ঢাকা: একগাদা দলিল দস্তাবেজ ঘেটে জমির খতিয়ান বের করলেন প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। হালনাগাদ এবং পুরনো দলিল সবই রয়েছে।
প্রতাপের অন্য একটি রাজত্ব রয়েছে। খেলার রাজ্য। এখানে রাজা-প্রজায় ভালোবাসার সম্পর্ক। সম্পদ নেই, সুখ্যাতি আছে। এই সম্পদের কোনো দখলদারও নেই। সেজন্যই খেলার মাঠের অর্জনগুলোকে সবকিছুর উর্ধ্বে রাখেন প্রতাপ,‘দেশকে কতটা দিতে পেরেছি জানি না। তবে পেয়েছি অনেক। আমি একটা উকিলের ছেলে কিন্তু বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে গেলে মানুষ আমাকে চেনে। প্রচারহীন সময়ের একজন খেলোয়াড়কেও যে এত মানুষ চেনে, এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে। ’
দোগাছি গ্রামের কথা এখনও মনে পড়ে প্রতাপের। মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানায় কলাপাড়া ইউনিয়নের ওই গ্রামটিতে ১৯৪২ সালের ৪ এপ্রিল তাঁর জন্ম। যদিও বেড়ে উঠেছেন ঢাকার আরমানিটোলার বাড়িতে। তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় প্রতাপের লেখাপড়ার চেয়ে খেলাধূলায় আগ্রহ ছিল বেশি। ফুটবল, হকি এবং ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকতেন। খেলোয়াড় ছেলের জন্য গর্বিত ছিলেন মা অন্নপূর্ণা হাজরা। পিতা প্রিয়শঙ্কর চেয়েছিলেন পুত্র প্রতাপও বিদ্বান হয়ে উঠুক। ছেলে বিদ্বান হলেন ঠিকই, কিন্তু ক্রীড়ার ওপরে। লেখাপড়া যেটুকু হলো তা ওই সনদের জন্য। ১৯৬০ সালে আরমানিটোলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তৃতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। ফুটবল-হকিতে পারদর্শী প্রতাপকে পেয়ে জগন্নাথ কলেজের শিক্ষককূলের সেকি আনন্দ। খেলায় উন্নতির জন্য উজ্জীবিত করতে লাগলেন স্বয়ং শিক্ষকরা,‘ওই সময়ের শিক্ষকরা কেবল শিক্ষার মধ্যে আটকে থাকেননি। খেলাকেও সমান গুরুত্ব দিতেন। একদিন খেলা শেষে জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। উনার কোর্ট আমার ঘামে ভিজে যায়। কিন্তু ওসব নিয়ে তিনি ভাবেননি। ’
পরীক্ষার বসতে না পারায় নির্ধারিত সময়ের দুই বছর পর ১৯৬৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন প্রতাপ। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেও জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন খেলায় খেলায়। বিভাগীয় শিক্ষকদের আশীর্বাদে সময় মতো বিএ পাশ করলেন ঠিকই।
প্রতাপ শুধু একজন খেলোয়াড়ই নন। কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকও। খরচপাতি জোগাতে ভাড়ায় ফুটবল খেলেছেন,‘কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের কিছু খরচপাতি হতো। ভাড়ায় খেলে যে টাকা পেতাম তা থেকে আমার অংশ রেখে মায়ের হাতে তুলে দিতাম। ওই টাকা থেকে মা দলের ছেলেদের নাস্তা করাতেন এবং নিজের হাত খরচ নিতেন। এমনও দেখা গেছে একদিন পর পর খেলা থাকলে মা নিজের হাতে জার্সি-প্যান্ট ধুয়ে শুকিয়ে রাখতেন। মায়ের সংসারের অংশ ছিল কম্বাইন্ড স্পোর্টিং। ’
এই প্রজন্মের কাছে প্রতাপ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের একজন খেলোয়াড় এবং জাতীয় হকি দলের কোচ হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত। আসলে তিনি ছিলেন একজন সব্যসাচী খেলোয়াড় এবং খেলোয়াড় গড়ার কারিগড়। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে খেলেছেন। হকিতে পূর্ব-পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ মাতিয়েছেন। সেই ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলের তারকা খেলোয়াড় প্রতাপ,‘পাকিস্তান ফুটবল দলে খেলার পরেও মনে হয়েছে হকিটা আমার বেশি আয়ত্বে। হকি আমি ভালো বুঝি। ব্যক্তিগতভাবে আমি ফুটবলের চেয়ে হকি ভালো খেলি। ৬৫ সালে পাকিস্তান জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ খেলার পরে আমাকে দেড়শ জনের ভেতরে নির্বাচন করা হয় ট্রায়াল দেয়ার জন্য। পাঁচদিনের ট্রায়াল হলো, আমি ৪০ জনের মধ্যে এলাম। ব্রিগেডিয়ার আতিক সাহেব বললেন এক মাসের ক্যাম্প হবে। এদিকে ফুটবলের ক্যাম্প শুরু হয়ে যাচ্ছে ঢাকাতে। আমি বললাম পাকিস্তান দলে আমি ফুটবল খেলি, একমাস এখানে থাকলে ফুটবলের ক্ষতি হবে। এছাড়া হকিতে সুযোগ পাবো কি না জানি না। আমার জন্য ফুটবলটাই ভালো। ব্রিগেডিয়ার সাহেব আমাকে ছেড়ে দিলেন, আমি ফুটবল ক্যাম্পে যোগ দিলাম। এই যে ৪০ জনের ভেতরে আসা এটা সাংঘাতিক ব্যাপার। বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি দল তখন পাকিস্তান। সেই দেশের সেরা ৪০ জনের একজন আমি। এটাও হকিতে থাকার জন্য প্রেরণা যুগিয়েছে। ’

‘১১ মে আমরা বর্ডার ক্রস করি। আমাদের সাথে ছিলেন জাহানারা ইমামের ছেলে রুমি, অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ এবং মানিক, যার নামে পরবর্তীতে মানিকনগর নাগমকরণ করা হয়েছে। মনিরুল আলম নামে একজন গণসঙ্গীত শিল্পী ছিলেন আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধু। সে-ই আমাদের স্কোয়াড করে নিয়ে যায় আগরতলায়। সেখান থেকে আমরা কলকাতায় চলে যাই। কলকাতায় গিয়ে আমি এবং জেনারেল নুরুন্নবী একদিন ঘুরতে গেছি দেখা হয় ফুটবলার আলী ইমামের সাথে। তিনি আমাদের জানান, পশ্চিম বাংলা ফুটবল এসোসিয়েশনের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে একটি ফুটবল দল গড়ে কোনোরকমে ভদ্রভাবে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য। সেখানে আমরাও যোগ দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। ’
এরমধ্যে হঠাৎ একদিন জুন মাসের দিকে প্যাটেল নামে এক ফুটবল খেলোয়াড় আমার দাদার কোয়ার্টার পুলিশ স্টেশনে এসে হাজির। ওই ব্যক্তি আমাকে বললেন, দাদা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে লুৎফর রহমান সরকার আমাকে পাঠিয়েছেন। এখানে একটা ফুটবল দল হোক সেটা তারা চান। কারণ ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ভুল ধারণা হয়েছে ভারত এবং পূর্ব-পাকিস্তানের হিন্দুরা মিলে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করছে, সেই ভুল ভাঙাতে হবে ফুটবল দলের মাধ্যমে। বোঝাতে হবে এটা ভারতের বা হিন্দুদের ষড়যন্ত্র না এটা আমাদের নিজস্ব দাবি। যে উদ্দেশে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল হলো সেটা সফল হয়েছিল। ’
খেলার সুবাদে একটা চাকরি পেয়েছিলেন জনতা ব্যাংকে। পদন্নোতির কথা কোনোদিন ভাবেননি। খেলার মাঠে পড়ে থেকেছেন। একটি পুরনো মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে এ-মাঠ ও-মাঠ এবং মোহামেডান কাবে দিন কাটিয়ে বাড়ি ফিরতেন। দুই মেয়ের সঙ্গে সবদিন হয়তো তার কথাও হতো না। কোচিং করিয়ে অর্থ উপার্জনের চিন্তাও করেননি,‘সালাম ভাই আমাকে হকি শিখিয়েছেন। কোচিংয়ের দীক্ষাটা উনার কাছ থেকেই পেয়েছি। খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর মনে হলো কোচিং কোর্স করা দরকার। ফুটবলে তো কোচের অভাব নেই। সিদ্ধান্ত নেই হকির কোচ হবো। পাতিয়ালা থেকে কোচ হয়ে আসি এবং হকিতে থাকি। ’
প্রতাপের জীবন বৃত্তান্তে উঠে এসেছে অনেক ঘটনা। সেখান থেকে সামান্যই তুলে ধরা গেছে। ২০০১ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রাপ্ত এই সব্যসাচী ক্রীড়াবিদের জনপ্রিয়তার একটি গল্প উপসংহারে তুলে ধরা হলো তারই জবানিতে,‘৬৯ এর দিকে হাতিয়াতে খেলতে গেছি। খেলা শেষে স্টিমারে করে নোয়াখালি এসে নেমেছি। স্কুটারে আসতে হবে ঢাকায়। কিন্তু রাস্তায় কোনো স্কুটার নেই। লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে তারা বলেন কোনো পরিবহন নেই। একজন বললেন একটা স্কুটার আছে। মালিককে রাজি করাতে পারলে ঢাকায় ফিরতে পারবেন। স্কুটারের মালিক বাসা থেকে বেরিয়ে এসে আমার মুখে লাইট ফেলে দেখতে লাগলেন। আমি তাকিয়ে আছি। উনি বললেন, ‘তুমি মোহামেডানের প্রতাপ না। ’ আমার মনে হলো আমি হাতে আকাশের চাঁন পেয়ে গেলাম। এক অজ পাড়াগায়ে থ্রিহুইলার পেলাম। তাকে বললাম ঢাকায় যেতে পারছি না আটকে গেছি। তিনি বললেন, আমি থাকতে ভয় কিসের। একটা রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে দিয়ে বললেন আপনারা ওখানে খান। আমি রেডি হয়ে আসছি। তিনি রেডি হয়ে এলেন, আমরা সাতজন খেলোয়াড় ওই স্কুটারে চরে ঢাকায় এলাম। এমন সম্মান আর কোথায় পাবেন। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৬ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১৩
এসএ/এফএইচএম