ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

বনভূমি, কী দোষ ছিল তোমার?

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, স্পেশালিস্ট এনভায়রনমেন্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৪
বনভূমি, কী দোষ ছিল তোমার? ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল: চোখ যখন সদ্যনগ্ন টিলার বুকে গিয়ে ঠেকলো, বিস্ময়ের রেখা তখন কপালজুড়ে! কিছুদিন আগেও এ টিলাকে দেখেছিলাম নবযৌবনা রূপে। কত পাখি, কত তৃণ, গাছগাছালি তার বুকেজুড়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিল।

আজ তার কিছুই অবশিষ্ট নেই! সমস্ত রূপ, যৌবন, সৌন্দর্য ফেলা হয়েছে উপড়ে। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শুকনো ডালপালা আর কিছু কিছু মাটির অংশ।

টিলার বুকজুড়ে থাকা নানা প্রজাতির ছোট-বড় গাছগুলোকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে হয়েছে। পুরো টিলাকে খনন করা হয়েছে আনারস রোপণের দোহাই দিয়ে। বৃষ্টি হলেই এ টিলাটিতে এখন ভূমিধস অনিবার্য। এ এক ভয়াবহ সহিংস হত্যাযজ্ঞ!

সম্প্রতি সরেজমিন ডলুছড়ায় গিয়ে দেখা যায়, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন একটি প্রাকৃতিক টিলা ধ্বংস করে এবং সেই টিলার সমস্ত ছোট-বড় গাছপালা কেটে চলছে আনারস বাগান তৈরির প্রক্রিয়া। শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়ন পরিষদের ডলুছড়া (ত্রিপুরাপল্লী) এলাকার একটি অংশে খাস জায়গার ওই টিলার গাছপালাগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে।

পুরো টিলার মাটিগুলো খনন করা হয়েছে। এখানের সব ছোট-বড় গাছপালা কেটে ফেলা হয় কিছুদিন পূর্বেই। দশ-বারোজন শ্রমিক এখন কাজ করছে। পাশের অংশটির মধ্যেও অনুরূপভাবে টিলা ধ্বংস করে আনারস বাগান তৈরির পরিকল্পনা করছে তারা। শ্রমিকদের একজনেরসঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই জায়গাটি রয়েছে ডলুছড়ার অশোক কুমার দেববর্মার দখলে।    

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার এক আনারস চাষি বলেন, পুরো টিলাজুড়ে এভাবে গভীর করে মাটি খুঁড়ে আনারস লাগানোর নিয়ম নেই। এখন বৃষ্টি হলেই টিলাটিতে ধস নামবে।

তিনি আরও জানান, এই জায়গাটি রয়েছে ডলুছড়ার মহিকুমার দেববর্মার ছেলে অশোক কুমার দেবরায়ের দখলে। ওই জায়গার মোট আয়তন প্রায় আট একর।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সুকল্প দাশ বলেন, পুরো পাহাড় খনন করে আনারস লাগানো বিজ্ঞানসম্মত নয়। এটা লাগাতে হবে আড়াআড়িভাবে একেকটি বেড করে করে। যাতে বৃষ্টি হলে পাহাড় না ধসে। টিলার পুরো গাছপালা কেটে ফেলা পরিবেশের জন্য কখনোই মঙ্গলজনক নয়।

পরিবেশবাদী সংগঠন পাহাড় রক্ষা ও উন্নয়ন সোসাইটির সভাপতি সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলুছড়া এলাকার অধিকাংশ জায়গা খাস ভূমি। কিছু অংশ পাট্টা (মালিকানাধীন) রয়েছে। প্রশাসনের নজরদারিতে না থাকার ফলে অনেকেই দীর্ঘদিন থেকে সরকারি খাস জায়গা ভোগদখল করে আছেন।

সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নুরুল হুদার সঙ্গে এ বিষয়ে প্রথমবার যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ওই জায়গাটি সম্ভবত খাস জায়গা। পরবর্তীতে ওই ডলুছড়ার বিষয়ে তার মন্তব্য জানতে গেলে তিনি বলেন, আমি কাগজপত্র না দেখে কোনো প্রকার মন্তব্যই করতে পারবো না।  

শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শহীদ মোহাম্মদ ছাইদুল হকের নির্দেশে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নুরুল হুদা ওই জায়গাটি সরেজমিন পরিদর্শন করে গেলেও অদ্যাবধি কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি।

শ্রীমঙ্গলের খাস জমিগুলো বছরের পর বছর ধরে বেদখল হয়ে রয়েছে প্রভাবশালীদের কাছে। সরকারের কোষাগারে একটি টাকাও জমা হচ্ছে না। অবাক করা বিষয় হচ্ছে-  এগুলো উদ্ধারের কোনো প্রকার ভূমিকা নেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের। স্থানীয় এসিল্যান্ড, ইউএনও অথবা বিট অফিসার কিংবা ডিএফও বিষয়টি জেনেও হয়তো থাকবেন ভাবলেশহীন! গণমাধ্যমের চাপে একসময় খাচাবন্দি ময়নার মুখস্ত বুলির মতো হয়তো বলবেন- ‘তদন্তক্রমে যথাযথ নেয়া হবে’, ‘তদন্ত চলমান’, ‘তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না’ ইত্যাদি।

বনভূমি, তোমার তো কোনো দোষ ছিল না! তবু, এভাবে মরে যেতে হলো! তোমার এই অনুপস্থিতি আমার হৃদয়ে আজ বাজছে!... জরুরি ভিত্তিতে এসব প্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধে প্রয়োজনীয় ভূমিকার সফল বাস্তবায়ন বা কারোর তাৎক্ষণিক কোনো উদ্যোগ নেওয়ার উদাহরণ এখনো শূন্যের কোঠায়।

টিলা, পাহাড়, বন এগুলো আমাদের বনপ্রকৃতির অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। এগুলোর ধ্বংস মানেই প্রকৃতির ধ্বংস। একখণ্ড সবুজ প্রকৃতির অনাঙ্ক্ষিত এ মৃত্যুবরণে কারোর কিছুই আসবে-যাবে না! সবুজপ্রকৃতির এসব হত্যাকারীদের আসলে কি কিছু হবে?

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।