ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

২০১১ সালের আদমশুমারি ও আদিবাসী জনতাত্ত্বিক বিভ্রান্তি

ড. মো: আজিজুল হক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১০ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১১
২০১১ সালের আদমশুমারি ও আদিবাসী জনতাত্ত্বিক বিভ্রান্তি

আধুনিক যুগে বিভিন্ন দেশে সামাজিক অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করতে নানাবিধ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্ব, বিশেষ করে বাংলাদেশেও উন্নয়ন পরিকল্পনার আলোকে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।

তবে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের অপরিহার্য পূর্বশর্ত হচ্ছে সে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী সম্পর্কে স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা থাকা।

একটি দেশের সমগ্রক উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণা পেতে সাধারণত প্রতি দশ বছর  অন্তর অন্তর আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশে সম্প্রতি আদমশুমারি শেষ হয়েছে। সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তকে বিশ্লেষণ ও যাচাই করা হচ্ছে। আদমশুমারি রিপোর্ট প্রকাশিত হলে তা রাষ্ট্রীয় দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পাবে এবং সামাজিক গবেষণা ও পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য-উপাত্তের ক্ষেত্রে মূলসূত্র হিসেবে বিবেচিত হবে।

প্রায় চল্লিশটি উপজাতিসহ দেশজ বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী নিয়ে তৈরি হয়েছে আমাদের সমগ্র জনসংখ্যা। আমাদের জনসংখ্যার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করলে সুস্পষ্টরূপে অনুধাবন করা যায় যে, তা অনেকখানি বৈচিত্র্যময়। কিন্তু আমাদের দেশে উপজাতীয় জনগোষ্ঠী নিয়ে অদ্যাবধি যথেষ্ট নৃতাত্ত্বিক গবেষণা হয়নি। এ কারণে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠী সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য এবং স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। একটি উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী হিসেবে উপজাতি সম্প্রদায়গুলো দেশের সুখ-দুঃখ, উন্নয়ন বা অবনতির সমান অংশীদার ও ভোক্তা সহযাত্রী। ফলে দেশের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশীয় সমগ্র জনসংখ্যা বা সমগ্রকের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরি। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারেও উপজাতীয়রা আমাদের মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলেও এদের প্রকৃত সংখ্যা ও জাতিগত বিভাজন আমাদের অজানা।

বর্তমানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা নিজ ইচ্ছা অথবা বিশেষ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন জাতি-বর্ণ বা সম্প্রদায়ের মানুষকে আদিবাসি বা উপজাতি বলছেন। দেশ ও জাতির বৃহত্তম স্বার্থে এবং বিতর্ক নিরসনে এ বিষয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। দেশের স্বীকৃত সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীরা এ বিতর্ক নিরসনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন।  

আধুনিক বিশ্বে এমন কোনো রাষ্ট্র নেই, যেখানে শুধু একটি সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীই বসবাস করে। সে অর্থে বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক, বহুমাত্রিক, বহুভাষিক জনগোষ্ঠীর বাসস্থল; বৈচিত্র্যময় সভ্যতা, সং¯কৃতি ও ঐতিহ্যের অধিকারী একটি দেশ। কিন্তু সব তথ্যসূত্র প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে বসবাসরত উপজাতিদের সম্পর্কে সরকারি রিপোর্ট, খ্রিস্টান মিশনারি, বেসরকারি সংস্থা ও স্বতন্ত্র গবেষকের আহরিত তথ্যের মধ্যে ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। রিপোর্টগুলো অসম্পূর্ণ এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ১৯৩১ সালের ভারতীয় সেন্সাস রিপোর্ট থেকে অদ্যাবধি স্বাধীন বাংলাদেশের আদমশুমারি রিপোর্ট সে সাক্ষ্য বহন করছে। এ দেশে এদের প্রকৃত সংখ্যা কত এবং মোট কতটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতি বা আদিবাসী আছে, তা অস্পষ্ট ও অজানা।   প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন কর্ম ও রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের  উপজাতি সম্পর্কে এখন পর্যন্ত সমন্বিত তথ্যসূত্রের অভাব রয়েছে। সদ্য সমাপ্ত আদমশুমারি রিপোর্টে বিদ্যমান বিভ্রান্তি নিরসনে কর্তৃপক্ষীয় সতর্ক দৃষ্টি ও পদক্ষেপ আশা করছি।

নীতিনির্ধারক মহল হয়তো একমত হবেন যে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্পর্কে অজ্ঞতা নিয়ে জাতীয় উন্নয়ন এবং তাদের মেধা ও বিপুল শ্রমশক্তির পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ ব্যবহার সম্ভব নয়। বাংলাদেশে একটি কাঙ্ক্ষিত মানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হলে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। কেননা উপজাতীয় সমাজের নিজস্ব গড়ন এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী সমাজের ক্ষমতা ও নেতৃত্ব কাঠামো রয়েছে।

এছাড়া তাদের নিজস্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা ঐ সমাজের কোন শ্রেণীর কতটা কাজে লাগছে অথবা সাধারণ উপজাতীয়রা ঐ উন্নয়ন কর্মসূচিকে তাদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধ দিয়ে কীভাবে এবং কতটা গ্রহণ করছে তা তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। বস্তুনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য রিপোর্টের অভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজেদের ইচ্ছামত বক্তব্য উপস্থাপন করছেন। এ ধরনের অশুভ চেষ্টা রোধ করার জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।


বাংলাদেশের প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। কিন্তু ওই আদমশুমারিতে বিভিন্ন উপজাতিকে স্বতন্ত্রভাবে গণনা করা হয়নি। বিবিএস ১৯৮৪ সালের রিপোর্টে ২৪টি উপজাতি এবং মোট জনসংখ্যা ৮,৯৭,৮২৮ জন বলা হয়েছে। উপজাতিগুলো হলো সাঁওতাল, ওঁরাও, পাহাড়িয়া, মুন্ডা, রাজবংশী, কোঁচ, খাসিয়া, মনিপুরী, টিপরা, প্যাংখো, গারো, হাজং, মার্মা, চাকমা, তংচঙ্গা, চাক, সেন্দুজ, ম্রো, খিয়াং, বোম (বনজোগী), খামি, লুসাই (খুমি)।

পক্ষান্তরে ১৯৯১ সালের রিপোর্টে ২৯টি উপজাতির মোট ১২,০৫,৯৭৮ জন মানুষের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। উপজাতিগুলো হলো বংশী, বোম, বুনা, চাক, চাকমা, কোঁচ, গারো, হাজং, হরিজন, খাসিয়া, খিয়াং, খুমি, লুসাই, মাহাতো, মারমা, মণিপুরি, মুন্ডা, মুরুং, ম্রো, পাহাড়ি, প্যাংখো, রাজবংশী, রাখাইন, সাঁওতাল, তংচঙ্গা, টিপরা, ত্রিপুরা, ওঁরাও, উরুয়া।

লক্ষণীয় বিষয়, এতে প্রচুর তথ্যবিভ্রাট রয়েছে। যেমন টিপরা ও ত্রিপুরা, ম্রো ও মুরুং, ওঁরাও ও উরুয়া একটি উপজাতির নাম হলেও রিপোর্টে এদের আলাদা উপজাতি বলা হয়েছে। বিভিন্ন রিপোর্টে প্রচলিত ইংরেজি বানানে ভিন্ন রীতির কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে হয়। বুনা, হরিজন নামে আলাদা কোনো উপজাতি নেই। কোঁচ জনগোষ্ঠীর বসবাসের মূল এলাকা উত্তরবঙ্গ হলেও এ বিভাগে কোঁচদের কথা উল্লেখ করা হয়নি।

এছাড়া অনেকের মতে, উত্তরাঞ্চলের ‘মালো বা মালপাহাড়ী’ এবং পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা বা তংচঙ্গা, ম্রো বা মারুসা বা মুরুং, মারমা বা মগ বা রাখাইন, গারো বা মান্দি, সাঁওতাল বা খেরওয়ার ও কুর্মি আলাদা উপজাতি হলেও স্বীকৃত নৃবিজ্ঞানীরা তা স্বীকার করেন না। অস্পষ্ট জ্ঞানের কারণে এমন হচ্ছে। যেমন মারমাদের একসময় মগ নামে ডাকা হতো, এরা পটুয়াখালী অঞ্চলে রাখাইন এবং বৃহৎ চট্টগ্রাম অঞ্চলে মারমা নামে পরিচিতি পেয়েছে। গারোরা নিজস্ব ভাষায় নিজেদের মান্দি বলে পরিচয় দিলেও অনেকে দুটি সম্বোধনকে আলাদা উপজাতি ভেবেছেন। সাঁওতালদের মধ্যে যারা হিন্দু ধর্মমত গ্রহণ করেছেন তারাই নিজেদের কুর্মি বলেন এবং সাঁওতালি ভাষায় খেরওয়ার বলে পরিচয় দেন। হাজংদেরও কেউ কেউ বৃহৎ কাছাড়ি অথবা গারোদের একটি শাখা বলে উল্লেখ করেছেন। হাজংদের ভাষা বাংলা। পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্টেও পরিচিতিমূলক এমন ভুল হয়েছে।

বিভিন্ন গবেষক বাংলাদেশে উপজাতি হিসেবে গাঞ্জু, কুলকামার, কোল, ভীল, হো, মালো, মাহাতো, মাহালি, মালপাহাড়ি, মগ, কুকি, সেন্দুজ, বীরহোড়, খ্যাং, উসাই, মারমা (মগ), ম্রো বা মুরুংয়ের নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের কোথাও গাঞ্জু, কুলকামার, হো, বীরহোড়, কোল, ভীল ইত্যাদি উপজাতি বসবাস করে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না।

ভৌগোলিকভাবে বিভাজিত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চার শতাধিক উপজাতি বসবাস করে এবং বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। সমগ্র ভারতে গন্দ এবং ভীলের পর সাঁওতালরা তৃতীয় প্রধান উপজাতি হলেও বাংলাদেশে দ্বিতীয় প্রধান উপজাতি, যারা প্রধানত বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বসবাস করে। বাংলাদেশে মোট কতগুলো উপজাতি বসবাস করে এ সম্পর্কে কিছু মত তুলে ধরছি।

গারেল্লোর (১৯৯৪) মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট চল্লিশটিরও বেশি উপজাতি সম্প্রদায় বসবাস করে। কোরেশীর (১৯৮৪) মতে, বর্তমানে ৩১টি বসবাস করে এবং ইউরোপীয় জাতিতত্ত্ববিদ ম্যালোনির মতে এ দেশে ৩৬টি উপজাতি রয়েছে। উপজাতীয় লেখক রামাকান্ত সিংহর মতে, বাংলাদেশে ৩৫টি উপজাতি এবং ২২টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে। তাঁর মতে, বাঙালি ব্যতীত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা ৫৭। এই মতটিই সর্বোচ্চ। তাঁর বর্ণিত উপজাতি ও আদিবাসীর মধ্যে যে নামগুলো অপরিচিত বা যারা বাংলাদেশে বসবাস করে না তারা হলেন হোদি, পালেয়া, ডালুই, পাঙন, খরিয়া, কোটস, তোড়ি, খারওয়ার, বর্মন, খোড়া, কাছাড়ি, হো, গন্ডা, মাচ, বনই, শিং, হাজাজা, পানগয়ান, টেপি, চঙ্ক, মিথেরি, খোসাই, কোলেন, পাত্র, গুর্খা, কর্মকার, লাউয়া, মিকির, রাজুয়ার, রাই, গ্যাংঘু, রাই, মুসহর, সুরিয়া, বাºি, মুরিয়ার ও বেদে। এখানে আন্দাজে ঢিল ছোড়া হয়েছে। হিন্দু ধর্মীয় বিধানে স্বীকৃত জাতি-বর্ণ প্রথায় বিভিন্ন জাতকে (কাস্ট) তিনি উপজাতি বলেছেন, যা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি জাত বা পেশার মানুষেরা কর্মকার, শিং, তেলি বলে পরিচিত। কোঁচ আদিবাসির একটি পদবি বর্মন। কিন্তু তিনি কোঁচ, কোটস, বর্মনকে তিনটি উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সাঁওতালরা ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের পর নিজেদের কখনো কখনো খেরওয়ার বা খেরওয়ারি বলে পরিচয় দিলেও তিনি দুটি নামকে দুটি উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বেদে সম্প্রদায়ের মানুষকেও তিনি উপজাতি বলেছেন অথচ বেদেরা বাঙালি এবং মুসলিম। তাঁর বর্ণিত উপজাতিদের দু-একটি স্বল্প পরিচিতি হলেও অন্যগুলোর কোনো অস্তিত্ব এ দেশে নেই। খৈাড়া, মাচ (মেচ), হাজাজা, পানগয়ান, টেপি, চঙ্ক, মিথেরি, খোসাই, কোলেন, সুরিয়া ইত্যাদি উপজাতির কথা অদ্যাবধি অন্য কোনো গবেষক উল্লেখ করেননি। উপজাতিবিষয়ক অনেক অখ্যাত লেখক বলা যায় কাটিং অ্যান্ড পেস্টিং বিশেষজ্ঞ কিছু লেখকও হিন্দুদের অনেক জাত বা বর্ণের মানুষের পদবিকে উপজাতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন ‘উপজাতিদের ইতিহাস ও জীবনধারা’ গ্রন্থের লেখক সিং, রায়, তুরি, বৈরাগী, বেদি, মাল্লা, জালিয়া, কৈবর্ত, রবিদাস, ভুইয়া, বসাক, ঋষি, তুরি, শীল, সূত্রধর, ভৌমিক ইত্যাদিকেও উপজাতি বলে উল্লেখ করেছেন ।

বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠী বাঙালির পাশাপাশি অন্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর পরিচয় উদঘাটন করতে গিয়ে গবেষক ও লেখকরা নতুন নতুন নৃ-গোষ্ঠী আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিতে যারপরনাই তৎপর ছিলেন। তারা বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও উপাত্ত দিচ্ছেন নাকি জাতিকে বিভ্রান্ত করছেন, সে বিষয়ে ছিলেন দায়িত্বহীন ও উদাসীন। আমার মনে হয়, একজন লেখক কোনো এলাকায় কাজ করতে গিয়ে কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসে নামের পদবি আলাদা দেখেই তাদের উপজাতি বা আলাদা নৃ-গোষ্ঠী ভেবেছেন। অর্থাৎ কোনো বিশেষ অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর নামের শেষের পদবিকেই উপজাতি মনে করা হয়েছে। আমরা কে না জানি যে, বর্তমানে অনেক হিন্দু পরিবারই নামের শেষে ভুঁইয়া, বসাক, রায়, সিং, বৈরাগী ইত্যাদি ব্যবহার করেন। এ ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা পেতে আমরা ভারতে প্রথম আদমশুমারি রিপোর্টের দিকে তাকাতে পারি।

১৯৩১ সালে সম্পাদিত সেন্সাস রিপোর্টে যেসব উপজাতির নাম পাওয়া যায় তারা হলো যথাক্রমে বেদিয়া, বাহেলিয়া, ভুঁইহা (ভুঁইহার?), ঝিমিয়া, পান, পাশি, দোসাদ, রাঙ্গা, নাট, খাসি, কাছাড়ি, নাগেসিয়া, ভূমিজ, কোরা, থারু, মালপাহাড়িয়া, গারো, হাজং, খন্দ, হো, লুসাই, মাহালী, তুরী।   পক্ষান্তরে উপজাতীয় বিভিন্ন ভাষা অনুসারে ১৯৪১ সালের সেন্সাস রিপোর্টে তৎকালীন বাংলাদেশের অধিবাসী যে ২০টি সমাজের নাম উল্লিখিত হয়েছে তারা হলো যথাক্রমে ভোটিয়া, চাকমা, দামাই, গুরুং, হদি, কুমি, খাসি, কুকি, লেপচা, লিমবু, মংগর, মেচ, ম্রো, মুন্ডা, নেওয়ার, ওঁরাও, সাঁওতাল, সারকি, সুনুওয়ার, টিপরা।

আমরা উপরিল্লিখিত দুটো সেন্সাস রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে  দেখতে পাই যে, এর মধ্যে যথেষ্ট তারতম্য রয়েছে। যেমন ১৯৩১ সালের সেন্সাস রিপোর্টে চাকমা, সাঁওতাল, ওঁরাও, ম্রো, মুন্ডার নাম না থাকলেও ১৯৪১ সালের সেন্সাস রিপোর্টে তা উল্লে¬খ করা হয়েছে। এছাড়া ১৯৩১ এবং ১৯৪১ সালের দুটো রিপোর্টেই উপজাতিদের মধ্যে ভূঁইয়া, মারমা, কুর্মি, লোধা, টোডা, শবর, কোঁচ, পালিয়া, কোল, ভীল, পাহাড়ী, কোঁচ, রাজবংশী, মাহালি, মালো, রাখাইন, খাসিয়া ইত্যাদি অনেক উপজাতির নাম উল্লেখ নেই। এ থেকে সহজেই অনুমিত হয় যে, ভারত ভূখ-ের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব উপজাতি বসবাস করে তারা দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ জনপদে তাদের স্থায়ী আবাসভূমি গড়ে তুলেছে। তারা কেউই এখানকার আদি বা স্থায়ী বাসিন্দা বা ভূমিজ সন্তান নয়। এ কারণে উপজাতিরা বাংলাদেশের আদিবাসী নয়। তাদের এ দাবির কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। বাঙালিরাই এ দেশের মূল বাসিন্দা বা আদিবাসী।
 
আমরা মনে করি, একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বিরাজমান বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বিভিন্ন জাতির জাতিগত বিকাশের মধ্য দিয়েই একটি সম্মিলিত এবং উন্নত মানবসমাজ বা মানববিশ্ব গড়া সম্ভব। অধিকাংশ সমাজবিজ্ঞানী তাই মনে করেন। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন নরগোষ্ঠী এবং ভৌগোলিক এলাকাভিত্তিক বসবাসরত সকল জাতিকে বৃহত্তর একক মানবজাতিতে নিয়ে আসার অপরিহার্য পূর্বশর্তই হচ্ছে সকল জাতির পার¯পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, সমঝোতা, পরিষ্কার জাতিগত পরিচয় ও জাতি হিসেবে পূর্ণ বিকাশ অথবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বিকাশে তুলনামূলকভাবে অগ্রসর জনগোষ্ঠীর সাহায্য করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশে এ প্রক্রিয়া অনুপস্থিত। জাতিগত বিকাশ তো দূরের কথা, বরং তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাং¯কৃতিক অবস্থার যথার্থ মূল্যায়ন আজ পর্যন্ত করা হয়নি। ফলে অন্ধকারের তিমিরে থেকে কোনো জাতির উন্নয়ন কখনই সম্ভব নয়। এতোকাল ধরে এই সমস্যাগুলো আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের এই দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার।   উপজাতি বলে পরিচিতি জনগোষ্ঠীকে সম্প্রতি সংবিধান সংশোধনে গঠিত সংসদীয় কমিটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও তারা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি চাচ্ছে। কিন্তু যে কোনো বিবেচনায় তারা এ দেশের আদি বাসিন্দা নয়, বরং প্রাচীন বাংলার অনার্য জনগোষ্ঠীর বর্তমান প্রজন্ম বাঙালি জাতিই এ দেশের আদি বাসিন্দা বা আদিবাসী। তাই অহেতুক ও অনাবশ্যক বিতর্ক জিইয়ে না রেখে সমস্যা নিরসনে এবং দেশ গড়ার মানসে এদের ক্ষুদ্র জাতি বলে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করছি। তবে এ দেশে কতটি ক্ষুদ্র জাতি বসবাস করছে, তা নিরসন হওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে সরকার ও নীতিনির্ধারক মহলের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

(লেখক আঞ্চলিক পরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক পরিচালক, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী, রাজশাহী। ই-মেইল : [email protected])

বাংলাদেশ সময় ১৯২৫ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বাংলানিউজ স্পেশাল এর সর্বশেষ