ঢাকা, বুধবার, ২৭ কার্তিক ১৪৩১, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কাজী নজরুল ও বিদ্রোহী কবিতার সেই বাড়িটি

রক্তিম দাশ, ব্যুরো চিফ, কলকাতা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২৭ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১২
কাজী নজরুল ও বিদ্রোহী কবিতার সেই বাড়িটি

যে কবিতাটি নজরুলকে তাঁর কবি-জীবনের শুরুতেই খ্যাতির চরম শিখরে নিয়ে যায়, তার নাম ‘বিদ্রোহী’। নজরুল দ্রোহ-ভাবাপন্ন আরও অনেক কবিতা লিখলেও শুধু এক ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্যই তিনি বাঙালির চিরকালের ‘বিদ্রোহী কবি’।

এই বছরটি বিদ্রোহী কবিতার ৯০ বছর পূর্তি।

এরকম অসাধারণ শব্দচয়ন, স্বতন্ত্র ভাষারীতি ও অভিনব ছন্দের গাঁথুনিতে রচিত বিদ্রোহ-দৃপ্ত, রুদ্ররোষে বলীয়ান কবিতা বাংলা সাহিত্যে আর একটিও নেই। এমনকি বিশ্বসাহিত্যেও এর তুলনা খুঁজে পাওয়া ভার।

ভারতীয় উপমহাদেশ তখন ব্রিটেনের পরাধীন। প্রথম মহাযুদ্ধ সবেমাত্র শেষ হয়েছে। নজরুল তাঁর সৈনিক জীবন সমাপ্ত করে ফিরে এসেছেন কলকাতায়। বেছে নিয়েছেন সাহিত্য চর্চা, সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক আন্দোলনের এক ত্রিমুখী জীবন। ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে সারা ভারতবর্ষ তখন টালমাটাল।

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ‘নবযুগ’ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করলেন। তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। একই সাথে তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।

এমনই এক উত্তাল সময়ে ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে নজরুল রচনা করেন তাঁর কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। বিদ্রোহীর রচনাকাল নিয়েও দ্বিমত আছে সহিত্যবোদ্ধাদের মধ্যে।

সুশীল কুমার সেনগুপ্তের মতে, (বিদ্রোহী) কবিতাটি রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের দুর্গাপূজার কাছাকছি সময়ে। কিন্তু কবিবন্ধু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজাফ্‌ফর আহমেদের মতে, বিদ্রোহী রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক রাতে।

‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মতিকথা’য় তাঁর দাবি- কবি নজরুল ‘বিদ্রোহী’ রচনা করেন ১৯২১ সালে কলকাতার ৩/৪ সি তালতলা লেন বাড়িতে। উক্ত বাড়ির নিচের একটি ঘরে নজরুল ও বন্ধু মুজাফ্‌ফর আর পুরো বাড়িতে বিখ্যাত নবাব ফয়জুন্নিসা চৌধুরানীর নাতিরা ভাড়াটে হিসেবে থাকতেন।

তিনি লিখছেন, প্রথমে বিদ্রোহী কবিতাটি পেন্সিলে লেখা হয়েছিল এবং মুজাফ্‌ফর আহমেদ এ কবিতাটির প্রথম শ্রোতা। ‘বিদ্রোহী’ রচনার পরে কবি নজরুল একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে পুরো কবিতাটি মুজাফ্‌ফরকে পড়ে শোনান। কিন্তু বন্ধু মুজাফ্‌ফর স্বভাবগত কারণে শোনার পর অনুভূতি প্রকাশ করেননি, তাই নজরুল মনঃক্ষুণ্ণ হন।

এটি প্রথম প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় ইংরেজি ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বা বাংলা ১৩২৮ সালের ২২ পৌষ তারিখে। কবিতাটি প্রকাশ হওয়া মাত্র এমনই জনপ্রিয় হয় যে, একই সপ্তাহে প্রকাশক পত্রিকাটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের করেন।

এরপর মাসিক ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় (পত্রিকাটি অনিয়মিত হওয়ায় বাংলা ১৩২৮ সালের কার্তিক মাসের পরিবর্তে মাঘ মাসে প্রকাশিত হয়েছিল) ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আবারও ছাপা হয়। একই বছর এটি মাসিক ‘প্রবাসী’ এবং মাসিক ‘বসুমতী’ এবং পরের বছর (১৩২৯ সালে) মাসিক ‘সাধনা’য় পুনঃপ্রকাশিত হয়।

‘বিদ্রোহী’ কবিতার এই পুনঃ পুনঃ প্রকাশনা তখনকার সময়ে পাঠক ও প্রকাশকের মধ্যে এর তুমুল জনপ্রিয়তার প্রমাণ বহন করে। বস্তুত এই কবিতার জন্ম বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত সাড়া জাগানো ঘটনা। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকা, ব্রিটিশরাজের অনুগ্রহ-প্রত্যাশী বাঙালি জাতিকে নজরুল এ কবিতার মাধ্যমে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিলেন।

বিশেষ করে মুক্তিকামী বাঙালি তরুণ সমাজের কাছে এ কবিতা ছিল রক্তে উন্মাদনা সৃষ্টিকারী, হৃদয়ে অগ্নি-প্রজ্বলনকারী এক বজ্রকঠিন বার্তা। তাদের হয়ে যেন নজরুল বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন:

আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!

নজরুলের এই রুদ্ররোষ যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার-কর্তৃক তাঁর একাধিক প্রকাশিত গ্রন্থ বাজেয়াপ্তকরণ ও তাঁকে কারাদণ্ড প্রদান তারই প্রমাণ।

জানা যায়, এই কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরই নজরুল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন এবং কাব্যাবেগে আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, “গুরুদেব, আমি আপনাকে খুন করব, খুন। ” ‘বিদ্রোহী’র এই বজ্রনিনাদ শুনে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “হ্যাঁ, কাজী, তুমিই পারবে আমাকে খুন করতে। ” বস্তুত সেদিন থেকেই তাঁদের মধ্যে গুরু-শিষ্যের এক মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, যা অটুট ছিল রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত।

তারপর ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’য় এটি আরও ১২টি কবিতার সাথে স্থান পায়। ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশ করেছিল কলকাতার আর্য পাবলিশিং হাউস।

এর প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই’পো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অংকন করেছিলেন শিল্পী বীরেশ্বর সেন। ‘অগ্নিবীণা’ এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে প্রকাশের সাথে সাথেই এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং তারপর আরও কয়েকটি সংস্করণ বের হয়েছিল। বিদ্রোহী-ভাবাপন্ন কবিতা-সম্বলিত ‘অগ্নিবীণা’ বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের উছ্বসিত প্রশংসা তখন বেরিয়েছিল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার পাতায় পাতায় এবং অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের মত লেখকদের লেখায় লেখায়।

বিদ্রোহী প্রকাশের পরপরই মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে কঠোর সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মুসলিম সমাজ নজরুলের বিরুদ্ধে মৌখিক ও লিখনীর মাধ্যমে উঠে পড়ে লাগে। তাদের মতে নজরুল ধর্মদ্রোহী ও কাফের হয়ে গেছেন। তিনি ইসলাম ধর্মের অবমাননা করেছেন। বিদ্রোহীতে নজরুল লিখেছেন-

‘ভ্যূলোক দ্যুলোক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর। ’

মুসলমান সমাজের কঠোর সমালোচনার মধ্যে মুন্শী মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দিন আহমদের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘মোসলেম ভারতে বিদ্রোহী কবিতাই কাজীর কারামৎ জাহির হয়েছিল। তারপর ধুমকেতু প্রত্যেক সংখ্যায় পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে গরল উদ্গীরণ করিতেছে। এ উদ্দাম যুবক যে ইসলামী শিক্ষা আদৌ পায় নাই তাহা ইহার লেখার পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পাইতেছে। হিন্দুয়ানি মাদ্দায় ইহার মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ।   …নরাধম হিন্দু ধর্মের মানে জানে কি?  …এই রূপ ধর্মদ্রোহী কুবিশ্বাসীকে মুসলমান বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে না। (লোকটা মুসলমান না শয়তান?)

কবি নজরুল এবরাহিম খাঁর একটি চিঠির উত্তরে মুসলিম সমাজের সমালোচনার উল্লেখ করে লেখেন- ‘মুসলমান সমাজ যে আমাকে কাফের খেতাব দিয়াছে তাহা আমি মাথা পাতিয়া গ্রহণ করিয়াছি। ইহাকে আমি কোনদিন অবিচার বলিয়া অভিযোগের বিষয় করি নাই। কারণ আমার আগে ওমর খৈয়াম, শামসুদ্দিন হাফেজ কিংবা মনসুর আল হাল্লাজকেও কাফের বলিয়া ছিল। ’

শুধু যে মুসলিম সমাজ কবি নজরুলের সমালোচনা করে তাঁকে কাফের মুরতাদ কিংবা হিন্দুয়ানি আখ্যা দিয়ে বিতর্কিত করেছিল তা নয়- হিন্দু সমাজও তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ ও ‘উগ্রমুসলমান’ বলে আখ্যা দিয়েছিল।

কবি নজরুল দুঃখ পেয়ে লিখেন- ‘কয়েক জন গোড়া ‘হিন্দুসভা’ওয়ালা তাহার নামে মিথ্যা কুৎসাও রটনা করিতেন। ইহাদিগকে আঙ্গুল দিয়া গণনা করা যায়, ইহাদের আক্রোশ সম্পূর্ণ সম্প্রদায় বা ব্যক্তিগত। আজকাল কার সাম্প্রদায়িক মাতলামির দিনে, আমি যে মুসলমান ইহাই হইয়া পড়িয়াছে অনেক হিন্দুর কাছে অপরাধের সামিল আমি যত বেশি অসম্প্রদায়িক হই না কেন?’

তৎকালীন হিন্দু লেখকসমাজ কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’র আরবি, ফার্সি শব্দের সাথে সংস্কৃত শব্দের মিলবন্ধনকে মেনে নিতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি ‘বিদ্রোহীর দ্রোহ ভরা চরণগুলোকে। কবি তাঁর দ্রোহের প্রকশ ঘটিয়েছেন এভাবে-
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিব পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালি বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম অন্য স্থানে চরণ জুড়ে দেন-

‘আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়।
জগদ্বীশ্বর ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্য!’

‘বিদ্রোহী’ কবিতা মুসলিম এবং হিন্দু সমাজে সমালোচনা সৃষ্টির পাশাপাশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ব্রিটিশ শাসিত পুরো উপমহাদেশে।

বাংলাদেশ সময়: ২৩৩০ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১২

 

আরডি/সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর, ফেরদৌস মাহমুদ, শিল্প-সাহিত্য সম্পাদক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

শিল্প-সাহিত্য এর সর্বশেষ