শ্রীমঙ্গল : টিলার কাছে যেতেই চোখ পড়ল হাজার হাজার আনারস গাছের মৃত শরীর। বিবর্ণ হয়ে পড়ে রয়েছে! এগুলোর কোনো কোনোটাকে কেটে এবং কোনো কোনোটাকে গুড়ি থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে।
সম্প্রতি জুলেখানগর চা বাগান কর্তৃপক্ষ আদিবাসীসহ চা শ্রমিকদের সৃজন করা জমি দখল জোরপূর্বক করতেই আনাসর, লেবু, কাঠালসহ প্রায় ৭০ হাজার ফলদ গাছ কেটে নষ্ট করেছে। এর ফলে গভীর আতংক ও প্রচন্ড নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে খাসিয়া আদিবাসীসহ ওই এলাকার চা শ্রমিক জনগোষ্ঠী। ফসলহানির এ ঘটনাটি ঘটেছে শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৮নং কালিঘাট ও ৪নং সিন্দুরখান ইউনিয়নের লাংলিয়াছড়া ও জুলেখানগর পানপুঞ্জি সংলগ্ন এলাকায়।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এ ঘটনায় জুলেখানগর চা বাগানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দা গুলশান আরা বেগম উল্টো বাদী হয়ে বিশ লাখ টাকার ক্ষতিসাধনের কারণ দেখিয়ে রোববার ১৮ জনের বিরুদ্ধে শ্রীমঙ্গল থানায় হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করেছেন।
এদিকে, সোমবার লাখাই এলাকার আনারস-লেবু বাগানের মালিকবৃন্দ জুলেখানগর বাগান কর্তৃপক্ষের অবৈধ ভূমি দখল ও নির্যাতন বন্ধে সহায়তা চেয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে শ্রীমঙ্গল চৌমুহনাচত্ত্বরে মানববন্ধন করতে চাইলে পুলিশ সেই মানববন্ধন করতে দেয়নি। পরে ইউএনও কার্যালয়ে গিয়ে মানববন্ধন করে ইউএনও বরাবরে তারা একটি স্মরকলিপি প্রদান করেন।
মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিন ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী লাংলিয়াছড়া ও জুলেখানগর পানপুঞ্জি সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কয়েকটি টিলার সমস্ত লেবু ও আনারস তুলে ফেলা হয়েছে। টিলাগুলো বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়েছে। কিছু কিছু প্রাচীন কাঠাল গাছও কেটে ফেলা হয়। বাগান কর্তৃপক্ষের লোকজনদের সংঘবদ্ধভাবে ওই এলাকায় পাহারারত অবস্থায় দেখা গেছে। পুলিশ পাহারায় মঙ্গলবার ওই এলাকা পরিদর্শন করেন সৈয়দা গুলশান আরা বেগম।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, ১২ ডিসেম্বর, শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই চা বাগান কর্তৃপক্ষের প্রায় দেড় থেকে দু’শ ভাড়াকরা মানুষ হঠাৎ ধেয়ে এসে সৃজনকৃত আনারস, লেবু গাছগুলো কেটে ফেলতে থাকে। পরবর্তীতে খাসি জনগোষ্ঠীসহ চা শ্রমিক অধিবাসীরা সম্মিলিতভাবে এগিয়ে এসে প্রতিরোধের চেষ্টা করলে দুর্বৃত্তরা পিছু হটে। শনি এবং রোববার অনুরূপভাবে বিভিন্ন টিলার লেবু, আনারসগুলো কেটে ফলতে থাকে দুর্বৃত্তরা।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাদির মিয়ার ১২০ শতাংশ, বিক্রম তাতির ৪৪৩ শতাংশ, সৈদয় আশরাফের ১১৫ শতাংশ এবং হাসিম মিয়ার ১২০ শতাংশসহ মোট ২৮ কেয়ার পাট্টা (বন্দোবস্তকৃত) জমির ফসলাদি কেটে জমির দখল করা হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্থ আনারস-লেবু বাগানের মালিক কাদির মিয়ার ছেলে আহাদ বলেন, এটা আমাদের পাট্টা জমি। চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর যাবত আমরা এখানে আনারস-লেবু চাষ করে আসছি। যদি এটা বাগান কর্তৃপক্ষের বৈধ জায়গাই হয়ে থাকতো তাহলে এতো দিন পর কেন ভাড়া করা মানুষ এনে আমাদের জায়গা জোরপূর্বক দখল করতে যাবে?
ক্ষতিগ্রস্থ আনারস-লেবু বাগানের অপর দুই মালিক বিক্রম তাতি ও হাসিম মিয়া বলেন, ৫/৬ বছর পূর্বে এভাবে আরো দু’বার আমাদের পাট্টা জমি দখলের চেষ্টা করা হয়। এতে আমাদের এখন প্রায় দশ লাখ টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
জুলেখানগর পানপুঞ্জির পার্বন খংফান বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী টিলায় দুর্বৃত্তদের অতর্কিত আক্রমণে আমরা ৩২টি খাসি পরিবার চরম আতংকের মধ্যে রয়েছি। কখন না আবার আমাদের উপর আক্রমণ হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শহীদ মোহাম্মদ ছাইদুল হক বলেন, ক্ষতিগ্রস্থদের স্মরকলিপির মাধ্যমে আমি এই ঘটনাটি জেনেছি। বুধবার ঘটনাস্থলে যাবো। তিনি আরো বলেন, দুই পক্ষই কোনো কাগজপত্র আমাকে দেখায়নি। এ বিষয়ে ওসি ভালো বলতে পারবেন।
থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি ব্যস্ত, পরে ফোন দেন। পরবর্তীতে কয়েকবার তাঁর মোবাইলে ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি।
জুলেখানগর চা বাগানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দা গুলশান আরা বেগম বলেন, চা বাগান সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আমাদের জায়গাগুলোতেই আমরা চা আবাদ করার উদ্যোগ নিয়েছি।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা চেয়ারম্যান রনধীর কুমার দেব বলেন, জায়গার মালিকানা নির্ধারণ না করে ভাড়া করা লোকজন এনে এভাবে ফসলাদির ব্যাপক ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে জোরপূর্বক জমির দখলের চেষ্টা একটি সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি। গন্ডগোলের আশংকা দেখা দেয়ায় শ্রীমঙ্গল থানার ওসিকে ইতোপূর্বে বিষয়টি তিনি জানালেও ওসি এ ব্যাপারে যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ নেননি বলে রনধীর কুমার দেব অভিযোগ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৩২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৪