ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

উপকূল থেকে উপকূল

ঋণের জালে বন্দি জেলে জীবন

অশোকেশ রায়, আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩০ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১৬
ঋণের জালে বন্দি জেলে জীবন ছবি:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

পাথরঘাটা (বরগুনা) থেকে ফিরে: ‘গরিব এলাকা। জালে আগের মতো মাছ ওডে না।

সিডরেও শ্যাষ হইছি। প্যাড বাঁচাইতে আর ডাহাইতে (জলদস্যু) ধরলি ছাড়াইতে ট্যাহা লাগে। বাধ্য হইয়াই ঋণ নেই। এই দেশে যতো লোক আছে সব ঋণি’।

উপকূলীয় জনপদ বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের বলেশ্বর তীরবর্তী পদ্মা গ্রামের কবির নাজিরের (৪০) খেদোক্তি এটি। জলদস্যুদের কাছে সব খুইয়ে জেলে জীবন গেছে তার। স্থানীয় এনজিও’র কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তাকে ছাড়িয়েছেন স্বজনেরা। ঋণের টাকায়ই পদ্মা বাজারে অন্যের কাছ থেকে ছোট দোকান ভাড়া নিয়ে এখন হয়েছেন দোকানি। এখনও দেনা দেড় লাখ টাকা। কিস্তি না পেয়ে মামলা করে তার বাবা-মাকে জেলও খাটিয়েছে ওই এনজিও।  
 
‘আগে মাইঝ্যালি করছি, পশ্চিমে বলেশ্বর পাড় হইছি, সুন্দরবন পর্যন্ত গিয়ে জাল বাইছি, আর অহন ডাকাতদের জন্যি কূলে উঠছি। চা বেইচ্যা কুনোমতে খাই। ঋণের কিস্তি দিতে পারি না, সব সময়ই ভয়ে ভয়ে থাকি’- বলছিলেন কবির নাজির।

বঙ্গোপসাগর-বিষখালী-বলেশ্বর পাড় আর পায়রার মোহনা-সুন্দরবন তীরবর্তী পাথরঘাটার জেলেদের জীবন-জীবিকা মহাজনের দাদন আর এনজিও’র ঋণের জালে বন্দি হয়ে পড়েছে। মাছ ধরতে নদীতে নামার প্রস্তুতিকালেই মহাজন-আড়তদারদের দাদনে ঋণি হন জেলেরা। মাছ বিক্রির অর্থ দিয়ে সে দাদন শুধিয়ে সংসার চালানোর অবস্থায় থাকেন না তারা। ফলে পেটের দায়ে বার বার নানা এনজিও’র কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন।    

যাদেরকে মুক্তিপণের জন্য জলদস্যুরা অপহরণ করে তাদের অবস্থা আরও করুণ। সহায়-সম্পদ বিক্রি করেও জলদস্যুদের চাহিদামতো টাকা যোগাড় না হওয়ায় এক্ষেত্রেও এনজিও থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। পরিণামে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ অনেককে এনজিও’র মামলায় জেলও খাটতে হয়। এলাকা ছেড়ে পালিয়ে ফেরারি জীবনেও বাধ্য হন কেউ কেউ। এক এনজিও’র ঋণ শুধাতে অন্যটি, সেটি থেকে বাঁচতে আরেকটি থেকে ঋণ নেন প্রায় সকলেই। চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে ঋণ-সুদের বোঝা।

পদ্মা গ্রামেরই মতলেব নাজিরের (৭০) করুণ কাহিনীও একই রকম- ‘দু’বার জলদস্যুরা আটকেছে বড় ছেলেকে। জমি বন্ধক রাইখ্যা এনজিও-মাহাজন-আড়তদারদের কাছ থেইক্যা ঋণ নিয়ে ছেলেকে ওমানে পাঠিয়েছি। অহনও আড়তদার-এনজিও মিইল্যা সাড়ে চার লাখ ট্যাহা দেনা’।

এক সময়ের নামকরা মাঝি আলতাফও ঋণের কিস্তি শোধের ভয়ে-আতঙ্কে থাকেন সারাক্ষণ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন- ‘ডাহাইতে ধইরা মাইরলো, টাহা চাইলো পরিবারের কাছে। বোট-জাল-দড়ি সব বেইচ্যেও হইলো না, ঋণ নিয়ে শুধলো সে টাকা। আর আমি হইলাম বেকার, ঋণি। অহন ভয়ে ঘুম আহে না’।  

চরদুয়ানি ইউনিয়নের দক্ষিণ চরদুয়ানি বয়োজ্যেষ্ঠ ইসমাইল হাওলাদার (৬৬) পানিতে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন অনেক আগে। সিডর ও কয়েকবার জলদস্যুর কবলে সর্বস্ব হারানো এই বৃদ্ধও বিভিন্ন এনজিও’র কাছে ৩০ হাজার টাকা ঋণি।

তিনি বলেন, ‘প্যাডতো চালাইতেই হইবো, মাছ ধরতি চালানও লাগবো। পানিতে নাইমা যদি মাছ না ওডে, সে চালান টিকাইতেও হইবো। এতো সব কারণে ঋণ-দাদন ছাড়া উপায়ও নাই’।

তার মতে, ‘ঋণে আগে উপকার হয়, শেষে ক্ষতি। জীবনেও শোধ হয় না, জেলে যাইতে হয়। কতো মানুষ দেশ ছাইড়া পালাইয়া যায়। এইটা গরিব মানুষগুলাও বুঝে, তয় বুইঝ্যাও কিছু করণের থাকে না’।

পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের পদ্মা ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার আব্দুল মজিদ মিয়া (৭০) বলেন, ‘মাছ না পেয়ে এমনিতেই কষ্টে থাকে এখানকার মানুষ। ঠিকমতো খাবার জোটে ‍না, তাই এনজিও’র ঋণ ছাড়া কোনো উপায় নেই তাদের। এ ঋণ পরিশোধে বাধ্য হয়ে অনেক সময় ঘরের আসবাবপত্র, টিন ও চাল পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়। যারা তাও পারে না, জেলে যায় বা কিস্তি শোধের সময় এলে পালিয়ে যায়’।
 
দাদন-ঋণের বোঝায় একই ধরনের বিভীষিকাময়, ভয়-আতঙ্কগ্রস্থ জীবনযাপনের বর্ণনা দিলেন ট্রলার ও মাছ ব্যবসায়ী আব্বাস (২৫), জেলে রহমান খাঁ (২৭), রহিম মুন্সী (৩৩) জাহাঙ্গীর (২৮), মুসা নাজির (৩৪), মো. বাদল (৩৫), মো. দুলাল (২৫), জাফর জমাদ্দারসহ (৩৬) বেশ কয়েকজন যারা মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে এবারও দাদন নিতে বাধ্য হয়েছেন। ‘বোঝা আরও বাড়লো, কিন্তু করার তো কিছু নেই’- এটাই তাদের কষ্টের উক্তি।     

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১৬
এএসআর

** প্রজন্মের পর প্রজন্মের ঘাড়ে জালের জোয়াল
** জলদস্যুরা সর্বহারা পেশাছাড়া করছে জেলেদের
** পানির দেশে পানির আকাল!
** ইলিশ এলে জাগবে পাথরঘাটা, অপেক্ষায় মানুষ
** ‘প্যাড বাঁচাইতে বাঁচাইতে শ্যাষ, পিঠও বাঁচবো না’
** সেই কালরাতের ক্ষতচিহ্ন মোছেনি এখনও
**  পানিতেই জীবন, পানিতেই মরণ!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।