সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন। এমনকি ম্যানেজমেন্টকে দেখানোর জন্য মাঝে মধ্যেই ছুটির দিনেও কাজ নিয়ে কর্মীদের মেইল করা শুরু করতেন। কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে আওয়াজ তুললেও, সেটি ম্যানেজমেন্ট আমলে নিতো না। যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া তারা পরে দেখতে পায়। পরবর্তীতে সেই টিমের অধিকাংশ কর্মী যখন চাকরি ছেড়ে দেয়, তখন ম্যানেজারকেও পদচ্যুত করা হয়।
শুনে হয়তো মনে হতে পারে, সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। অথবা ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস কিছু না। কিন্তু এরকম একটি অবস্থা ও অযোগ্য দলনেতা একটি কোম্পানিকে ধ্বংসের দ্বারে নিয়ে যেতে পারে। কারন আজকে যারা এই কোম্পানির উপর আস্থা হারিয়ে, বিরক্ত হয়ে চলে গেলো, তারা কখনোই এই কোম্পানি সম্পর্কে ভালো রিভিউ করবে না বা কাউকে এখানে আসতে উৎসাহও দিবে না।
এখন কি মনে হচ্ছেনা, এটি একটি বড় সমস্যা? আর এজন্যই বড় বড় কোম্পানিগুলো সব সময় তাদের একটি পদের জন্য সবকিছু বাদ দিয়ে, যোগ্য ও সঠিক লোকের সন্ধানে উঠেপড়ে লাগে।
এই লেখাটি নিয়ে যখন ভাবছিলাম, তখনই আমার কথা হয় হেশ ট্যাগ মাইন্ডের সিইও মি. মার্সের সাথে। কেন একটি পদে সব সময় একজন সফল কর্মীর থেকে একজন যোগ্য ও সঠিক মানুষেরই এতো প্রয়োজন। মার্স তার সেক্টরে বিগত আঠারো বছর ধরে সাফল্যের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। কর্মীদের কাছে তিনি খুবই জনপ্রিয় একজন বস। তার অবস্থানকালে, ডিজিটাল মার্কেটিং, পাবলিক রিলেশন, কাস্টমার ম্যানেজমেন্টসহ অনেক বিভাগে তিনি প্রতিটি দিন নতুন কিছু শিখেছেন, যা একটি প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসাকে দাপটের সাথে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে যেটিকে অবহিত করেছেন তা হলো- নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ও দক্ষতা। তার শুরুটা ছিলো যেমন চ্যালেঞ্জিং, তেমনি অনেক কঠিন। অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে আজ সে একজন সুনামধন্য সিইও।
তার ভাষ্যমতে, নেতৃত্ব দেয়া অত্যন্ত ফলপ্রসূ একটি ভূমিকা, কিন্তু চ্যালেঞ্জিং সিদ্ধান্তগুলো আসে একটি টিম বা সেক্টরকে কেন্দ্র করে। আর এ পর্যন্ত যতগুলো সিদ্ধান্ত এসেছে, তার কোনোটাই খামখেয়ালিপনা বা এমনি এমনি ছিলো না। কর্মীরা কিছু কিছু ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হতো, কিন্তু এসব ডিসিশনের ফলে যেসব ভালো ফল পেতো তারা, সেগুলো ছিলো অসাধারণ।
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে 'রং সিটার্স' এর অনুপাত
দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসাগুলো যদি একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে টিম ম্যানেজমেন্ট স্কিল ও নেতৃত্বের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। যাকে আমরা 'Wrong Seaters' হিসেবে অবহিত করতে পারি।
সঠিক লোকের ভুল স্থানে থাকা, আর ভুল লোকের সঠিক স্থানে থাকার ফলাফল ঐ একই, শুন্য (০)। তারা কেউই নিজের স্থান নিয়ে সন্তুষ্ট না, যার নজির তাদের কাজের মাধ্যমেই পাওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট দেশ বাংলাদেশে রং সিটার্সের সংখ্যাটা ভয়াবহ। দেশের জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, রং সিটার্সের সংখ্যাটাও এর সাথেই পাল্লা দিয়ে বেড়েই যাচ্ছে। পরিচিত কয়েকজনের উদহারন দিচ্ছি।
প্রথম ব্যক্তি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলেও কাজ করছেন দেশের একটি ই- কমার্স কনটেন্ট সেকশনে। তার শিক্ষার বিন্দু পরিমাণ ব্যবহারও এখানে সে করতে পারছে না। তাহলে সেই শিক্ষার মানে কি? সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সে একজন এসইও (SEO) এক্সপার্ট। যথাযথ সুযোগ সুবিধার অভাবে আজ না সে আইনজীবী, না ডিজিটাল মার্কেটার।
দ্বিতীয় ব্যক্তি একজন মার্কেটিং গ্র্যাজুয়েট। যার স্বপ্ন আকাশচুম্বী। সৃজনশীলতা, চিন্তা চেতনায় অসাধারণ একজন মানুষ। কিন্তু কাজ করছে একটি ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিভিশনে। এই চাকরিটা তার অত্যন্ত অপছন্দের। বলতে গেলে একদম না পেরেই এই চাকরিতে তার আসা। ফলাফল চাকরি ও জীবন উভয়টা নিয়েই সে অসন্তুষ্ট।
শুধু এই উদহারন দুটিই কিন্তু শেষ নয়। সারা পৃথিবীতে, এমন আরো লক্ষ কোটি মানুষ আছে যারা বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ভুল জায়গায় থেকেই কাটিয়ে দিচ্ছে। অনেকে বুঝতে পেরে সময় থাকতেই নিজের সঠিক জায়গাটি বুঝে নেয়, আবার অনেকে সময় হারিয়ে বুঝে। কিন্তু সবাই এক সময় বুঝে। পার্থক্য এতটুকুই।
এক সেকেন্ডের জন্য ফলাফলটি কল্পনা করুন
আমি এমন একজন এইচআর হেড-এর অধীনে ছিলাম যার নিজের এইচআর নিয়ে যথাযথ জ্ঞান এবং পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তিনি জোর পূর্বক ঐ কোম্পানিতে কিছু ভুল নিয়ম নীতি চালু করেন এবং সেসব অবাঞ্চিত নীতি মেনে নেয়ার জন্য কর্মীদের বাধ্য করেন, যদিও তিনি নিজেই সেগুলো মানতেন না। এর ফলাফল স্বরূপ একটি ডিপার্টমেন্টের সকল কর্মী তাদের চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। ব্যাপারটা ঠিক কতটা ভয়াবহ, একবার ভাবুন তো !!
একজন শুধুই ডিজিটাল মার্কেটিং সনদপ্রাপ্ত ব্যক্তি কিভাবে মার্কেটিং ম্যানেজার বা ইন-চার্জের দায়িত্ব পায়, যখন তার দেশের টোটাল মার্কেটিং সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানের অভাব থাকে? দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট একটি দেশ বাংলাদেশ, যেখানে হাইস্পিড ইন্টারনেট যখন সবার হাতের নাগালে নেই, বা দেশের ব্যবসায় যেখানে এখনো ডিজিটাল নির্ভর হয়নি, তখন কিভাবে দেশের শুধু মাত্র ডিজিটাল মার্কেটিং সেদেশের একটি ব্যবসাকে দাড় করাবে বা মুনাফা এনে দিবে? সেদেশের জন্য কি ব্যাপারটি খুব ভয়ংকর বলে মনে করছেন না আপনি?
একটি পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। আপনাদের হয়তো জানা আছে যে, পরিবর্তনই হচ্ছে সকল শিক্ষার শেষ ফলাফল। আমরা কখনোই রাতারাতি পরিবর্তনের কথা বলবো না বা সমর্থন করবো না। কিন্তু আমরা যা জানি বা বুঝি তা হলো, আমাদের অবশ্যই নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে। সঠিক স্থানের জন্য সঠিক মানুষও নির্বাচন করতে হবে এবং সবার নিজ নিজ জীবন ও পছন্দের ব্যাপারে সচেতনও হতে হবে। আর এজন্য আমাদের করতে হবে কঠোর পরিশ্রম, কারন পরিশ্রম ব্যতীত কোনো জাতির উন্নতি হবে না।
জীবনে একবার যদি ভুল ট্র্যাকে চলে যান, তা থেকে ফিরে আসা রীতিমতো অসম্ভব। জীবন নিয়ে সিরিয়াস হোন। কারন, এই জীবনটা আপনার এবং সেটিকে 'শুধুই নিজের' করে নেয়ার সম্পূর্ণ অধিকারটুকুও শুধু আপনারই রয়েছে।
লেখক: গোলাম আসাদ পিয়াস
লাইফ হ্যাকিং ব্লগার ও
কনটেন্ট মার্কেটিং স্পেশালিস্ট
প্রিয় পাঠক, আপনার প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, ক্যারিয়ার বিষয়ক যেকোন প্রশ্নের উত্তর জানতে, আপনার মতামত জানাতে বা লেখা পাঠাতে চাইলে আমাদের ইমেইল করুন [email protected] ঠিকানায়। বাংলানিউজের সাথেই থাকুন...