শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে ওরা এখন আত্মগোপনে। একটি দু’টি নয়, অসংখ্য।
দলগতভাবে প্রতিটি কর্মযজ্ঞে অক্লান্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া কীটটির নাম পিঁপড়া। হেমন্তের সকাল তখন দুপুরের দিকে এগোচ্ছে। রোদের তীব্রতা মৃদু শীতের ভাব মুছে দিতে ব্যস্ত। হঠাৎ চোখ দিয়ে পড়লো পিঁপড়ের সংঘবদ্ধ আক্রমণ। লাল পিঁপড়ের দল (Fire Ant) একটি ভিমরুল (Hornet) শিকার করেছে।
আর সব কাজ ফেলে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় রইলাম দৃশ্যটির পরের দৃশ্যগুলোর জন্য। অসংখ্য পিঁপড়া একত্রিতভাবে এই শিকারকে টেনে নিয়ে চলছে তাদের সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। ওরা ওদের কাজে তখন প্রচণ্ড ব্যস্ত। একটু বিশ্রামের সময় নেই। সেই মুহূর্তে গভীর পর্যবেক্ষণ চোখ ওদের ওই ঘটনা থেকে নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশী।
কেউ ধরেছে মুখে, কেউ ধরেছে পায়ে, কেউবা হাতে, কেউ আবার তাদের তীক্ষ্ম ঠোঁট দিয়ে কামড়ে ধরেছে শরীরের বিভিন্ন স্থানে! এভাবেই চলছে উড়ন্ত পতঙ্গ ভিমরুলকে জব্দ করে নিজেদের গৃহে নিয়ে যাওয়ার দুর্দান্ত পালা। মাঝে মাঝে নড়ে উঠছে বেচারা ভিমরুল!
প্রায় আড়াই মিটারের গন্তব্যস্থলে পৌঁছুতে পিঁপড়েদের প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় লেগে গেল। এই পুরোটা সময় বিস্ময়ের চোখ নিয়ে সজাগ ছিলাম।
তাদের চলতি পথে হঠাৎ পড়লো উঁচু একটি স্থাপনা। এর উচ্চতা প্রায় চার ইঞ্চি। শিকারটিকে এর উপর দিয়ে টেনে তুলতে হবে। এই উঁচু স্থাপনাটির উপর শিকারটিকে টেনে তুলতে তুলতে হঠাৎ পড়ে গেল মাটিতে।
ভেস্তে গেল দুর্বার এ প্রচেষ্টা! কিন্তু না। পরক্ষণেই পিঁপড়েরা সবাই এসে পাঁচ-ছয় সেকেন্ড নিজেদের মধ্যে কিছু একটা বলাবলি করল যেন! তারপর শুরু হলো পুনরায় ওই শিকারটিকে উপরে টেনে নেওয়ার পালা।
অপূর্ব! এবার সত্যি সত্যিই সফল! দু’বারের প্রচেষ্টায় এলো প্রত্যাশিত সাফল্যে ফলাফল। পিঁপড়ের এমন গোষ্ঠীবদ্ধ শ্রম আমাকে অনায়াসে আমাদের সমাজ ও সভ্যতার গভীর দায়িত্ববোধের কথা নীরবে স্মরণ করিয়ে দিল তখন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান বাংলানিউজকে বলেন, শীতকালে পিঁপড়াদের অ্যাক্টিভিটিসগুলো অনেক কমে যায়। তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে গেলে ওদের এ অবস্থা হয়। ওরা তখন একদম আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। আন্ডারগ্রাউন্ডেই দিনের পর দিন থাকে। আগে থেকে সঞ্চয় করে রাখা খাবারগুলো তখন খায়। অথবা খাবার সংগ্রহ না করতে পারলে ওভাবেই থাকে। মোট কথা শীতকালে ওরা খুব কম খায়। তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রির উপর চলে এলে আবার অ্যাকটিভ হয়ে যায়।
পিঁপড়েদের শ্রম বিভাগ সম্পর্কে ড. ফিরোজ বলেন, পিঁপড়া হলো ফর্মিসিডি গোত্রের অন্তর্গত সামাজিক জীব। এদের রয়েছে একত্রে বাস করা এবং কাজ করার প্রবণতা। এদের শ্রম বিভাগও আলাদা আলাদা। কেউ শ্রমের সঙ্গে জড়িত, কেউ প্রজননবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত, আবার কেউ কেউ নিরাপত্তাদানে জড়িত।
তিনি আরও বলেন, পিঁপড়ারা যখন বড় কোনো শিকার ধরে তখন তার উপর সংঘবদ্ধভাবে অপ্রতিরুদ্ধ আক্রমণ চালায়। কেউ পা ধরে টানে, কেউ মাথা ধরে টানে, কেউ শরীর ধরে টানে। অর্থাৎ, ওরা শিকারটির শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ চালায়। তাদের থেকে অন্তত দশগুণ বা বিশগুণ বড় প্রাণী বা বস্তুকেও তারা সহজেই জব্দ করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যেতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে ড. ফিরোজ বলেন, কিছু কিছু পিঁপড়ে কিন্তু মরে যাওয়া অন্য প্রাণীকেও খায়। যেমন বড় আকারের কোনো ফড়িং (Dragon Fly) মরে গেলে ছোট আকারের কয়েকটি পিঁপড়া অনায়াসে তাকে মুখে করে তুলে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে খেয়ে ফেলে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৯ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৫
বিবিবি/এএ