শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার সড়ক ধরে কিলোমিটার দশেক এগোলেই হাজিপুর মোড়। পশ্চিমে মোড় নিয়ে বরুণা পর্যন্ত চার কিলো সড়ক পাকা।
প্রবেশ টিকিট ৩০ টাকা। সঙ্গে ৩১ ফুট উঁচু ওয়াচটাওয়ার থেকে বাইনোকুলারে ফ্রি পরিযায়ী পাখি পর্যবেক্ষণের সুযোগ। এবার শীত এসেছে দেরিতে। আবার আবাহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে থাকবেও না বেশি দিন। ঠাণ্ডার দেশ শ্রীমঙ্গলে তাপমাত্রা ১০ এর নিচে নেমেছে দিন পাঁচেক। এতে কিছুটা বেড়েছে পাখির আনাগোনা। এমনটি মত সেখানকার কর্মচারীদের।
পাতাঝরা হিজল-কড়স বনের টানেল ধরে শিশিরভেজা ঘাসে পা ভিজিয়ে ওয়াচ টাওয়ারের কাছে অন্য বছরের মতো এবারও স্বাগত জানালো মায়াবি বেগুনি কালেম। রং-রূপে অতুলনীয় পাখিটি আসলে বেগুনি রঙেই কামাল করে দেয় তাবৎ পাখিকূলকে। আর মোটা ভাঙা কণ্ঠে খ্যাক…ক্যাক…কোয়াক ডাক, বেগুনি পুচ্ছের ভেতরের দিকে সাদা পালক নাচিয়ে কচুরিপানায় মাছ-পোকা খুটে খাওয়া জানান দেয় ‘আমিই লম্বা পায়ের বেগুনি কালেম। ’
সব নজর যখন কালেম টানছে তার দিকে তখন কোথা থেকে যেন এক ছোট্ট গায়ে ফুটকাটা মাছরাঙা এসে বসলো নৌকোর মাথায়। এরইমধ্যে গুটি গুটি পায়ে দেখা দিলো কয়েকটি পানমুরগি। ডুব দিতেও ওস্তাদ এরা। দূরের শামুকখোলরা বোধহয় আনাড়ি ক্যামেরা চালানোর মজা দেখছিল। পাঁচ পাঁচটি শামুকখোল বিশালবপু নিয়ে গলা উঁচিয়ে দেখছিল সব।
এমনভাবে অবস্থান নিয়ে টানা ঘণ্টা পাঁচেক বসে থাকলো যেন বলছে উম হুম আমার কাছে ঘেঁষতে পারবে না!
এসব দেখতে ভাবতে ভাবতেই চলে এলো নৌকোর মাঝি। প্রায় একশো একরের এ বিলে শুকনো মৌসুমে পানি থাকে গড়ে ৩-৪ ফুট। গ্রীষ্মে তো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় অনেক সময়। নৌকা চললো একটু নাব্য রেঞ্জ ধরে। বলে রাখা ভালো ট্যুরিস্টদের জন্য এখন নৌকা চড়ে বিল ঘোরা নিষেধ।
নিসর্গ, শেভরন, বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাব, ইউ-এস এইডসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মূলত বিভিন্নভাবে লোকজন রেখে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে বিলের জীববৈচিত্র্য। পাখি রক্ষায় কাঠের বাক্স, মাটির কলস, খোপ পদ্ধতি ব্যবহার, বেশি বেশি পানি সহিষ্ণু হিজল কড়সের গাছ লাগানো প্রভৃতি কাজও করছে তারা। যদিও বছর চারেক হলো বাইক্কা বিল বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং ইউএস এইডের আর্থিক সহায়তায় ও ক্রেলের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে বলে জানা যায়।
নৌকায় চলতে চলতে মনটা একটু খারাপই হলো। এই কনকনে শীতেও আশানুরূপ বাড়ছে না পাখি। বরং দিনকে দিন কমছে। দেড়শোর বেশি পাখি এখানে আসে দাবি করলেও এবার নতুন পরিযায়ীর আনাগোনা নেই বললেই চলে। বেগুনি কালেম, শামুকখোল, কালকূট, সরালি, ল্যাঞ্জা হাঁস, পান মুরগি, ধলা বক, চ্যাগা, জলপিপি ছাড়া অন্য পাখি লেন্স ও বাইনোকুলারের দৃষ্টিসীমায় পাওয়া গেলো না।
বিলের মাঝ বরাবর ওড়া-উড়ি ঝাপাঝাপি করে কিছুক্ষণ বিনোদন দিলো কালকূটের দল। সাদা ঠোঁট কালো শরীরের এ হাঁসজাতীয় পাখিটির উচ্ছ্বাস আনন্দ দিলো বেশ। অবশ্য সে যে ডিসটার্ব হয়নি সেটা বলাও মুশকিল।
কানের পাশ দিয়ে শোওওও করে প্লেনের মতো পাখা মেলে উড়ে গিয়ে পানকৌড়িটি যেন সেটার আভাসই দিলো।
তীব্র শীতে সুদূর সাইবেরিয়া, নেপাল, তিব্বত, চীন প্রভৃতি দেশে যখন বরফ জমতে শুরু করে তখন খাদ্যাভাবে পরিয়ায়ী পাখিরা পাড়ি জমায় বাংলাদেশে। এদের বড় একটি অংশের আস্থা বাইক্কা বিল।
গত কয়েকবছরের অভিজ্ঞতা থেকে এবার তুলনামূলক পাখি কম মনে হলেও স্থানীয়দের মতে শেষের কয়েকদিন বেড়েছে। এ বিষয়ে বন্যপ্রাণী ও পাখি গবেষক তানিয়া খান বাংলানিউজকে বলেন, পাখি কমার কারণটা শুধু শীত বলে মনে হয় না। তবে ঠিক বোঝাও মুশকিল। এ বছর ৬টি দাগি রাজহাঁস ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো পরিযায়ী আসতে দেখিনি বা শুনিনি। বিলে নৌকা চালানো একেবারে বন্ধ করা উচিত। আর কড়স বনের দিকে দর্শনার্থী কম গেলেই ভালো। তাতে পাখিদের জন্য মঙ্গল।
তিনি এ-ও জানান, বাইক্কা বিলে পর্যাপ্ত খাবার পাওয়ায় এ বিলের প্রতি পরিযায়ী পাখিদের ঝোঁক বেশি।
সব জায়গার মতো বাইক্কা বিলেও সচেতন নয় দর্শনার্থীরা। টাওয়ারে উঠে চিৎকার না করলে যেন তাদের ভালো লাগে না। পাখিদের উড়িয়ে দেওয়াও তাদের এক অদ্ভুত নেশা। এসব থেকে কবে বিরত হবে কে জানে!
তবে যারা শীত পড়ছে না, বিলে পাখি আসছে না কিংবা কম আসছে- এসব ভেবে বাড়ি বসে রয়েছেন তাদের জন্য মোক্ষম সময় এখন। বেশি পাখি দেখতে হলে যেতে হবে ভোর থেকে সকাল ১০টার মধ্যে। নতুবা বিকেল ৪টার পর। মাঝের সময়টা তাদের খাবার খুটে খাওয়ার। তবে যদি একটি নিরিবিলি পরিবেশ নিজেরা রাখি, তাহলে আরও বেশি পাখি কাছ থেকে দেখার সুযোগ মিলবে। ডিসটার্ব কে পছন্দ করে!!
বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৭
এএ