ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

বাংলানিউজের অনুসন্ধান

তিন স্ত্রীর চাপে দেউলিয়াত্বের পথে সাইফুর

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৬
তিন স্ত্রীর চাপে দেউলিয়াত্বের পথে সাইফুর সাইফুর রহমান ও তার তৃতীয় স্ত্রী শামসা আরা খান ডলি ওরফে সিলভার ডলি

ঢাকা: পরনে যতোটা বৈচিত্র্যময় পোশাক, ভেতরের রূপ ততোটাই কদর্য। আর সেই বেশভূষা নিয়েই যতো বিভ্রান্তি।

সন্দেহজনক এ মানুষটির নাম সাইফুর রহমান খান  নিপু।

হ্যাকিং করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লোপাটের ডামাডোলের মাঝেই দক্ষ ‘হ্যাকার তৈরির বিজ্ঞাপন’ দেওয়া বিতর্কিত সাইফুর’স কোচিং সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তিনি।

বাংলানিউজের গভীর অনুসন্ধানে তার এ বিচিত্র লেবাস থেকেই এখন বের হয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য, অনৈতিক কোচিং ব্যবসার আদ্যোপান্ত।

একটি-দু’টি নয়, নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ খাতাপত্রে তিনটি বিয়ে করেছেন শিক্ষামন্ত্রীর ভাষায় ‘চোর বানানোর বিজ্ঞাপন’ দেওয়া প্রতিষ্ঠানটির এমডি সাইফুর রহমান খান নিপু।

সাইফুরের বাবা সাভারের শিমুলিয়া গ্রামের মৃত খলিলুর রহমান খান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র চেয়ারম্যান। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় সাইফুর রহমান খান নিপু। ছোট ভাই তানভীর রহমান খান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।

বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে জাপান থেকে মনোবসু স্কলারশিপ নিয়ে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন সাইফুর। খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (আইবিএ)। কথিত রয়েছে, আইবিএতে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে বাবার রেখে আসা সুনাম বিসর্জন দিয়েই সরে আসতে হয় তাকে।

মাত্র দু’বছরের খণ্ডকালীন শিক্ষকতার ইতি টেনে ২০০২ সালে খোলেন কোচিং সেন্টার। ‘রক্তচোষা’ এ কোচিং বাণিজ্য করে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। তারপর নিজেই নিজের নামের শেষে ‘স্যার’ তকমা লাগিয়ে পরিচিত হন ‘সাইফুর স্যার’ হিসেবে।

এদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেই ১৯৯২ সালে পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে করেন নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া এলাকার আব্দুস সিদ্দিক মিয়ার মেয়ে মোর্শেদা রহমান খানকে। এ পক্ষে তার রয়েছে দুই মেয়ে, এক ছেলে। তাদের মধ্যে সুমাইয়া বিবিএ, সাকিব এ লেভেল ও সাঈদা স্কুলের শিক্ষার্থী।

তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ভালোই চলছিলো সাইফুর রহমান খান নিপুর সংসার।

২০০৩ সালে বিনা মেঘে বজ্রপাতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন মোর্শেদা। সাইফুর রহমান খান নিপুর কুদৃষ্টি পড়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী নেলীর দিকে।
প্রেমের জোয়ারে ভেসে যান দু’জনে। যে কারণে আগের ঘর ভাঙে নেলীর। প্রবাসী স্বামীকে ‘তালাক’ না দিয়েই বিয়ে করেন সাইফুর রহমান খান নিপুকে।

তবে এ বিয়েও বেশিদিন টেকেনি। পারিবারিক অশান্তি আর মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে সন্মান রক্ষার্থে পিছু হটতে হয় সাইফুরকে। আপোস-মীমাংসা করেই দ্বিতীয় স্ত্রীর অভিযোগ থেকে দায়মুক্ত হন তিনি। তবে প্রবাসে থেকেও নানাভাবে এখনো কলকাঠি নাড়ছেন নেলী।

সর্বশেষ ‘সিলভার ডলি’ নামের সুনামিতে আবারো বিপর্যয়ের মুখে পড়েন রাজধানীর পরিবাগের বাসিন্দা প্রথম স্ত্রী মোর্শেদা রহমান খান।

মোর্শেদারা ৫ বোন, এক ভাই। তার দুই বোন ও নিকট আত্নীয়রা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, ‘সাইফুর রহমান খান নিপু একজন লম্পট, চরিত্রহীন, নারীলোভী। শিক্ষার্থী থেকে উচ্চাভিলাসী নারী, এমনকি বাল্যকালের বান্ধবীসহ অনেকের সঙ্গেই অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন তিনি। তবে বাধ্য হয়ে বিয়ে করার ঘটনা দু’টি’।

‘প্রতিবাদ করলেই তিনি আমাদের বোন মোর্শেদার ওপর চড়াও হয়েছেন, মারধর করেছেন। কিন্তু সামাজিক সন্মানের কথা ভেবে কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি। আর সেই নীরবতাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে’।

২০১১ সালের ১৩ মার্চ সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার শমশের আলী শিকদারের মেয়ে শামসা আরা খান ডলি ওরফে সিলভার ডলিকে গোপনে বিয়ে করেন সাইফুর রহমান খান নিপু।

গোপনে বাসর শয্যা হয় রাজধানীর কাকলী এলাকায় হোটেল ঈশা খাঁ’য়। এর বেশ কিছুদিন পর নিজের অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খোরমা-খেঁজুর খাইয়ে তৃতীয় বিয়ের বার্তা দেন সাইফুর রহমান খান নিপু।

বিয়ের পর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে রাজধানীর অভিজাত এলাকা ধানমণ্ডিতে দুই কোটি টাকা ব্যয়ে তৃতীয় স্ত্রী ডলির জন্যে কেনা হয় ফ্ল্যাট।

ডলির ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বাংলানিউজকে জানান, ডলি বরাবরই লোভী ও উচ্চাভিলাসী। এটি ডলিরও তৃতীয় বিয়ে।

সাইফুর’স এর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানান, ডলি ওরফে সিলভার ডলি ছিলেন আদম ব্যবসায়ী রাজধানীর গুলশানের একটি বহুতল ভবনের (টাওয়ার) মালিক ও বাগেরহাট-২ আসনের বিএনপির এক সাবেক এমপির চতুর্থ স্ত্রী। সে কারণে ওই টাওয়ারের নামে অনেকেই তাকে চেনেন  ‘সিলভার ডলি’ হিসেবেই।

সমাজের উচ্চমহলে নির্বিঘ্ন যাতায়াতের প্রয়োজনে সাইফুর’স কোচিং সেন্টারে ইংরেজি শিখতে এসেছিলেন তিনি।

সেখানকার তৎকালীন হেড অব অপারেশন ও বর্তমান চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) মাহমুদুল আলমের সঙ্গে ‘বাড়তি সম্পর্কে’ জড়িয়ে পড়েন সিলভার ডলি।

বিষয়টি মাহমুদুল আলমের স্ত্রী আসমা টের পেলে সম্পর্কটি আর বেশিদূর গড়ায়নি।

সাইফুর রহমান খান নিপুর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর স্বজনদের অভিযোগ, যতো নাটের গুরু ওই মাহমুদুল আলম। বেকায়দায় পড়ে তিনিই ডলিকে ঠেলে দেন সাইফুর রহমান নিপুর দিকে।

তাদের বক্তব্য, এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারার ফন্দি ছিলো মাহমুদুল আলমের। সাইফুর রহমান খান নিপুকে নতুন সম্পর্কের বেড়াজালে বন্দি করতে পারলে তিনি নতুন করে ঝামেলায় থাকবেন। আর এ সুযোগে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার ফন্দি ছিলো মাহমুদুল আলমের। আর হয়েছেও তাই।

হেড অব অপারেশন থেকে চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) বনে যাওয়াকে উদাহরণ টেনে তাদের ভাষ্য, ডলির প্রভাবেই কোম্পানিতে পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছেন মাহমুদুল আলম।

আর প্রথম স্ত্রী মোর্শদা রহমান খানের এক সময় অংশীদারিত্ব ছিলো ৯০ শতাংশ। পদবি ছিলো ভাইস চেয়ারম্যান। তাকে হটিয়ে দিয়ে অবৈধভাবে সাইফুর’স প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারপার্সন বনে যান শামসা আর খান ডলি।

‘আজ ডলির কারণেই এতো বিপর্যয়, এতো সর্বনাশ। আমার বোন কদর্য মানুষটির নোংরামি নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে চাননি। আমরা এটাও নিশ্চিত, সাইফুর’স এর মালিকানা নিয়ে আদালতে গেলে ডলি টিকতে পারবেন না। তবে আল্লাহরও তো বিচার ‍আছে। আমরা অপেক্ষায় আছি সেটি দেখার’- যোগ করেন প্রথম স্ত্রী মোর্শেদার একজন ঘনিষ্ঠ স্বজন।

তবে চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) মাহমুদুল আলম নিজের সম্পর্কে আনা অভিযোগের জবাবে বাংলানিউজকে বলেন, ‘তারা তো কতো কথাই বলেন! এসব কথা বললে কি আর করার!’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাইফুর’স এর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাবা হিসেবে খ্যাতনামা অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান খান নিজের ছেলের কর্মকাণ্ডে ছিলেন মর্মাহত। বৈচিত্র্যময় লেবাসে থাকা ছেলের স্বভাব-চরিত্রের কারণেও ছিলেন ক্ষুব্ধ আর অসন্তুষ্ট। যে কারণে নিজের সহায় সম্পত্তি সন্তানকে না দিয়ে হস্তান্তর করেছেন আদরের নাতি সাকিবের নামে। ছেলের কর্মে বাবা হিসেবে অতৃপ্তি আর অসন্তুষ্টি নিয়েই পৃথিবী ছেড়েছেন তিনি’।

‘সেই অভিশাপের ফলই কি আজকের এই পরিণতি? প্রতিষ্ঠানটিকে ‘চোর বানানোর’ বিজ্ঞাপন দিতে হয়! এভাবে দেউলিয়াত্বের পথে পা বাড়াতে হয়!’- এমনই আক্ষেপ সাইফুর’স কোচিং সেন্টারের জ্যেষ্ঠ এই কর্মকর্তার।
 
সোমবার পড়ুন: শিক্ষার্থী থেকে প্রথমে প্রেয়সী, অত:পর কোম্পানির চেয়ারপার্সন বনে যাওয়া এক নারীর অজানা কাহিনী

বাংলাদেশ সময়: ১২০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৬
জেডআর/এএসআর

** মালিকানার প্রলোভনে কর্মীদের দেড় কোটি টাকা হাতিয়েছে সাইফুর’স
** এবার শিক্ষকদের ঘুষ দেওয়ার মিশনে সাইফুরস!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ