শেরপুর (বগুড়া): ডাহুকের ‘কোয়াক’ ‘কোয়াক’ ডাক বাংলা সাহিত্যে অতি পরিচিত একটা অনুসঙ্গ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথসহ দেশের নামকরা কবি সাহিত্যিকরা ডাহুক নিয়ে অসংখ্য গল্প ও কবিতা লিখেছেন।
ডাহুকের ডাকের মাধ্যমে কবি পাঠক সমাজের কাছে ছায়া সুনিবিড় সবুজ শ্যামল শান্তির নীড় আবহমান গ্রাম বাংলাকে তুলে ধরেছেন। আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছড়া কবিতায় ডাহুকের উচ্ছ্বল অবস্থান বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘ডাহুক-ডাহুকী টিয়া-টুয়া পাখি/ ঝংকারে উড়িয়া যায়..। ’
আজ কবির সেই ডাহুক কেবলই বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ। কেননা পাখিটি আর দেখা যায় না বললেই চলে। তাই বিলুপ্ত প্রায় প্রাণির তালিকায় ডাহুকের নাম থাকলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। কালের বিবর্তনে ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে পাখিটি। গ্রাম বাংলার খাল-বিলের জলাশয় গুলোতে ডাহুকের ডাক আর শোনা যায় না। আর যদি কোথাও ডাহুকের ডাক শোনা যায় তা হবে অনেকটা বিরল ঘটনারমত।
এদিকে বিলুপ্ত প্রায় সেই ডাহুকের দেখা মেলে বগুড়ার শেরপুর পৌরসভার রেজিস্ট্রি অফিস বাজার ও বারদুয়ারীহাটের রকমারি পোষা প্রাণি বিক্রিস্থল প্রাঙ্গণে। তবে মুক্ত অবস্থায় নয়, খাঁচায় বন্দি হিসেবে!
বৃহস্পতিবার (৭মে) পৌরশহরের রেজিস্ট্রি অফিস বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রকাশ্যে পৌরশহরের উত্তর সাহাপাড়ার আব্দুল জলিল ও হৃদয় নামে দু’জন পাখি শিকারি প্রায় ৩০-৩৫টি বিলুপ্ত প্রায় ডাহুক পাখি প্রতিজোড়া ২০০-২৫০টাকায় বিক্রি করছে।
এ দুই পাখি শিকারি বাংলানিউজকে জানায়, তারা গ্রামের পাখি শিকারিদের কাছে পাখিগুলো প্রতিজোড়া ১৮০টাকা দরে কিনেছেন।
তারা আরো জানান, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের অর্থলোভী কিছু পাখি শিকারি অবাধে পাখি শিকার করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে। এসব পাখি শিকারি বিভিন্ন রকমের ফাঁদ পেতে ও নানা কৌশল অবলম্বন করে পাখি শিকার করে থাকে।
তারা অবাধে পাখি শিকারের ফলে বিভিন্ন জলাশয়ের দেশীয় ও দূর-দূরান্ত থেকে আসা অতিথি ও স্থানীয় পাখির অস্তিত্ব আজ প্রায় বিপন্ন। কিন্তু প্রশাসনিক পার্যায়ে আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ায় এসব শিকারিদের অবাধে পাখি শিকার ও বিক্রি বেড়েই চলেছে।
ডাহুক পাখি নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতুহলের অন্ত নেই। ডাহুকের ডাক বড়ই বিরহের সৃষ্টি করে প্রেমিকের মনে। সে মন একাকী চলে যেতে চায় কোনো এক অজানার পথে। যেখানে থাকবে না কোন লোকালয়, থাকবে কেবলই নির্জনতা-নিবিড়তা।
ডাহুক একটি অতি পরিচিত পাখি। ডাহুক জলের পাখি। অত্যন্ত ভীরু। জলাভূমির আশেপাশের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকা এ পাখিটি দেখতে মাঝারি সাইজের। লাজুক স্বভাবের। তাই মানুষের সাড়া পেলেই লুকিয়ে পড়ে। লেজ ছোট। পা লম্বা। পায়ের আঙ্গুলও বেশ লম্বা প্রকৃতির। পিঠের রঙ ধূসর (ফ্যাকাশে কালো) থেকে খয়েরী কালো। মাথা ও বুকের অংশ সাদা।
লেজের নীচের অংশে লালচে আভা রয়েছে। ঠোটের রঙ হলুদ। তবে ঠোটের ওপরে লাল রঙের একটি ছোট্ট দাগ রয়েছে। এছাড়া গ্যালিনিউল অর্থাৎ ডাহুক খুব সুন্দর একটি পাখি। এদের প্রধান আশ্রয়স্থল জল। পুকুর, খাল, জলাভূমি, বিল, নদীর গোপন লুকানো জায়গা এদের খুব প্রিয়।
ডাহুক অনেক সময় পোষও মানে। এ অনুগত পোষা পাখিটি দিয়ে অনেকে বুনো ডাহুকও শিকার করে। ডাহুক মাটিতে ঝোপের তলায় বাসা তৈরি করে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাস এদের প্রজননকাল। জলাশয়ের ধারে ঝোপের মধ্যে এরা বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৬-৭টি। ডিমের রঙ ফিকে হলুদ বা গোলাপি মেশানো সাদা। স্বামী-স্ত্রী মিলে ডিম তা দেয়।
তবে অদ্ভূত ব্যাপার হলো এ পাখির বাচ্চাগুলো কালো রঙের। পোকামাকড়, শামুক, উদ্ভিদের ডগা, শস্যদানা এদের প্রিয় খাবার। তবে বাচ্চার খাবার গ্রহণের সময় ঘটে সবচেয়ে মজার ঘটনা। অন্য বেশির ভাগ পাখিরা তাদের বাচ্চাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। কিন্তু মা ডাহুকী কখনও বাচ্চাদের তুলে খাওয়ায় না।
তাহলে কীভাবে খায় ওরা? ডিম থেকে বাচ্চা বের হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মেই বাচ্চাগুলো অন্তত ২০ফুট উঁচু থেকে লাফ দিয়ে নামে মাটিতে। শরীরটা পাতলা বলে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়লেও তাদের কিছুই হয় না। মাটিতে নেমেই বাচ্চাগুলো মা বাবার পেছনে পেছনে হেঁটে হেঁটে খাবার খুঁটে খুঁটে খায়।
রাতে ডাহুকের ‘কোয়াক' ‘কোয়াক’ ডাক শুনে সহজেই একে চিনতে পারা যায়। এই ডাক পুরুষ পাখির, যা বর্ষাকালে বেশি শোনা যায়। একটানা অনেকক্ষণ ডেকে শ্বাস নেয়। ডাহুকের স্ত্রী প্রতিশব্দ ডাহুকী। ডাহুক বাংলাদেশের একটি বিপন্ন পাখি। একে এখন অতটা আর দেখা যায় না।
উপজেলা প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ডা. একেএম আনোয়ারুল হক বাংলানিউজকে জানান, বন্যপ্রাণি আইনে দেশি ও অতিথি পাখি শিকার এবং তা বাজারে বিক্রি করা দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব পাখি শিকারি ও বিক্রয়কারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এসব অপকর্মকারীদের সাজা নিশ্চিত করা হবে বলে এই কর্মকর্তা দাবি করেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৯ ঘণ্টা, মে ০৭, ২০১৫
এসএইচ