ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

অস্তিত্ব সংকটে ‘জার্ডনের বাজ’

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, এনভায়রনমেন্ট স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৬
অস্তিত্ব সংকটে ‘জার্ডনের বাজ’ ছবি: সাঈদ জামাল - বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): বছর তিনেক আগের কথা। লাউয়াছড়ার পাকা সড়ক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।

সকালের তরতাজা রোদ ঝকঝক করে তুলেছে চারদিক। তখন বসন্ত প্রায় শেষ। তারপরও সবুজ সৌন্দর্যে গাছ আর পাতাগুলো দারুণ মাখামাখি হয়ে আছে।  

গলায় ঝোলানো ছোট আকারের দূরবীক্ষণ। তেমন উন্নতমানের না হলেও কাজ চলে যায় বেশ। শীত মৌসুমে বাইক্কা বিলের অদূরবর্তী পরিযায়ী পাখিগুলোকে ভালো করে দেখার ক্ষেত্রে এ বাইনোকুলারটি আমার বিশ্বস্ত সঙ্গী।

জানকিছড়া বিটের উঁচু গাছের ওপর একটি অচেনা পাখি দেখার পর বাইনোকুলারটিই এসময় একমাত্র নির্ভরতা হলো। মনে মনে ভয়ও কাজ করছে! যদি সে হঠাৎ উড়ে যায়! তবে দেখার চেষ্টাই হবে বৃথা!

না সে গেল না! ডালের উপর বসেই রইল। খুব ভালোভাবে না দেখতে পারলেও মাথার উপরের ঝুঁটিকে দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এটি ‘জার্ডনের বাজ’। বেচারা কী অবসর সময় পার করছে গাছের ডালে! অথবা শিকারী চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে চারদিক?

প্রথম জার্ডনের বাজ দেখার এ অনুভূতি সব রৌদ্রক্লান্ত ভুলিয়ে দিল। বিশেষ করে তার ঝুঁটিসৌন্দর্য মরে রাখার মতো। যা তাকে রাজার মর্যাদায় অভিশিক্ত করে রেখেছে। স্মৃতিতে নতুন পাখি দেখার সেই উজ্জ্বল সঞ্চয় নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।           

বাংলাদেশের প্রখ্যাত পাখি গবেষক, লেখক এবং বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘জার্ডনের বাজের ইংরেজি নাম Jerdon’s Baza এবং বৈজ্ঞানিক নাম Aviceda jerdoni। এরা মিশ্র চিরহরিৎ সবুজ বনের পাখি। শুধুমাত্র সিলেট আর চট্টগ্রামের বন ছাড়া দেশের কোথাও এদের খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের প্রাকৃতিক বনগুলোর বিরামহীন ধ্বংসের মাঝে যে কয়টা জার্ডনের বাজ এখনো টিকে আছে সেগুলো আমাদের জন্য অমূল্য ধন। আমি নিজেও একটা জর্ডানের বাজ থেকে সীমাহীন উচ্ছ্বাসিত হয়ে পড়ি। ’

প্রাপ্তিস্থানের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, রেমাকালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, দুধ পুকুরিয়া ধোপাছড়ি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এসব ছোট ছোট বনেই ওরা এখনও একটা-দু’টো কোনোক্রমে টিকে আছে। এর বেশি নেই। এগুলো সবই ছোট-ছোট বন, খণ্ড বন; ধ্বংস হয়ে একেবারে কোনোরকম দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখানেই এ পাখিটির বসবাস। জার্ডনের বাজ আমাদের দেশেরই পাখি। সারা বছর আমাদের দেশেই ওরা থাকে। বাসা তৈরি করে ছানা ফোটায়।

পাখিটির খাবার সম্পর্কে তিনি বলেন, ওরা কীটপতঙ্গ এবং পোকা ধরে ধরে খায়। এসব বনগুলোর প্রকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার ফলে এবং ব্যাপক হারে পর্যটক ভ্রমণের ফলে ওর খাবারও অনেক কমে গেছে। আমাদের দেশে বাজ প্রজাতির মধ্যেই এ জার্ডনের বাজটিই আমরা এখনো পাহাড়ি বনে দেখতে পারি। যদিও তার সংখ্যা অত্যন্ত কম। তবে অন্যান্য বাজগুলোকে তো দেখতেই পাই না। সে হিসেবে বলা যেতে পারে জার্ডনের বাজটাই তুলনামূলকভাবে ভালো আছে।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব সূত্রে জানা যায়, জার্ডনের বাজ আমাদের দেশের বিরল আবাসিক পাখি। এদের দৈর্ঘ্য ৪৮ সেমি এবং ডানার দৈর্ঘ্য ৩০.৫ সেমি। দেহ বাদামি। মাথার পেছনে খাড়া ঝুঁটির আগা সাদাটে। এরা উচু স্বরে বিড়ালের মতো: ‘পি-আউ’ কিংবা ‘কিকিয়্যা...কিকিয়্যা’ এভাবে ডাকে।

এরা চিল, শকুনের মতো মানুষের বর্জ্য খেলে বাঁচে না। শুধুমাত্র বনের পোকা-মাকড়, কীটপতঙ্গ, ছোট ছোট সরীসৃপ খায়। পুরোপুরিভাবে বনের খাদ্যের উপর নির্ভরশীল। ফলে বন যেহেতু প্রায় শেষ করে দিয়েছি আমরা তাই ধীরে ধীরে বনের ওপর নির্ভরশীল পাখিগুলোও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে জানান এ পাখি বিজ্ঞানী।

চলতি বছরের ২৬ মার্চ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে এ পাখির ছবিগুলো তুলেছেন বলে বাংলানিউজকে জানান বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী সাঈদ জামাল।  

বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৬
বিবিবি/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।