গোপালগঞ্জ: সৌন্দর্য হারাতে বসেছে গোপালগঞ্জের সর্ববৃহৎ চান্দারবিল। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এ বিলের জীববৈচিত্র্যও রয়েছে হুমকির মুখে।
এক সময় কাশিয়ানী, মুকসুদপুর ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা হয়ে কোটালীপাড়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এ বিলের পরিধি। কিন্তু কালের বিবর্তনে বিলের সে আকার ও বৈচিত্র্য দুইই হারিয়ে যেতে বসেছে।
সরেজমিনে জানা গেছে, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে চান্দারবিল তার অতীত ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য হারাতে বসেছে। এতে বিলাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের ওপরও পড়তে শুরু করেছে এর প্রভাব।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র ও বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চান্দারবিল নিয়ে রয়েছে নানা কল্প-কাহিনী। এক সময় এ বিলে চাঁদ সওদাগরের নৌকাডুবি হয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সেই থেকে এ বিলের নাম চান্দারবিল।
এ বিলের আশপাশে রয়েছে মোট ৪৪টি গ্রাম। এসব গ্রামে বসবাস করেন অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। কৃষিকাজ ও মৎস্য সম্পদ আহরণের মাধ্যমেই এসব মানুষের অধিকাংশ জীবন ধারণ করেন।
আধুনিকতার এ যুগেও চান্দারবিল ঘিরে গড়ে ওঠা গ্রামগুলো পশ্চাৎপদই রয়ে গেছে। বেশিরভাগ এলাকায় এখনো পৌঁছেনি বিদ্যুৎ। তবে অবস্থাসম্পন্ন কেউ কেউ বাড়িতে নিয়েছেন সৌরবিদ্যুৎ।
এ এলাকার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাও ভয়ঙ্কর। বেশিরভাগ গ্রামেই নেই ন্যূনতম কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা। ফলে কেউ অসুস্থ হলেই তাকে নিয়ে যেতে হয় উপজেলা বা জেলা সদরের ক্লিনিক-হাসপাতালে।
সম্প্রতি সরেজমিনে চান্দারবিল ঘুরে দেখা গেছে, চারদিকে শুধু থই- থই পানি। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, জনমানবশূন্য বিস্তৃত জলরাশি। মাঝে-মধ্যেই আসছে-যাচ্ছে নৌকা। অবশ্য নৌকা ছাড়া এ এলাকায় যাতায়াতের অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরের প্রায় ৭/৮ মাস পানিতে ডুবে থাকে এ বিলের অধিকাংশ এলাকা। এ সময়টাতে এলাকার শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় সবচেয়ে বেশি সমস্যায়। নৌকা চালিয়ে স্কুলে যাওয়া, আবার একইভাবে বাড়ি ফেরাই তাদের নিত্যদিনের কাজ। বর্ষার সময় তাদের ভোগান্তি চরমে ওঠে। বর্ষাকালে বিল এলাকার অধিকাংশ বিদ্যালয়ে পানি ঢুকে পড়ে। এতে পড়াশোনা ব্যাহত হয়।
চান্দারবিলের পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বিসিএএস সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার বৃহত্তর এক জলাভূমি চান্দারবিল। এ বিলে রয়েছে প্রচুর দেশি প্রজাতির মাছ, শাপলা-শালুক, শামুকসহ প্রাকৃতিক সম্পদ। হাজার হাজার মানুষ এ বিলকে কেন্দ্র করেই তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন।
কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তন এবং বিলে লবণ পানি প্রবেশ, খাল-নালা ভরাট হয়ে যাওয়া, অবাধে শামুক নিধন, কারেন্ট জাল দিয়ে মৎস্য আহরণসহ নানা কারণে এসব প্রাকৃতিক সম্পদের বৈচিত্র্য নষ্ট হতে বসেছে। সেইসঙ্গে কমছে এর প্রাচুর্য।
চান্দারবিলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে শামুক। রয়েছে নানা প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ। এসব মাছ ও শামুক শিকারের ওপর নির্ভরশীল কয়েক হাজার মানুষ। তারা মাছ শিকার ও শাপলা ও শামুক কুড়িয়ে তা বাজারে বিক্রি করেন। কিন্তু অবাধে মাছ শিকার ও শামুক আহরণের কারণে অনেকটাই হুমকির মুখে পড়েছে বিলের জীববৈচিত্র্য।
মুকসুদপুর উপজেলার উজনী ইউনিয়নের ধর্ম রায়ের বাড়ির হরষিৎ মজুমদার ও পরেশ বালা, বরমপাল্টা গ্রামের দেবাশীষ সরকার, কাশালিয়া ইউনিয়নের বেদগ্রামের নিরঞ্জন বাড়ৈ জানান, বিল এলাকায় বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষের জীবনযাত্রার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বছরের অধিকাংশ সময় মানবেতর জীবন-যাপন করেন তারা।
তারা জানান, এসব গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ মাছ শিকার, শাপলা ও শামুক তুলে তা বাজারে বিক্রির মাধ্যমে দিনাতিপাত করেন। কিন্তু বিলে এখন আগের মতো মাছ নেই। ফলে মাছ শিকারীরাও আগের মতোই ভালো নেই।
স্থানীয়রা জানান, মানুষের যাতায়াতের জন্য তেমন কোনো রাস্তা-ঘাট গড়ে ওঠেনি গ্রামগুলোতে। নৌকায় করেই স্কুলে যায় ছেলে-মেয়েরা। হাট-বাজারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজও সারতে হয় নৌকায় যাতায়াত করেই। বিদ্যুতের আলো নেই গ্রামে। রাত হলেই নামে ঘোর অন্ধকার। মনে হয় জনমানবশূন্য নির্জন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।
মুকসুদপুর উপজেলার বেদগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মনোজ কান্তি বিশ্বাস জানান, বিলের অধিকাংশ এলাকা বছরের ৭/৮ মাস পানিতে ডুবে থাকে। এ সময় শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসা-যাওয়া করতে হয় নৌকা নিয়ে। এতে তাদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম থাকে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বিসিএএস’র গবেষণা কর্মকর্তা বিধান চন্দ্র টিকাদার বাংলানিউজকে জানান, বছরের বেশিরভাগ সময় জলমগ্ন থাকে এ বিল। বিল এলাকার মানুষের সমস্যার অন্ত নেই।
তিনি জানান, চান্দারবিলের খাল-নালা পুনর্খনন ও মৎস্য অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে হবে। সেইসঙ্গে অবাধে শামুক নিধন ও অবৈধ উপকরণ দিয়ে মৎস্য আহরণ বন্ধ করতে হবে। এসব না করা গেলে বিলের জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে। চান্দারবিলের বাসিন্দাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এসব অপরিহার্য বলেও মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০১৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
এসআর/এএসআর