ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ চৈত্র ১৪৩১, ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১১ শাওয়াল ১৪৪৬

ফিচার

মৃত্যুতে পশুপাখি শোকগ্রস্ত কেন হয়?

হাসান শাহরিয়ার হৃদয়, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৯ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৩
মৃত্যুতে পশুপাখি শোকগ্রস্ত কেন হয়?

কাককে দেখতে কুৎসিত, শুনতে কর্কশ পাখি হিসেবেই জানি। তাদের স্বভাবটাও লোভী ধরনের, যা পায় তা-ই খায়।

ছোট শিশুরা তো কাক দেখলেই ভয় পায়। বিভিন্ন পুরাণে কাককে দেখা হয় অমঙ্গল, জাদুটোনা, শয়তানির প্রতীক হিসেবে। কোথাও একটি কাক মারা গেলেই সেটিকে ঘিরে শুরু হয়ে যায় এক দঙ্গল কাকের চেঁচামেচি, কা কা। এরকম সময় আমরাও হয়তো বিরক্ত হয়ে কাকগুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন, প্রিয়জনের মৃত্যুর পর যদি তার মৃতদেহের পাশ থেকে আপনাকে এভাবে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, আপনার কেমন লাগবে?

তুলনাটা শুরুতে হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বলছে অন্য কথা। শেষ মুহূর্তে প্রিয়জনের পাশ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে আপনার যে অনুভূতি হবে, তা ‘হুশ, হুশ’ করে তাড়িয়ে দেওয়া কাকদের চেয়ে খুব ভিন্ন কিছু নয়।

মানুষের পর যেসব প্রাণী সঙ্গীর মৃত্যুতে দ্রুততম সময়ে সাড়া দেয়, তাদের মধ্যে কাক অন্যতম। কোথাও একটি কাক মরে পড়ে থাকলে তা কিছুক্ষণের মধ্যেই জীবিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দুয়েকটি মৃত কাককে ঘিরে উড়তে থাকে, উচ্চস্বরে ডাকতে থাকে। এই বিশেষ ডাকটি অন্য কাকদেরও চেনা- যে কারণে মুহূর্তের মধ্যে সেখানে হাজির হয় আরও শত শত কাক। অনেকটা আনুষ্ঠানিকতার মতোই তারা মৃত কাককে ঘিরে দাঁড়ায়। কখনও সমস্বরে ডাকতে শুরু করে, কখনও সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যায়। এমনকি কেউ কেউ ঘাস, বা খড়কুটো ঠোঁটে করে এনে মৃত কাকের পাশে রাখে- যেন শেষ শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ জন মার্জলাফের এ ঘটনাকে বলেন, “যেন তারা প্রিয়জনকে হারিয়ে শোক প্রকাশ করছে। ”

মানুষের জন্য এ এক বিস্ময়কর তথ্য বটে। পশুপাখিদের নিয়ে আমাদের খুব নির্দিষ্ট কিছু ধারণা আছে, যার কোনোটিই খুব উচ্চমার্গের নয়। তাদের আমরা খুব সহজ একটা মানদণ্ডে পরিমাপ করি। কৃতিত্ব বলতে এটুকুই যে কোনো কোনো প্রাণী বুদ্ধির পরিচয় দিতে পারে, ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে পারে, মানুষকে সঙ্গ দিতে পারে। কিন্তু দর্শন, বিমূর্ত চিন্তাভাবনা, সমবেদনার মতো জটিল মানবীয় অনুভূতি পশুপাখির মধ্যে কিছুটা হলেও থাকতে পারে, এটা বোধহয় কেউ ভাবেন না। আর জীবনবোধ, মৃত্যুর মতো জটিলতম মনস্তত্ত্বের কথা যদি বলি, তাহলে নিশ্চয়ই এর সামান্যটুকুও পশুপাখির মধ্যে থাকার আশা কেউ করেন না?

বলতে বাধা নেই, শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট সামলাতে ও পশুপাখিকে নিজেদের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে মানুষ বরাবরই এতো ব্যস্ত থেকেছে যে প্রকৃতির এই অবিচ্ছেদ্য অংশকে নিজেদের সঙ্গে তুলনা করার সুযোগ পায়নি। তাদের আচার-আচরণ, ভাবের আদান-প্রদান নিয়ে বিস্তর গবেষণা করলেও বিজ্ঞানীরা কখনও তাদের অনুভূতিকে মানুষের সঙ্গে তুলনা করেননি। শুশুক, ডলফিন, শিম্পাঞ্জি, কুকুরসহ অনেক প্রাণীর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আচরণকে এড়িয়ে গেছেন ‘কিছুটা বুদ্ধিমান প্রাণী’ বলে। এমনকি সঙ্গীর মৃত্যুর পর পশুপাখিদের তীব্র অনুভূতিকে স্রেফ ‘ভয়’ বা ‘অনিশ্চয়তা’ বলে উপেক্ষা করা হয়েছে যুগের পর যুগ।

এটা ঠিক যে আধুনিক মনোবিজ্ঞান যেভাবে মানুষের মনকে বিশ্লেষণ করেছে, পশুপাখির ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও এসব নিয়ে ক্রমাগত বিভিন্ন গবেষণার ফলে যেসব তথ্য বেরিয়ে আসছে, তা-ও আর উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। বরং এবার পশুপাখিদের মনোজগত নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে, এমনটাই ভাবছেন বিশ্বের প্রভাবশালী প্রাণিবিজ্ঞানীরা। animals-02

পশুপাখিরা আমাদের মতোই সামাজিক প্রাণী। আমাদের প্রিয়জন আমাদের কাছে প্রিয়, তাদের প্রিয়জনও তেমনি তাদের কাছে প্রিয়। মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে যেমন প্রিয়জনের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়, প্রাণীদের ক্ষেত্রেও তাই। তাই আমাদের মতো করে শোকতপ্ত হওয়া কি তাদের পক্ষে খুব অসম্ভব? যদি না-ই হয়, তাহলে আমাদের সঙ্গে তাদের শোক পরবর্তী অনুভূতি, শোক প্রকাশের অনুভূতির এতো মিল কিভাবে? ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডোর অধ্যাপক মার্ক বেকফের মতে, এমন অনুভূতি থেকেই শুরু হয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। মানুষ যেমন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে, প্রাণীরাও তাই। তারা আমাদের মতোই পরস্পরকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করে যে সব ঠিক হয়ে যাবে।

দুঃখবোধ অনেক প্রাণীর মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু এর জটিলতম অনুধাবন ও বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় কেবল মানুষের মধ্যেই। সেজন্যেই মৃত্যুকে ঘিরে মানুষের শেষ শ্রদ্ধা জানানো থেকে শুরু করে নানা আয়োজন। বেশিরভাগের মতে, প্রাণীদের জীবনের লক্ষ্যই যেখানে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করা, সেখানে তাদের এরকম জটিল অনুভূতি বোঝার কোনো সুযোগ নেই। তাই তাদের অনুভূতিকে জীবনবোধ বা মৃত্যুবোধের বদলে দেখেন কেবল বিষণ্ণতা ও হতাশা হিসেবে। হয়তো এসময় তাদের মধ্যে ওজন কমা, অরুচি, উদাসিনতার মতো নানা লক্ষণ দেখা দেয়। কিন্তু তা আর যা-ই হোক, মানুষের মতো মৃত্যুশোকে কাতর হওয়া নয়। এমনকি এসব ক্ষেত্রে মানুষের উন্নত মস্তিষ্ক যেভাবে আলোড়িত হয়, অনেক কম বুদ্ধিমান হয়েও পশুপাখির মস্তিষ্ক একইভাবে আলোড়িত হতে দেখা যায়।

কিন্তু কিছু কিছু প্রাণী আচরণে মানুষের মতোই শোক এতো তীব্রভাবে প্রকাশ পায় যে একে বিষণ্ণতা ভেবে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। অনেকে এসব ক্ষেত্রে বানর গোষ্ঠীকে মানুষের কাছাকাছি ভেবে থাকলেও প্রকৃতভাবে মৃত্যুকে সবচেয়ে কাছ থেকে অনুভব করে হাতি। হাতির পালের একটি সদস্যের মৃত্যু পুরো দলকে কি ভীষণভাবে নাড়া দেয়, তা প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ লক্ষ্য করে আসছে। এক্ষেত্রে ২০০৩ সালে কেনিয়ার ন্যাশনাল পার্কে এলিনর নামে এক হাতির মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখ করা যায়।

এলিনর তার পালের নেতা ছিল। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার মাত্র ছয় মাস পর অসুস্থতার কারণে সে মারা যায়। তার দলের একটি-দু’টি হাতি প্রথম দিন মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে নানাভাবে তাকে জাগানোর চেষ্টা করে, চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। এভাবে পুরো সপ্তাহজুড়ে এলিনরের বাচ্চাসহ পালের অন্যান্য হাতি তার মৃতদেহ দেখতে আসে। এমনকি কাক-শকুন এলিনরের মৃতদেহ খাওয়া শুরু করার পরও তারা থামেনি। বিশেষ করে বাচ্চাটি প্রতিদিনই এসে বিভিন্নভাবে তার মাকে জাগানোর চেষ্টা করতো, শুঁড় দিয়ে মাকে সুরসুরি দিতো। কিন্তু তার মা আর আর কখনও জাগেনি এবং বাচ্চাটিও এর কিছুদিন পরই মারা যায়।

animals-01নৃতত্ত্ববিদ বারবারা কিংয়ের এ ঘটনার ব্যাপারে বলেন, “এলিনরের মৃত্যুতে আমি এখানে গভীর শোকের ছায়া দেখেছি। ”

বানর গোষ্ঠীর প্রাণীগুলো তাদের এই শোককে কাজে লাগাতে পারে তাদের উন্নত শারীরিক গঠনের কারণে। শত্রুর মৃত্যুতে তাদের উল্লাস করতে দেখা যায়, সঙ্গীর মৃত্যুতে শোকসন্তপ্ত হতে দেখা যায়। যেমন, শিম্পাঞ্জির দলকে অনেক সময় দেখা যায় সাপ মেরে সেটির মরদেহ নিয়ে আনন্দ করতে, খেলতে। অর্থাৎ মুহূর্ত আগে যে প্রাণীটি মৃত্যুভয়ের কারণ ছিল, তাকে মেরে ফেলতে পেরে ততটাই খুশি হয়, যতটা আমরা হই সাপ মেরে। বিজ্ঞানীদের মতে, তারা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে যে সাপটির আর ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।

নেদারল্যান্ডসের আর্নহ্যামের একটি চিড়িয়াখানায় একই প্রজাতির এক শিম্পাঞ্জি হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো। তার সঙ্গী এসে অসুস্থ শিম্পাঞ্জির চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, তারপর চিৎকার করে নিজের বুক চাপড়ানো শুরু করলো। ডাক্তাররা ছুটে এসে মৃত্যুপথযাত্রী শিম্পাঞ্জিকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। শিম্পাঞ্জিটি ঢলে পড়ে যাওয়ার পর তার সঙ্গীরা জোরে চিৎকার করে উঠলো। কিন্তু এরপর হঠাৎ পিনপতন নিস্তব্ধতা। বিরাট ওই চিড়িয়াখানার ওই এলাকার কয়েকশ’ প্রাণী কিছু সময়ের জন্য একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলো। যেন আকস্মিক মৃত্যুতে সবাই স্তম্ভিত।

এর সঙ্গে একজন মানুষের মৃত্যুতে পারিপার্শ্বিকের অবস্থার খুবই মিল রয়েছে, বলা বাহুল্য। শুধু তাই নয়, মৃত শিম্পাঞ্জিটির সঙ্গী যে মৃত্যুর আগে দীর্ঘ সময় ধরে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো, সেটিও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, মৃত্যুর আগমুহূর্তে মানুষ যেমন প্রিয়জনের চোখে মৃত্যুর ছায়া দেখতে পারে, শিম্পাঞ্জির ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।

প্রাইমেট গোত্রের প্রাণী বিশেষজ্ঞ ফ্রান্স ডে ওয়াল এ ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “চিড়িয়াখানার ওই শিম্পাঞ্জির মৃত্যুতে অন্যদের শোক ও সাপের মৃত্যুতে শিম্পাঞ্জির উল্লাস থেকে বোঝা যায়, মৃত্যু তাদের গভীরভাবে আলোড়িত করে। তারা বুঝতে পারে যে মৃতরা আর কখনও ফিরে আসে না। ”

অর্থাৎ, পশুপাখি মৃত্যুর ব্যাপারে সচেতন, ঠিক মানুষের মতোই। নিছক বিষণ্ণতা বা কৌতূহল বলে একে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বেবুন, বিড়াল, খরগোশ, ,কুকুর, হাঁস, শূকরসহ আরও অনেক প্রাণীর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আচরণ তেমনটাই ইঙ্গিত দেয়।

এখানেই শেষ নয়। আধুনিক বিজ্ঞান বলে, মৃত্যু নিয়ে মানুষের আরও একটি জটিল মনস্তত্ত্ব পশুপাখির মধ্যেও রয়েছে- মৃত্যুকে মানতে না পারার প্রবণতা, আরও কিছুদিন মৃতকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা। পরবর্তী পর্বে এ ব্যাপারে আলোচনা করা হবে।

টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত নিবন্ধ অবলম্বনে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৮ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

ফিচার এর সর্বশেষ