‘আমরা নাফাখুম পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তিন্দু থেকে শুরু করে রেমাক্রি ও নাফাখুমের আগে অন্তত দশটি জায়গায় হরিণের মাংস বিক্রি করতে দেখেছি।
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পাহাড়ি বাসিন্দাদের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বন্যপ্রাণী শিকার। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রতিকূল পরিবেশে আমিষের আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় শিকারই তাদের খাদ্য সংস্থানের অন্যতম উপায়। বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। নির্বিচারে গাছ কাটা, বিশেষ করে অপরিকল্পিত জুমের কারণে জঙ্গল পুড়িয়ে ফেলা, শিকার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে কমছে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা।
মূলত আদিবাসীদের জুম চাষচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শিকারের প্রথা। বছরের প্রথমে জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে জুমিয়ারা চাষের জন্য পাহাড়ের আগাছা থেকে শুরু করে গাছ-গাছড়া পরিষ্কার করতে আগুন লাগিয়ে দেয়। মে মাসে বৃষ্টি শুরু হতেই ফসলের বীজ বোনা হয়। পুরো বর্ষা মৌসুম ধরে চলে পরিচর্যা। এ সময় জুমিয়ারা পরিবারসহ পাহাড়ের ঢালে জুম ঘরে চলে আসে।
জুমের পাশে এ সময় ফাঁদ/ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে শিকারের আয়োজন চলে। বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিকারের জন্য রয়েছে বিশেষ বিশেষ পদ্ধতি। যেমন মুরং সম্প্রদায়ের ডং, খগলাং, প্রিচেক পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য। মূলত জুম ক্ষেতে আসা হরিণ, শূকরসহ বিভিন্ন ধরনের পাখি ধরা পড়ে। তবে শিকারের মূল মৌসুম শুরু হয় শীতে ফসল তোলা শেষে। এ সময় ব্যাপকভাবে মায়া হরিণ শিকার করা হয়।
আদিম পদ্ধতি ছাড়াও নিজেদের তৈরি গাদা বন্দুক দিয়ে শিকার করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে। অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, এসব বন্দুক তৈরির কাগিরগররা চাহিদা অনুযায়ী বন্দুক তৈরি করে সরবরাহ করেন। খরচ পড়ে মাত্র এক হাজার টাকার মতো। এসব বন্দুকের জন্য ব্যবহৃত বারুদের সাপ্লাই আসে সাতকানিয়া, লোহাগড়ার ম্যাচ ফ্যাক্টরি থেকে। স্থানীয়ভাবে তৈরি বন্দুক ছাড়াও মায়ানমারের তৈরি এয়ারগানের চোরা বাজার আছে রুমা-থানচিতে।
দীর্ঘদিন ধরে বান্দরবানের গহীনে ২৮টি পাড়ায় গবেষণা চালিয়ে বেসরকারি সংস্থা ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স বলছে, প্রত্যেকটি পরিবার বছরে গড়ে তিন কেজি বন্যপ্রাণীর মাংস আহার করে। মূলত আমিষের বিকল্প কোনো কিছু না থাকাতেই এখনো শিকার পুরোপুরি ছাড়তে পারেনি পাহাড়িরা। এছাড়া ঝিরি, পাহাড়ি খালে থাকা কাঁকড়া ও কচ্ছপ তাদের অন্যতম খাদ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের কেলোনিয়ান কনজারভেশন অ্যান্ড বায়োলজি সাময়িকীতে এ ব্যাপারে প্রকাশিত প্রবন্ধে বলা হয়েছে, এ অঞ্চল কচ্ছপদের জন্য একটি হটস্পট। এ এলাকায় এরই মধ্যে আরাকান ফরেস্ট টার্টেলসহ আরও এক প্রজাতির নতুন কচ্ছপ পাওয়া গেছে।
এ অঞ্চলের বিলুপ্ত প্রায় বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণা করছেন শাহরিয়ার সিজার রহমান। তিনি বলেন, এখনও এ অঞ্চলে জীববৈচিত্র্যের একটা ভাণ্ডার আছে। বিশেষ করে সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্ট এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বন। এ সংরক্ষিত অঞ্চলে জনবসতি স্থাপন, গাছ কাটা, শিকার সমানতালে চলছে। বন্যপ্রাণী শিকার বন্ধ করতে হলে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে নজরদারি যেখানে আরও বাড়ানো প্রয়োজন, সেখানে বনবিভাগকে এ অঞ্চলে তেমন কোনো জনবল ও অবকাঠামোগত সুবিধা দেওয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। প্রয়োজন হলে নতুন নতুন এলাকায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করতে হবে। নইলে এ অঞ্চলে মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকা জীববৈচিত্র্য খুব তাড়াতাড়ি হারিয়ে যাবে।
শাহরিয়ার সিজার রহমানের কথার সত্যতা পাওয়া গেলো বন বিভাগের কার্যক্রমে। বাংলানিউজের অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, থানচি থেকে ৫৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাঙ্গু সংরক্ষিত বনের আশপাশে বন বিভাগের কোনো নজরদারি অবকাঠামোই নেই। উপজেলা সদরের অফিসে বসে মাত্র তিনজন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে চলছে তাদের কার্যক্রম। এ ব্যাপারে বান্দরবানের বন কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ কামাল হোসাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ অঞ্চলে শিকার এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এ ব্যাপারে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেছে।
প্রত্যন্ত বিভিন্ন গ্রামের মানুষের সঙ্গে নিয়মিত সচেতনতামূলক বৈঠক করার মাধ্যমে শিকার বন্ধ করার দাবি জানান তিনি।
খাওয়ার জন্য শিকারের পাশাপাশি চোরা শিকারিরাও তৎপর এ অঞ্চলে। পাহাড়ি ময়না, ধনেশ পাখি নিধন হচ্ছে মূলত এদের হাতে। বিভ্রান্তি তৈরি করে তক্ষকের মতো নীরিহ প্রাণী নির্বিচারে ধরা হচ্ছে। দেশের খ্যাতিমান বন্যপ্রাণী গবেষক মনিরুল এইচ খান মনে করেন, বন বিভাগের আইন প্রয়োগের উপর নির্ভর করে বন্যপ্রাণী শিকার বন্ধ করা সম্ভব না।
‘সারা পৃথিবীতে বন্য প্রজাতির বৈচিত্র্যের কারণে যে ৩৪টি হটস্পট আছে তার মধ্যে থাকা ইন্দো-বার্মা বায়োডাইভার্সিটি হটস্পটের অন্যতম অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম। বন্যপ্রাণী শিকার বন্ধ করতে হলে অবশ্যই এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বিকল্প আমিষের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ শুধু আইন প্রয়োগ করে শিকার বন্ধ করা সম্ভব না। বন বিভাগের অবকাঠামো দুর্বল, তাদের লোকবলের মারাত্মক সংকট আছে। বন বিভাগকে শক্তশালী করতে হবে। সুতরাং, দুর্গম অঞ্চলে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে শিকার বন্ধের চিন্তা করলে হবে না। এর বদলে পোল্ট্রি, মাছ চাষকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। বিকল্প আমিষের ব্যবস্থা হলে এখানে শিকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কমে যাবে। ’
ইতোমধ্যেই মাতামুহুরী সংরক্ষিত অরণ্য একেবারে বিলীন হয়ে গেছে। বন্যপ্রাণীরা এখন আর আসে না এখানে। তার বদলে প্রায় দশ হাজার মানুষের বাস এ অঞ্চলে। সম্প্রতি ৪ নম্বর কুড়ুকপাতা ইউনিয়ন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এটিকে। এতো কিছুর পরও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এর বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় থাকা অনেক প্রজাতি এখনও টিকে আছে দেশের পার্বত্য অঞ্চলে। শিকার বন্ধ না করা গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রাণহীন হয়ে পড়বে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ অরণ্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৭
এএ/জেডএম