কালাছড়া বিট (মৌলভীবাজার) থেকে ফিরে: লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে চাষ হচ্ছে ধান! সংরক্ষিত এ বনের কোনো কোনো জায়গা জবর দখল করে এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মানুষ বিভিন্ন ফসলাদি উৎপন্ন করে চলেছেন। ফলে নষ্ট হচ্ছে বনের প্রাকৃতিক গুরুত্ব।
তবে এ নিয়ে কোনো প্রকার মাথাব্যথা নেই স্থানীয় বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের। চিরসবুজ প্রাকৃতিক বনে ধানের জমির এমন স্বার্থক ব্যবহারের নমুনা জীববৈচিত্র্যের জন্য চরম হুমকি। তবে বিষয়টি দেখার বা বলার কেউ নেই!
অনুসন্ধানে জানা যায়, বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় ফরেস্ট ভিলেজারসহ সংঘবদ্ধ গাছচোররা অনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে বন ধ্বংসে সরাসরি লিপ্ত। এছাড়া সংরক্ষিত বনের জায়গা খেতের জমি বানিয়ে কিংবা লেবু বাগান তৈরি করে আইনের প্রতি বারবার বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে যাচ্ছেন।
লাউয়াছড়ার জায়গা দখলের এ অভিযোগ কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তিসহ নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর প্রতিও রয়েছে। একটু একটু করে লেবু বাগান তৈরির মাধ্যমে তারা বনকে গ্রাস করে চলেছেন নিজেদের দখলে নিতে।
গত বৃহস্পতিবার (১ অক্টোবর) দুপুরে সরেজমিন লাউয়াছড়ার কালাছড়া বিট ঘুরে দেখা যায়, সংরক্ষিত বনের পাশেই রয়েছে ধানের জমি। সেই জমিতে কিছু দিন আগে ধান রোপণ করা হয়েছে। সবুজ সতেজ ধানে ভরে গেছে বন। কিন্তু প্রাকৃতিক বন কেটে ধ্বংস করে ধানের খেত করার অর্থ তাহলে কী দাঁড়ায়?
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, গত কয়েক বছরে লাউয়াছড়া উদ্যানের ৬শ একরেরও বেশি বনভূমি বেদখল হয়ে গেছে। দখল হওয়া এসব বনভূমিতে গড়ে উঠেছে জনবসতি। আবাদ করা হচ্ছে লেবু, আনারস, ধান। প্রতি বছর এই দখল করা জমির পরিমাণ একটু একটু করে শুধু সম্প্রসারিত হচ্ছে।
শুধু কালাছড়া বিট নয়, পুরো লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের চারপাশ দখল হয়ে যাচ্ছে। বনের গাছ, বাঁশ, বেত কেটে পাচার করা হচ্ছে। ইকোট্যুরিজমের নামে মানুষের মিছিল ঢুকছে বনের গভীরে। উচ্চৈঃস্বরে শব্দ ও হাজারও মানুষের কোলাহলে বিঘ্নিত হচ্ছে বনের নির্জন পরিবেশ। পৃথিবীব্যাপী বিপন্ন উল্লুকসহ কয়েকটি জন্তুও এখন চমর হুমকির মুখে। দীর্ঘতম গাছের অভাবে উল্লুকও একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
কালাছড়া ৯ নম্বর শ্রমিক লাইনের বাসিন্দারা বলেন, আজ থেকে ৩/৪ বছর আগেও এখানে ঘন বন ছিল। এটি কালাপুর বিটের জায়গা। কিন্তু ভিলেজাররা ইনজেকশনের মাধ্যমে বড় বড় গাছের গুড়িতে বিষাক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করে গাছকে প্রথমে মেরে ফেলছে। তারপর মৃত গাছের কথা বলে গাছগুলো কেটে কেটে বন ধ্বংস করে এখন ধান চাষ করছে।
তারা আরও বলেন, তৃণমূল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের সরাসরি অর্থনৈতিক লেনদেনের বিষয় জড়িত। তাই তারা বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন। মোহম্মদ আলী, হরি গৌড়, ক্ষীরদ দেববর্মন, মাখন উরাং, এতোয়া মুন্ডা, জয়লাল, মন্টু প্রমুখ এই বিটের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে লেবু, আনারস, তেজপাতা, ধানসহ বিভিন্ন ফলস চাষ করেছে।
খাসিয়া ও ত্রিপুরা নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনের লংগুরপাড়, রাসটিলা, ছাতকছড়া, ডলুছড়া, ফুলবাড়ি ও জাগছড়া এলাকায় অন্তত ৬শ একর বনভূমি বেদখল হয়ে গেছে। এখন প্রায় ৪শ পরিবার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরে বিভিন্ন অংশে বসবাস করছেন। এসব পরিবারের লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় প্রতি বছর উদ্যানের বনভূমি গ্রাস হচ্ছে।
তারা আরও বলেন, শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার স্থানীয় প্রভাবশালীরা বিভিন্নভাবে লাউয়াছড়া জায়গা দখল করে রেখেছেন।
বন বিভাগের প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে সংরক্ষিত এ বনকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। ২০০২ সালে বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ নামে বনবিভাগ আরও একটি শাখা চালু করে লাউয়াছড়াকে ওই শাখার মৌলভীবাজার রেঞ্জের আওতায় দেওয়া হয়। এর আয়তন ১২৫০ হেক্টর। ২০০৪ সাল থেকে প্রথমে নিসর্গ সহায়তা প্রকল্প, এরপর সমন্বিত রক্ষিত এলাকা সহ-ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (আইপ্যাক) এবং ক্লাইমেট-রেজিলিয়েন্ট ইকোসিস্টেমস্ অ্যান্ড লাইভলিহুডস্ (ক্রেল) নামের একটি প্রকল্প বর্তমানে এ উদ্যানের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বন বিভাগের বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগকে সহায়তা করছে।
মহালদার আবরু মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ধান চাষ করা জমিগুলো সব লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনের অংশ। এখানে বন ও বাঁশঝাড় ছিল। বন কর্মকর্তাদের হাত করে ফরেস্ট ভিলেজাররা বন উজাড় করে বাঁশঝাড় উপড়ে ফেলে এখন ফলস চাষ করছে।
তিনি আরও বলেন, লাউয়াছড়ায় গাছকাটা তো চলছেই। সংঘবদ্ধ পাচারকারীচক্রের মাধ্যমে কেটে নেওয়া গাছের মধ্যে রয়েছে সেগুন, আগর, চাপালিশ, গর্জন, জারুল, লোহাকাঠ, গর্জন, আকাশমণি প্রভৃতি মূল্যবান গাছ।
আবরু মিয়া আরও বলেন, লাউয়াছড়াকে যে কোনোভাবে দখল মুক্ত করা হোক। প্রাকৃতিক বন ফিরিয়ে আনা হোক প্রকৃতি রক্ষার স্বার্থে।
লাউয়াছড়ার উপর সংবাদগুলো পড়ে রোববার (৪ অক্টোবর) দুপুরে দেখা করতে এলেন অভিযুক্ত ক্ষীরদ দেববর্মা ও হরিলাল গৌড়।
লাউয়াছড়ার জায়গায় কেন ধান চাষ করছেন– এমন প্রশ্নে উত্তরে তারা বলেন, এটা তো আমাদের ভিলেজারদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর ধরে আমরা ধান লাগিয়ে আসছি।
এ ব্যাপারে মোবাইল ফোনে কয়েকবার যোগাযোগ করা হলে সিলেট বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) সৈয়দ আলী ফোন রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (বন অধিশাখা-১) সৈয়দ মেহ্দী হাসান বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এমন কোনো ঘটনা হয়ে থাকলে তারা নিজ উদ্যোগে সংরক্ষিত বনকে দখলমুক্ত করবে। তারা ব্যর্থ হলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেবো।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৭, ২০১৫
বিবিবি/এএ
** ৬ সেগুন গাছ কাটা নিয়ে ভিলেজার-চা শ্রমিক উত্তেজনা
** গাছ চুরির সময় মাঠে থেকেও কারাগারে কিশোর লেনাট!